তাঁর ছবি আঁকার ঘরে রানী চন্দের অবাধ প্রবেশ ছিল বলে জানা যায়। রানীর কাছেই জেনেছি। ছবি আঁকার সময় প্রয়োজনীয় রঙের শিশি তিনি এগিয়ে দিতেন– সে কথা লিখেছেন ছাপার অক্ষরে। তাহলে বলতে হবে, রবি ঠাকুরের ছবির কালার-প্যালেট একপ্রকার রানী চন্দের তৈরি। তবে কি রবীন্দ্রনাথের ছবির মায়াবী নিসর্গমালার পরোক্ষ রচয়িতা রানী চন্দ? সোনালী-হলুদ আকাশের পটে যেখানে ঘন কালো গাছের রহস্যমাখা সিলুয়েটের সারি– সন্ধ্যার অবর্ণনীয় মেঘমালা, সে কবির ‘নিভৃত সাধনা’ দিয়ে রচিত নয়? সৃষ্টি হয়েছে রানীর ইশারায়?
৬.
ছবি আঁকার সময় কাউকে বড় একটা ঘেঁষতে দিতেন না রবীন্দ্রনাথ। সে সময় দরজায় আগল পড়ত– এমনটা অনেকে বলেছেন। এমনকী, শম্ভু সাহার ক্যামেরাও চিত্রী রবিঠাকুরের নাগাল সেভাবে পেয়েছে বলে মনে হয় না। অন্তত তেমন ছবি নেই। একখানা আছে বটে, তবে সে পোশাকি ছবি, পোজ দিয়ে তোলা ছবি।। সাদা চাদরে ঢাকা টেবিলে বোর্ডে কাগজ রেখে ছবি আঁকা চলেছে। পিছনে খড়খড়ি দেওয়া জানলা, কবির পাশে বাটিতে রাখা জল আর তুলি বা খাগের কলম। এত শৌখিনভাবে রবীন্দ্রনাথের ছবির আসর জমে ওঠার কথা নয়। সেখানে দরকারি-বেদরকারি জিনিসের ছড়াছড়ি হওয়ার কথা। ছবির চরিত্র সে কথাই বলে।
যাই হোক, তাঁর ছবি আঁকার ঘরে রানী চন্দের অবাধ প্রবেশ ছিল বলে জানা যায়। রানীর কাছেই জেনেছি। ছবি আঁকার সময় প্রয়োজনীয় রঙের শিশি তিনি এগিয়ে দিতেন– সে কথা লিখেছেন ছাপার অক্ষরে। তাহলে বলতে হবে, রবি ঠাকুরের ছবির কালার-প্যালেট একপ্রকার রানী চন্দের তৈরি। এ কি সত্যি? তাঁর বিখ্যাত বই ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’-এর টুকরো চকিতে মনে পড়ল। যেখানে রানী লিখছেন, ‘ছবি আঁকার সময়ে কাছে কেউ থাকে তা তিনি চাইতেন না। গোড়াতে যখন ছবি আঁকতেন– দূরে দাঁড়িয়ে থাকতুম। পেলিক্যান রঙের শিশিগুলো দেখতে দেখতে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, আরও জানা হয়ে গিয়েছিল, গুরুদেব কোন রঙের পর কোনটা লাগান ছবিতে’। লিখেছেন, তাঁর কথাতেই রবীন্দ্রনাথ ছবিতে নীল রং লাগিয়েছেন। যদিও ততটা মনে হয় না আমাদের। রানী বলেন, ‘দেখেছি গুরুদেবের ছবিতে লালের প্রাচুর্য, তবু নাকি লাল রঙ ওঁর চোখে পড়ত না অথচ নীল রঙ দেবার বেলায় কত কার্পণ্য করতেন। সে কথা বলাতে মাঝে মাঝে দু-একটা landscape-এ নীল রঙ দিয়েছেন কিন্তু মন খুঁতখুঁত করে।’ সত্যিই কি তাই? আরও বিস্তারে– ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতুম তাঁর আঁকা, নেশার মতো পেয়ে বসেছিল আমাকে। রঙের পর রঙ লাগাতেন। এত তাড়াহুড়োতে ছবি আঁকতেন– খেয়াল থাকত না কী রঙ লাগাতেন, রঙ বেছে নেবার অবসর নেই, হাতের কাছে যে শিশি পাচ্ছেন, তাতেই তুলি ডুবিয়ে দিচ্ছেন।’
ঘটনা যাই হোক, এই অসামান্য বিবরণে রং-তুলি-কাগজের সামনে ব্যস্তসমস্ত ছবি ঠাকুরকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। আবার, ‘অনেক সময় উলটো রঙ লাগিয়ে ফেলবার জন্য আগাগোড়া ছবিই শেষ পর্যন্ত বদলে ফেলতেন। দেখে দেখে আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল উনি কোন রঙের পর কোন রঙ ব্যবহার করে খুশি হন, কোন ছবিতে কী কী রঙ লাগবেন। ছবির সূচনা দেখেই আমি সেই সেই শিশি হাতের কাছে রেখে অন্য শিশিগুলো দূরে সরিয়ে রাখতুম।’ চমকে ওঠার মতো কথা! এর প্রেক্ষিতে মনে হয় চিত্রী রবি ঠাকুরের কৃতিত্বের বারো আনা রানী চন্দের দখলে। বিশেষ করে রঙের ছবিতে। উনি আরও জানিয়েছেন, ‘কখনো বা হলদে আকাশের জন্য রঙ নিতে গিয়ে কালোর শিশিতে তুলি ডোবাতে যাবেন, তাড়াতাড়ি হলদে শিশি এগিয়ে দিতুম। তিনি হেসে উঠতেন, বলতেন– দেখলি, আর-একটু হলেই সর্বনাশ হত। কিছুদিনের মধ্যে আমাকেও তাঁর কেমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল, ছবি আঁকতে শুরু করলেই ডেকে পাঠাতেন, কাছে থেকে রঙ সরিয়ে দিলে খুশি হতেন।’ ভারি আশ্চর্য!
তবে কি রবীন্দ্রনাথের ছবির মায়াবী নিসর্গমালার পরোক্ষ রচয়িতা রানী চন্দ? সোনালী-হলুদ আকাশের পটে যেখানে ঘন কালো গাছের রহস্যমাখা সিলুয়েটের সারি– সন্ধ্যার অবর্ণনীয় মেঘমালা, সে কবির ‘নিভৃত সাধনা’ দিয়ে রচিত নয়? সৃষ্টি হয়েছে রানীর ইশারায়? রবীন্দ্রনাথের ছবি আসলে রানীর ক্রেডিট? না। তা মনে হয় না আমাদের। রবীন্দ্রচিত্রের বর্ণপ্রতিমা রানীর অঙ্গুলি হেলনে তৈরি, এ আমরা মানতে পারি না। ভাবতে পারি না, তিনিই রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর।
মানতে না পারার অন্যতম কারণ, বইটি প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরে। ফলে তাঁর ছবির প্রসঙ্গে কী ছাপা হল– দেখে যেতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। আরও একটা কথা। ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’ বইতে চিত্ররচনা প্রসঙ্গে তারিখ-সহ কয়েকটি ছবির বিবরণ আছে। সময়ের হিসেবে সে বই শুরু ৭ জুলাই, ১৯৩৪ তারিখে। তারপর প্রায় দিনলিপির মতোই উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের মুখে মুখে বলা নানা গল্প, চিন্তার মূল্যবান টুকরো, সাহিত্য-ভাবনা, ছবির প্রসঙ্গ ইত্যাদি। যা কিনা এমনভাবে আর কোথাও নেই। বই শেষ হয়েছে ১২ জুলাই ১৯৪১ তারিখে লেখা রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে। অর্থাৎ অপারেশনের জন্যে কলকাতায় আসার সপ্তাহ দুয়েক আগে পর্যন্ত। সময়ের বিস্তার হিসেবে সে খুব ছোট নয়। রবি ঠাকুরের ছবির ঢল নেমেছে এই তিনের দশকের মাঝামাঝি। অধিকাংশ ল্যান্ডস্কেপ এই সময়েই আঁকা। যদিও রবীন্দ্রভবন সংগ্রহের প্রায় দেড় হাজারের বেশি ছবিতে রানীর বইতে বর্ণিত দিনের ছবি নির্ণয় করা যায়নি। ‘আপালচারি’র তারিখের সঙ্গে মিল খুঁজে না পেয়ে মনে হয় সেগুলি কি তবে রানীর সংগ্রহে? মনে রাখা দরকার আরও একটা কথা। বিশ্বভারতী প্রকাশিত গ্রন্থটির ‘নিবেদন’ অংশে বইয়ের শুরুতেই চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য পাঠকের উদ্দেশ্যে জানিয়ে রেখেছেন, ‘এই লেখাগুলি রবীন্দ্রনাথ দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। ইহাতে এমন কিছু থাকিতেও পারে যাহা তিনি পরিবর্তন বা পরিবর্জন সাপেক্ষ মনে করিতে পারিতেন’। এরপর শেষের ছত্রে ঘোষণা আরও স্পষ্টতর– ‘মুখের কথাকে লিখিত ভাষায় রূপদান করিয়া লেখিকা যদি সাফল্য অর্জন করিয়া থাকেন তবে সে কৃতিত্ব তাঁহারই; যদি ত্রুটি কিছু থাকিয়া গিয়া থাকে তাহার জন্যও তিনিই দায়ী।’ উল্লেখ্য, রবীন্দ্রজীবনের তথ্য অন্বেষণে তাঁর কাছের মানুষদের স্মৃতিকথা অত্যন্ত জরুরি। সেগুলি সময়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়াও জরুরি। তাহলে কি লিখতে গিয়ে কোথাও বিভ্রম ঘটেছে? প্রতারণা করে বসেছে স্মৃতি? তবে শম্ভু সাহা নাগাল না পেলেও মুকুল দে’র ক্যামেরায় ধরা আছে আর্টিস্ট রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব ছবি। ১৯২৮-এর জুলাইতে কলকাতার চৌরঙ্গী আর্ট স্কুলের দোতলার ঘরে নেওয়া। অসাধারণ ছবি, চিত্রমগ্ন সে এক অন্য ছবিঠাকুর।
(চলবে)