ভারতে জুতো উল্টে রাখা মানে লক্ষ্মীকে বিদায় করা। আমাদের লতা মঙ্গেশকর, যাঁর কণ্ঠ দেশের গর্ব, তিনিও এই কুসংস্কার মানতেন। নয়ের দশকে একবার তাঁর গানের রেকর্ডিং খারাপ হয়। বাড়ি ফিরে দেখেন, স্যান্ডেল উল্টে রাখা। তিনি তৎক্ষণাৎ সেগুলো ঠিক করে পুজোর ঘরে মন্ত্র পড়েন। পরের গান? ব্লকবাস্টার! আর বলিউডের মহানায়ক অমিতাভ বচ্চন? ২০০০-এর দশকে তাঁর কয়েকটি ছবি ফ্লপ হয়। গুজব ছড়ায়, তাঁর মুম্বইয়ের বাড়িতে এক অযত্নশীল সহকারী জুতো উল্টে রাখত। পণ্ডিতের পরামর্শে জুতো ঠিক করা হয়, একটু পুজো, আর পরের ছবি হিট।
৮.
জুতো। পায়ের আশ্রয়, রাস্তার ধুলোর বিরুদ্ধে প্রথম সৈনিক। কিন্তু জিনিসটা উল্টে গেলে ভাগ্য চাকারও পপাত চ আর মমার চ অবস্থা! যাকে বলে ইট পাটকেল চিৎপটাং-এর বাবা। মধ্যযুগের ওয়েলশ গ্রাম থেকে বলিউডের স্টুডিও, মিশরের সুলতানার প্রাসাদ থেকে বুশ সাহেবের প্রেস কনফারেন্স– সব মিলে একটা জুতসই ট্র্যাজেডি।
সপ্তদশ শতাব্দীর ওয়েলশ গ্রামের কৃষক রিস জোন্সের বাড়িতে হঠাৎ গোলমাল। ফসল নষ্ট, গরু মরছে, আর রাতে ভূতের নাচের শব্দ। গ্রামের বুড়ি, যাকে সবাই মনে করে ‘ভূতের পিসি’, এসে বলল, ‘রিস, তোর শস্যাগারের সামনে জুতো উল্টে রাখা! এটা তো কফিনের মতো দেখায়, এ তো ভীষণ অপয়া! মৃত্যু কি তোকে ডাকছে নাকি রে?’ রিস দৌড়ে গিয়ে জুতো ঠিক করে, গির্জায় মোমবাতি জ্বালায়, আর দরজায় ঘোড়ার নাল ঝোলায়। ফলাফল? গোলমাল বন্ধ। এই গল্প শুনে চার্লস ডিকেন্স, যিনি ভূতের গল্পে মশগুল, চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘জুতো উল্টে গেলে ভূতেরা নাচে।’ ডিকেন্স যদি এই কুসংস্কারে মজা পান, তাহলে টুইটারের মিম কী দোষ করল?
এই জুতো উল্টোনোর ভয় শুধু গ্রামে ছিল না। মধ্যযুগে ইউরোপে লোকে জুতো লুকিয়ে রাখত দেওয়ালে, চিমনিতে, ভূত-প্রেত থেকে বাঁচতে। নর্দাম্পটন মিউজিয়ামে এখনও ২,০০০ জোড়া লুকানো জুতোর রেকর্ড আছে। কিন্তু জুতো যদি উল্টে যেত? তাহলে সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! ভূতেরা নাকি হাসতে হাসতে ঢুকে পড়ত। ভিক্টোরিয়া রানির প্রাসাদেও এমন কাণ্ড হয়েছিল। ১৮৬১ সালে, প্রিন্স অ্যালবার্টের মৃত্যুর পর, এক দাসী রানির স্লিপার উল্টে রেখেছিল। রানি ভয় পেয়ে বলেছিলেন, ‘এ কী অশুভ লক্ষণ!’ ব্যাপারটা জানাজানি হলে ভিক্টোরিয়ার প্রোক্লেমশনে দাউ দাউ জ্বলতে থাকা পরাধীন ভারতবাসীরা এই অপয়া হাতিয়ারকেই ব্যবহার করে কোহিনূর চোরদের শায়েস্তা করতেন হয়তো।
ওদিকে আবার ১২৫৭ সালে মিশরের সুলতানা শাজার আল-দুরকে তাঁর দাসীরা চটি দিয়ে পিটিয়ে মারে। কী লজ্জার! জুতোর তলা দেখানো মধ্যপ্রাচ্যে চরম অপমান। উল্টো জুতো রাখা তাই শুধু অপয়া নয়, সোজাসুজি অসভ্যতা। এই ঘটনার ছায়া দেখি ২০০৮ সালে, যখন ইরাকি সাংবাদিক মুনতাধার আল-জায়দি জর্জ ডব্লিউ বুশের দিকে জুতো ছুড়ে বলেন, ‘ইরাকি জনতার তরফ থেকে এই বিদায়ের চুমু!’ বুশ সাহেব হাসলেন, কিন্তু ইরাকের রাস্তায় নাচ শুরু হল। উল্টো জুতোর অভিশাপ এখানে সরাসরি না থাকলেও, এ ছিল বুশের নাকতলায় শাহি সুকতলার অপমান।
ছয়ের দশকে সৌদি আরবে এক রাজকীয় ভোজে, এক অতিথি ভুলে জুতো উল্টে রাখেন। পরে সেই পরিবারের ব্যবসায় লোকসান হয়। গুজব ছড়ায় যে জুতোর অভিশাপই কারণ। এই ঘটনা সৌদি রাজপরিবারের কানে পৌঁছয় এবং রাজকীয় গৃহকর্মীরা উল্টো জুতোর ব্যাপারে কড়া নির্দেশ পান, যা আজও মেনে চলা হচ্ছে।
১৬৫০-এর দশকে ইংল্যান্ডের এক গ্রামে, ক্রমওয়েলের আমলে, এক ধনী বণিকের বাড়িতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বণিকের স্ত্রী অসুস্থ, ব্যবসা ডুবছে। এক স্থানীয় পুরোহিত দেখেন, বাড়ির প্রবেশপথে এক জোড়া জুতো উল্টে রাখা। তিনি বললেন, ‘এটা শয়তানের আমন্ত্রণ!’ জুতো ঠিক করে, বাড়িতে পবিত্র জল ছড়ানো হল। বণিকের স্ত্রী সুস্থ হলেন, ব্যবসা ফিরল। এই গল্প অলিভার ক্রমওয়েলের কানে পৌঁছেছিল, যিনি ধর্মীয় কঠোরতার জন্য বিখ্যাত। তিনি হয়তো হেসেছিলেন, কিন্তু গ্রামের লোকেরা উল্টো জুতোর ব্যাপারে আর ভুল করেনি।
ভারতে জুতো উল্টে রাখা মানে লক্ষ্মীকে বিদায় করা। আমাদের লতা মঙ্গেশকর, যাঁর কণ্ঠ দেশের গর্ব, তিনিও এই কুসংস্কার মানতেন। নয়ের দশকে একবার তাঁর গানের রেকর্ডিং খারাপ হয়। বাড়ি ফিরে দেখেন, স্যান্ডেল উল্টে রাখা। তিনি তৎক্ষণাৎ সেগুলো ঠিক করে পুজোর ঘরে মন্ত্র পড়েন। পরের গান? ব্লকবাস্টার! আর বলিউডের মহানায়ক অমিতাভ বচ্চন? ২০০০-এর সময়কালে তাঁর কয়েকটি ছবি ফ্লপ হয়। গুজব ছড়ায়, তাঁর মুম্বইয়ের বাড়িতে এক অযত্নশীল সহকারী জুতো উল্টে রাখত। পণ্ডিতের পরামর্শে জুতো ঠিক করা হয়, একটু পুজো, আর পরের ছবি হিট। সত্যি না গুজব, তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে, তবে উল্টো জুতোর সাইজ অনুযায়ী যদি ভাগ্যের দিশাও কিং সাইজ উল্টে যায় তাহলে বচ্চন সবচেয়ে এগিয়ে। ‘বিগ বি’-র বিগ জুতো বলে কথা। তবে আরেক লম্বা লোক– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক কবিতায় ‘অযত্নের পদচিহ্ন’ বলে উল্টো জুতোর অভিশাপকে রাবীন্দ্রিক তাৎপর্য দিয়েছেন।
ওয়েলশের খনি অঞ্চলে আবার জুতোর কুসংস্কার ছিল জীবন-মৃত্যুর খেলা। বিশের দশকে এক শ্রমিক বাড়িতে উল্টো জুতো দেখে কাজে যাননি। সেদিন খনিতে ধস, তিনি বেঁচে যান! এই গল্প শুনে ডেভিড লয়েড জর্জ, ওয়েলশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, বলেছিলেন, ‘খনির লোকেরা জুতোর ওপর ভরসা করে, আর আমি তাদের বিশ্বাসের ওপর।’
আজকের দিনে এই কুসংস্কার যদিও কিছুটা ফিকে, কিন্তু পুরোপুরি নয়।
প্রাক্তন ইংরেজ ফুটবলার জন টেরি, চেলসির ক্যাপ্টেন, লকার রুমে বুট উল্টে থাকলে দেখলে তৎক্ষণাৎ সোজা করে নিতেন। হারের ভয়ে বুটের ওপর এত ভরসা তাঁর! চেলসির টেরি ভাই বিলক্ষণ জানতেন, বুট ঠিক রাখলে, গোল হবে।
পাঁচের দশকে উত্তরপ্রদেশে এক নববধূর স্যান্ডেল উল্টে রাখা হয়েছিল। পরিবার থামিয়ে দেয় সেই বিয়ে, কারণ এটা অশুভ। আগে স্যান্ডেল ঠিক হল, পুজো হল, তারপর বিয়ে। ধারণা খুবই স্পষ্ট। বিয়ের আগে স্যান্ডেল চেক করো, নইলে লক্ষ্মী আর শ্বশুরবাড়ি দুটোই ফসকাবে!
জুতো বা চটি উল্টে না রাখার পেছনে যে চালু লজিকটা আছে তা হল, অপরিপাটি, অমনোযোগী আর ক্যালাস একটা অ্যাপ্রোচ। এই তিনটি ভূষণ যার চরিত্রে আছে তার ভাগ্য এমনিই উল্টে থাকার কথা। নিমন্তন্ন বাড়িতে বা যে কোনও পাবলিক প্লেসে এমন দৃশ্য দূষণ যাঁরা সৃষ্টি করেন, তাঁদের যদি বলে-কয়েও সচেতন না করা যায়, তখন কুসংস্কারের সহায় নেয় সভ্যতা। অসভ্যতার বিরুদ্ধে তখন বুক বাজিয়ে জয়ী হয় অপয়ার ভয়।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা