৫.
টকিং ইউনিয়ন, পিট সিগার, ১৯৪১, আমেরিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক-একটা সময়কে চিহ্নিত করা যায় সেই সময়ের সুর দিয়ে। সময় পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের গান বদলেছে, আবার কখনও গানই সময়টাকে বদলে দিয়েছে। এক-একটা যুগ, এক-একটা গানের জন্মমুহূর্ত। দুই-তিন দশকের ব্রডওয়ে মিউজিক, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, ন্যাট কিং কোল, বারবরা স্ট্রাইসনান্ড-এর জমানা, তারপর এল রক অ্যান্ড রোল যুগ। এলেন এলভিস প্রেসলি, রিচি ভ্যালেন্স, বাডি হলি। তারপর ক্লাসিক রক এল, এল পিঙ্ক ফ্লয়েড, বিটলস, রোলিং স্টোনস। এরপর আসবে হিপ হপ ও র্যাপের যুগ। হিপ হপ ও র্যাপ নিঃসন্দেহে নতুন যুগের প্রতিবাদী গানের অন্যতম ফর্ম হয়ে দাঁড়াল, কিন্তু মুশকিল হল সাধারণ মানুষ রেগে যেতে যেতে এই গান গাইল না। এই গানগুলোতে এত বেশি অপভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যে সাধারণ মানুষ তা গাইতে একটু দ্বিধাই বোধ করেছে। তারা হয়তো গানগুলো শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছে ভেতরে ভেতরে, অভ্যুত্থানের দিকে এক পা অগ্রসরও হয়েছে, কিন্তু প্রকাশ্যে গেয়ে ওঠেনি।
আজ যে গানটি নিয়ে লিখছি, এই গানটি ট্রেড ইউনিয়নের গান, কিন্তু সুরটি সেই সময়ের নিরিখে দেখলে খুবই আনকোরা। গানটি পিট সিগারের ‘টকিং ইউনিয়ন’। ১৯৪১ সালে দাঁড়িয়ে তিনি এই গানটিতে র্যাপ করলেন। তিনি ছিলেন আজীবন ট্রেড ইউনিয়নের সপক্ষে, এই সংগ্রামকে তিনি কাছ থেকে দেখেছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন শ্রমিকদের ওপর ঘটে চলা নিপীড়ন নিয়ে লিখতে, চেয়েছিলেন সেই শোষণযন্ত্র নিয়ে লিখতে, যা দিয়ে শ্রমিকদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালানো হয়। তিনি চেয়েছিলেন এই গান যেন ছড়িয়ে পড়ে, লোকে যাতে জানতে পারে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা শ্রমিকের ঘামে তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সেই শ্রমিকদের ওপরই কোন ধরনের অত্যাচার চালায়। কিন্তু এর সমাধান কী? তিনি বুঝতে পারছিলেন একমাত্র উপায় ইউনিয়ন তৈরি করা, শ্রমিকের ইউনিয়ন। ‘স্টিল প্ল্যান্ট ওয়ার্কার্স মুভমেন্ট’-এর পক্ষে তিনি কনসার্টও করেন।
এই গানে লোকসংগীতের একটা আশ্চর্য ফর্ম ব্যবহার করা হয়। যা আসলে উডি গাথরির ভঙ্গিমা। তিনি গানের মাঝে মাঝেই ছড়া কাটতেন। উডি গাথরি একবার চার্চে গিয়ে ছড়া কেটে বলেছিলেন– ‘If u wanna go to heaven let me tell u what to do… U gotta grease your feet in little mutton stew’। বিভিন্ন গানের আসরে তিনি যেভাবে ছড়া কাটতেন, সেটাই অনেক পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র্যাপ মিউজিকে পরিণত হয়। পিট সিগারও সেসময় এই ফরম্যাটটাই ধার নিলেন। পরে তাঁর একটি অ্যালবামেরও নাম হয় ‘টকিং ইউনিয়ন’।
গানটা তিনি শুরুই করছেন একটা সমাধান দিয়ে–
Now, if you want higher wages let me tell you what to do
You got to talk to the workers in the shop with you
You got to build you a union, got to make it strong
But if you all stick together, boys, it won’t be long
You get shorter hours, better working conditions
Vacations with pay. Take your kids to the seashore
অনেক হয়েছে, অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। এবার উঠে দাঁড়াও। বদলে ফেলো তোমাদের নির্ধারিত নিয়তি। আমার কথা শোনো একবার। একত্রিত হও, পাশের লোকটির সঙ্গে কথা বলো, সহকর্মীকে জানান দাও যে, একসঙ্গে অনেক কিছু বদলে ফেলা যায়। একা যা পারা যায় না, একসঙ্গে তা পারা যায়। একা যে স্বপ্ন দেখা যায় না, পাশের মানুষটাও সেই স্বপ্ন দেখছে জানতে পারলে স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। সময়হীন খাটনি, অল্প মজুরি, কাজের অযোগ্য পরিবেশে আর নয়। এই অত্যাচায়, এই শোষণ ভেঙে ফেলা যাবে যদি ইউনিয়ন তৈরি করা হয়। সবাই একসঙ্গে বিরোধিতা করলে কর্তৃপক্ষ ভয় পাবে। আর তোমরাও সন্তান-সন্ততির সঙ্গে সমুদ্রে বেড়াতে যেতে পারবে, যে স্বপ্ন তুমি অনেকদিন দেখো, কিন্তু এই স্বপ্নের কাছাকাছি যে যাওয়া যায়, তোমরা জানতে না। এবার তোমরা ছুটি পাবে, তোমাদের মুখ থেকে ঘামের ফোঁটাগুলো একটু একটু করে শুকিয়ে যাবে।
It ain’t quite this simple, so I better explain
Just why you got to ride on the union train
‘Cause if you wait for the boss to raise your pay
We’ll all be a-waitin’ ’til Judgment Day
We’ll all be buried, gone to heaven
St. Peter’ll be the straw boss then
Now you know you’re underpaid but the boss says you ain’t
He speeds up the work ’til you’re ’bout to faint
যদি তোমরা মনে করো একদিন তোমাদের মালিকের মন বদলে যাবে, সে তোমাদের প্রতি সদয় হবে, তাহলে তোমরা ভুল ভাবছ। কখনও মালিক পক্ষ চায় না তার কর্মচারীদের যোগ্য মজুরি দেওয়া হোক। তারা চায় কম পয়সায় বেশি খাটিয়ে নিতে। তাই তোমরা যদি এই অব্যবস্থার অবসান চাও, তাহলে তোমাদের ইউনিয়ন গড়তে হবে। নয়তো মালিক তোমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে যাবে যতক্ষণ না তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলো। এই যে বর্ণনাটা, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’-কে। ধুঁকতে ধুঁকতে কাজ করে চলেছে ওরা। লাইন দিয়ে সারি সারি। চোখ অসাড়, যন্ত্রবৎ। কিন্তু ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠার সম্ভাবনাও রয়েছে। সেই সম্ভাবনা প্রতিটি যুগে তৈরি হয়, তাকে সঠিক সময়ে খুঁজে নিতে হয়। খুঁজে নিতে হয় সেই সলতেটাকে, যা আগুন জ্বালাতে পারে। এই গানের স্পষ্ট আড়ম্বরহীন কথা কি সলতের মতো নয়?
You may be down and out, but you ain’t beaten
You can pass out a leaflet and call a meetin’
Talk it over, speak your mind
Decide to do somethin’ about it
লিফলেট লেখো, ছড়িয়ে দাও তা চুপিসারে। সেই লিফলেটে লেখা হোক গোপন মিটিংয়ের ডাক। সে ডাক এমন যে তা যেন কেউ উপেক্ষা করতে না পারে। সিদ্ধান্ত নাও এমন কিছু করার। পিট সিগার কিন্তু কোনও ভণিতা রাখছেন না। সরাসরি বলছেন লিফলেট তৈরি করতে। প্রতিবাদী অক্ষরগুলো ফুটিয়ে তুলতে বলছেন। তিনি নিজেও এই গানে প্রতিরোধী অক্ষর লিখছেন।
Course, the boss may persuade some poor damn fool
To go to your meetin’ and act like a stool
But you can always tell a stool, though, that’s a fact
He’s got a yaller streak a-runnin’ down his back
ইয়েলার, অর্থাৎ ইয়েলো। ইংরেজি ভাষায় হলুদ রংটিকে খারাপ অর্থে ব্যবহার করা হয়।
He doesn’t have to stool, he’ll always get along
On what he takes out of blind men’s cups
শোনো, মালিকপক্ষ এত নিচে নামতে পারে যে একটা অন্ধ লোকের বাটিও কেড়ে নিতে পারে। সেটুকুও ছাড়ে না।
You got a union now, and you’re sittin’ pretty
Put some of the boys on the steering committee
আবেগে ভেসে গিয়ে লোক জড়ো করলেই হবে না। রাগকে মূলধন করে এগতে হলে, সমতার লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে তোমাদের নেতৃত্ব দরকার। সুনির্দিষ্ট পথে এগনোর জন্য সুচিন্তক মানুষও দরকার, যে দূরদর্শী। যে এগনোর সিদ্ধান্ত নেবে। গীতিকার চেয়েছিলেন এগিয়ে যেতে, এই নিপীড়নের শেষ দেখতে। তিনি অপেক্ষা করছিলেন শ্রমিকের সেই জাগরণের, যেখানে শ্রম সম্মানের আসন পাবে, শ্রমিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের ক্ষেপে ওঠার থেকে পবিত্র আর কী আছে?
The boss won’t listen when one guy squawks
But he’s got to listen when the union talks
একা মানুষের কথা মালিক শোনে না। কিন্তু যখন ইউনিয়ন কথা বলে, শোনে। না শুনে উপায় নেই তার। শুনে রাখো, মালিক পক্ষ আসলে ভিতু। সে জানে একত্রিত জনতা সাংঘাতিক, সে জানে শ্রমিক শ্রেণি রেগে গেলে তার পালানোর পথ থাকবে না।
He’d better, be mighty lonely
Everybody decide to walk out on him
Suppose they’re working you so hard it’s just outrageous
And they’re paying you all starvation wages
You go to the boss and the boss would yell
“”Before I raise your pay I’d see you all in hell.””
Well, he’s puffing a big cigar, feeling mighty slick
‘Cause he thinks he’s got your union licked
Well, he looks out the window and what does he see
But a thousand pickets, and they all agree:
He’s a bastard, unfair, slave driver
Bet he beats his wife!
পুঁজিবাদের সঙ্গে কীভাবে পিতৃতন্ত্র মিশে যায় কী সহজে বুঝিয়ে দিলেন পিট সিগার। যে শ্রমিকদের শোষণ করে সেই তো বাড়ি গিয়ে বউয়ের গায়ে হাত তোলে, পেটায়। পিতৃতন্ত্র পুঁজিবাদকে তোষামোদ করে, আর পুঁজিবাদ পিতৃতন্ত্রকে। এই কথা তত্ত্বে পড়তে যতটা কঠিন, তার থেকেও বেশি সহজে গীতিকার এখানে বলে দিয়েছেন। গানটা একটু একটু করে মালিক পক্ষের রূপ প্রকাশ করতে থাকে, আমরা দেখি আমাদের কল্পনায় থাকা দুশ্চরিত্র মালিকপক্ষের চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারি পিট সিগার আসলে কার কথা বলছে।
Now, boys, you’ve come to the hardest time
The boss will try to bust your picket line
He’ll call out the police, the National Guard
They’ll tell you it’s a crime to have a union card
They’ll raid your meetin’, they’ll hit you on the head
They’ll call every one of you a goddam red
পিট সিগার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিল। পার্টির সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি বহিষ্কৃত হন, তবে বুকের ভেতর যাঁর লাল আছে, তিনি তা আজীবন আগলে রাখেন। আর কোনও দিন সংগঠন করেননি তিনি, কিন্তু তাঁর গানে-কথায় তিনি চিরকাল বামপন্থী আদর্শের কথা বলে গেছেন সোচ্চারে। এখানেও আমরা সেটাই দেখতে পাই। তিনি শ্রমিকদের বলছেন, ইউনিয়ন গড়ে ফেলার পর আসল সমস্যাটা শুরু হয়, যখন মালিক জানতে পারে শ্রমিকেরা একত্রিত হয়েছে। এবার সে তোমাদের ভেঙে দিতে চাইবে, পুলিশে খবর দেবে, বলবে সংগঠন করা অপরাধ, আইনবিরুদ্ধ। তারপর লাঠি চালাবে, সেই আঘাত সোজা তোমার মাথায় এসে লাগবে। তার পরেও যদি তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে কর্তৃপক্ষ শেষ খেলাটা খেলবে। কী সেই শেষ খেলাটা? তোমাকে কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে দেবে। চিরকাল এভাবেই দমন করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ভয় পেও না, লাল রঙে বিশ্বাস করা গর্বের।
Unpatriotic, Japanese spies, sabotaging national defense!
But out at Ford, here’s what they found
And out at Vultee, here’s what they found
And out at Allis-Chalmers, here’s what they found
And down at Bethlehem, here’s what they found:
That if you don’t let red-baiting break you up
And if you don’t let stoolpigeons break you up
And if you don’t let vigilantes break you up
And if you don’t let race hatred break you up
You’ll win. What I mean, take it easy, but take it!
এই গানটা একটা স্ট্র্যাটেজি। একটা কূটনীতি। একটা সম্ভাব্য সংগ্রামের নকশা। নিশ্চয়ই পিট সিগার একজন শিল্পী, তাঁর শিল্পী মন এখানে বিরাট ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু একজন শিল্পী যখন কোনও আদর্শকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেন, তখন তিনি শুধু আর শিল্পী থাকেন না, রাজনৈতিক ও সচেতন এক মানুষও হয়ে ওঠেন। তিনি হয়ে ওঠেন জাগরণের নেপথ্য কারিগর। পিট সিগার একজন সংগ্রামের কারিগর।
এই গানে পিট সিগারের সবচেয়ে বড় কূটনীতি ছিল র্যাপ-কে ব্যবহার করা। তিনি পরে অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন অন্য ফর্মগুলোতে এই গানটা বক্তব্য লঘু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মানুষকে আকৃষ্ট করার যে উপাদানগুলোর দরকার ছিল, সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল সুরের অন্য প্রকরণগুলিতে। তিনি চেয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়নকে উদ্বুদ্ধ করতে, তিনি চেয়েছিলেন শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায়ন। কেন ইউনিয়ন করা দরকার, ইউনিয়ন করতে গেলে কী কী বাধা আসতে পারে, কীভাবে তা পেরিয়ে যেতে হয়, এটা জানানো দরকার হয়ে পড়েছিল। এই গানে পিট সিগারের যতটা কাব্যিক অভিপ্রায় ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা।
এই গান তাই এখনও শোনা যায়, বিপ্লবের প্রতিটি সম্ভাবনায় এই গান ফিরে আসে। সলতে হয়ে, আগুন জ্বালানোর স্পর্ধায়। আগুন জ্বলেছিল সেদিন, আবারও জ্বলবে। আশা রাখে শ্রমিক, আশা রাখে সাধারণ মানুষ।
…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস-এর অন্যান্য পর্ব…