গণেশ হালুই শিল্পীই হতে চেয়েছিলেন। কৈশোরে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের জামালপুরের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সঙ্গে ছিল রং-তুলি কাগজ, কাঠের বোর্ড আর তামার পাতের মাথাওয়ালা খানকতক বোর্ড পিন। যখন মায়ের হাতে ট্রাঙ্ক, বিছানা, বাসনকোসনের বোঝা, তখনও তাঁর আশ্রয় ওই রং-তুলি। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় বাড়িতে যেখানে পড়তে বসতেন, তার মুখোমুখি জানলাটি চিরকালের জন্য বন্ধ করে নিজের আঁকা দুটো ছবি সেঁটে দিয়ে যান। এটাই নিজের আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী। আয়োজক দেশভাগ। যার একমাত্র দর্শক ছিলেন শিল্পী নিজেই। জানালার ওপারে ব্রহ্মপুত্র, নদীর ওপারে শেরপুর, গারো পাহাড়, তার ওপারে মেঘালয়। গণেশ হালুইয়ের এই বাড়িটি এখন আর নেই।
মায়ের গয়না বিক্রির ৩০ টাকা হাতে নিয়ে– গণেশ হালুই কলকাতা গভমেন্ট অফ আর্ট কলেজে ভর্তি হন ১৯৫১ সালে। ভর্তি ফর্মে ঠিকানা লিখতে হয় ‘১২নং প্লাটফর্ম, হাওড়া স্টেশন’। তখনও প্ল্যাটফর্মটি জুড়ে ছিল রিফিউজিদের ভিড়। গণেশ হালুই হাওড়া স্টেশন থেকে ক্লাস করতে যান আর্ট কলেজে, ক্লাস শেষে ফিরে আসেন হাওড়া স্টেশনে।
নৈঃশব্দ্যের শিল্পী গণেশ হালুই। যার ছবি নড়েচড়ে না, কিন্তু জীবনকে নাড়িয়ে দেয়। গণেশ হালুইয়ের যখন ১১ বছর বয়স তখন ‘দেশভাগ’ হয়। দেশভাগের অপর নাম ভয়ংকর দ্বিজাতিতত্ত্ব, জাতিভেদ, বৈষম্য, হিন্দু-মুসলমান সৌহার্দ্যহীন, সম্প্রীতিহীন, শোষণ, বঞ্চনা, যন্ত্রণা– জন্মভূমি থেকে ছিন্নমূল হয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া। ১৯৫০ সালের দিকে গণেশ হালুইয়ের পরিবার জন্মভূমি জামালপুর ছেড়ে আশ্রয় নেন প্রথমে রানাঘাট কুপার্স ক্যাম্পে উদ্বাস্তু হিসেবে। এরপর বিহারের রাজমহল, মোকামা ও মুঙ্গেরে।
গণেশ হালুই শিল্পীই হতে চেয়েছিলেন। কৈশোরে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের জামালপুরের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সঙ্গে ছিল রং-তুলি কাগজ, কাঠের বোর্ড আর তামার পাতের মাথাওয়ালা খানকতক বোর্ড পিন। যখন মায়ের হাতে ট্রাঙ্ক, বিছানা, বাসনকোসনের বোঝা, তখনও তাঁর আশ্রয় ওই রং-তুলি। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় বাড়িতে যেখানে পড়তে বসতেন, তার মুখোমুখি জানলাটি চিরকালের জন্য বন্ধ করে নিজের আঁকা দুটো ছবি সেঁটে দিয়ে যান। এটাই নিজের আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী। আয়োজক দেশভাগ। যার একমাত্র দর্শক ছিলেন শিল্পী নিজেই। জানালার ওপারে ব্রহ্মপুত্র, নদীর ওপারে শেরপুর, গারো পাহাড়, তার ওপারে মেঘালয়। গণেশ হালুইয়ের এই বাড়িটি এখন আর নেই। বাড়ির চিহ্ন বলতে একদিকে ব্রহ্মপুত্র দখল হয়ে সরু খাল, পাশে কালীমন্দিরটি রয়েছে। বড় রাস্তার নামটি আছে কালীঘাট রোড নামেই। কিন্তু মহল্লার নতুন নামকরণ হয়েছে ‘ঢাকাইপট্টি’ হিসেবে।
‘শেকড়ে ফেরা’ শিরোনামে সাত ভারতীয় বাঙালি শিল্পীর ছবির প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য হয় ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময় ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারিতে। সাতজনের একজন ছিলেন শিল্পী গণেশ হালুই। এই সাতজন শিল্পীর জন্মই অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গ যা বর্তমানে বাংলাদেশ। ঢাকায়– পরিতোষ সেন ও সুহাস রায়, সন্দীপ– অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফরিদপুর– বিজন চৌধুরী, গোপালগঞ্জ– যোগেন চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া– ধীরাজ চৌধুরী, জামালপুর– গণেশ হালুই।
২০১৩ সালের শেষের দিকে ঢাকায় ‘বাস্তবের ছন্দ’ শিরোনামে শিল্পী গণেশ হালুইয়ের একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়। এই সময়ে গণেশ হালুই ঢাকায়। গণেশ হালুই ঢাকা থেকে বহু দূরের শহর জন্মভূমি ময়মনসিংহ বিভাগের জেলা শহর জামালপুরে যান তিনদিনের সফরে। তাঁর সফরসঙ্গী হন চিত্রশিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, লেখক-সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং কিউরেটর সুবীর চৌধুরী।
বাংলাদেশের মধ্য-উত্তর সীমান্তে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত জামালপুর জেলা। বঙ্গে সেন বংশের রাজত্বকাল (১১০০-১২০৩ খ্রিষ্টাব্দ) এই এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠে। পূর্বে এই এলাকার নাম ছিল সিংহজানি। পরবর্তী সময়ে সুফি দরবেশ হজরত শাহ্ জামাল (রহ.) এর নামানুসারে জামালপুর জেলার নামকরণ করা হয়। জামালপুর জেলার ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে শহরের মাঝামাঝি রয়েছে ‘সিংহজানি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’। রয়েছে ৩২৭ বছরের পুরাতন দয়াময়ী মন্দির।
শিল্পী গণেশ হালুইয়ের জন্ম ব্রহ্মপুত্রের ধারে জামালপুর শহরে ১৯৩৬ সালে তখন জামালপুর মহকুমা শহর হলেও তা ছিল অনেকটা গ্রামের মতো। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন, বাবা ছিলেন খুচরো পাট ব্যবসায়ী। ব্রহ্মপুত্রের ধারে চাঁপাতলায় ছিল বড় বড় পাটের গুদাম ঘর। চাঁপাতলায় সপ্তাহে মঙ্গল ও শনিবার বড় হাট বসত। পাট কেনার সময় বাবার সঙ্গে হাটে যেতেন। বাবা টাকার খুঁটি রাখতে দিতেন গণেশ হালুইয়ের কাছে। কেনাকাটার শেষে বাবার কাছ থেকে এক আনা বকশিস পেতেন। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় ৪৬ বছর বয়সে ম্যালরিয়ায় মারা যান বাবা।
গণেশ হালুইয়ের প্রথম পড়াশোনা শুরু হয় জামালপুর জেলা স্কুলে। তাঁরা তিন সহোদর। তিনজনই জামালপুর সরকারি হাই স্কুলের ছাত্র। ভাইদের মধ্যে গণেশ হালুই ছিলেন মেজো। জামালপুরে তাদের দুটো বাড়ি ছিল। সবগুলি টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়ি। গরমের সময় ঘরে তাপ কমানোর জন্য টিনের ছাউনির নীচে দরমার চাটাই দেওয়া থাকত। বাবা দরমার বেড়া বানাতে পারতেন। বেড়া বানানোর সময় বাবার প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করতেন গণেশ হালুই।
গণেশ হালুইয়ের আত্মস্মৃতিমূলক রচনার শেষ অংশ পড়তে গিয়ে তাঁর আজকের আঁকা অনেক ছবির সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘পাট গাছের গন্ধ। পাট ভেজানোর গন্ধ। রোদে পাট ঝুলিয়ে শুকোতে দেওয়ার গন্ধ। গোছ করে দাঁড় করিয়ে রাখা শোলার গন্ধ। পাট কেনার সময় শুকনো সেই পাটের গন্ধ এখনও আমাকে টানে। টানে খালে-বিলে-জলায় একলা বেড়ানোর কথা। কোথাও ঝোপঝাড়ের মধ্যে নিথর জমাট বাঁধা কালচে জল। তারই মাঝে যেন কী চলে, কী নড়ে। চুপ করে পড়ে কী? এমনি সব অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার। টানে নদীর তীরে মাছের গন্ধ। সন্ধ্যায় দলবদ্ধ কুঁচো মাছের খেলা। জলের উপর কানকোর মতো ভাঙা হাঁড়ির টুকরো ছুড়ে ব্যাং-ব্যাং খেলার মতো মাছেদের লাফিয়ে লাফিয়ে চলা। জলের তলটুকুও যেন দেখতে পেতাম আমি। দিগন্তবিস্তৃত জলে, ওই দূরে ধু-ধু বালির চরে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ চিহ্নের মতো কী যেন এখনও খেলা করে। এখনও পাটের মধ্যেই আমার বাবার গন্ধ পাই।’
সেই কবে জন্মেছিলেন ব্রহ্মপুত্র নদীর পারে। যার অববাহিকায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক– সেই সম্পর্কের হদিশ এখনও খুঁজে বেড়ান। ঘুমানোর সময় মাথার নীচে রাখেন ব্রহ্মপুত্র চরের বালিশ। স্বপ্নে থাকে পক্ষীমারীর চর।
ছবি: কামরুল হাসান মিথুন
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved