অ্যাটউড শেষে লিখেছেন, এ বইটিতে যেসব অত্যাচার বা মনোভাবের কথা আছে নারীদের বিষয়ে, সেগুলো তাঁর নিজ সমাজ, কানাডা বা আমেরিকার সমাজে অভাবনীয় বা প্রচণ্ড পশ্চাৎপদ বলে মনে হলেও, বস্তুত সেগুলো সারাক্ষণই পৃথিবীর অন্য নানা প্রান্তে ঘটে চলেছে। তিনি বলেছেন, আমার এ বইতে আমি একটা কথাও লিখিনি যা বাস্তবে কোথাও না কোথাও ঘটেনি। অথচ বইটিকে ডিসটোপিক ফ্যান্টাসির নাম দেওয়াই চলে!
৯.
I’d read extensively in science fiction, speculative fiction, utopias and dystopias ever since my high school years in the 1950s. But I’d never written such a book. Was is up to it?
The form was strewn with pitfalls, among them a tendency to sermonize, a veering into allegory, and a lack of plausibility. If I was to create an imaginary garden, I wanted the toads in it to be real. One of my rules was that I would not put any events into the book that had not already happened in what James Joyce called the ‘nightmare’ of history, nor any technology not already available. No imaginary gizmos, no imaginary laws, no imaginary atrocities. God is in the details , they say. So is the devil.
হ্যাঁ রে মেয়ে! তুই যে শরীরে বাস করিস, সে শরীরের ওপর আদৌ অধিকার আছে না কি নিজের? নইলে, নিজের শরীরকে অনাবৃত করাটা এত বড় ধৃষ্টতা বলে কীভাবে প্রতিপন্ন হয়? কেন সমাজ পথ আগলে থাকে আর মেয়েদের বলে দেয়, তার শরীর তার নয় আসলে?
একটা বই পড়তে পড়তে এইসব প্রশ্ন বার বার উঠে দাঁড়ায়। সে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার কাছে এটাই। মেয়েদের শরীরের সঙ্গে তাদের নিজেদের সম্পর্ক। মুখোমুখি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র কীভাবে মেয়েদের শরীরকে ব্যবহার করে, নিয়ন্ত্রণ করে। যে বইটি পড়ছি এবং তলিয়ে যাচ্ছি এক ছটফটে বদ্ধতার কুয়োয়, সে বই ১৯৮৪-তে লেখা মার্গারেট অ্যাটউডের লেখা উপন্যাস, ‘‘দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল’’। যাকে তুলনা করা হয় জর্জ অরওয়েল লিখিত ১৯৮৪ উপন্যাসের সঙ্গে। বীভৎস এক ডিসটোপিয়া, দুঃস্বপ্নের দেশ হয়ে গিয়েছে সে গল্পে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকা নামক দেশটি, হঠাৎ উলটে গেছে সমাজ-রাষ্ট্রের বিধিবিধান। আচমকা পাশ্চাত্যকৃত বা ওয়েস্টার্নাইজড, তথাকথিতভাবে লিবারেটেড (পড়ুন বেহায়া, বেআব্রু) মেয়ে শরীরের ওপর নেমে এসেছে ফতোয়া, ধর্মীয় কানুন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। গল্পে, সে দেশ পরিণত হয়েছে খ্রিস্টান ধর্মীয় মৌলবাদের এক আখড়ায়। রাষ্ট্র মেয়েদের ‘সুরক্ষা দিতে’ সম্পূর্ণ একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে আবার মেয়েদের লেখাপড়া, কাজ করা, ভোট দেওয়া, সব ধরনের কর্তৃত্ব নিষিদ্ধ করেছে, পর্দানশীন করেছে। আর পরিণত করেছে এক শরীরে, যার কাজ শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়া। যেন ইতিমধ্যে, নারীমুক্তির পূর্বেকার ধারণা সব মিথ্যে প্রমাণিত। আসলে তো মেয়েরা স্বাধীনতাকে নিয়ে কী করবে বুঝতেই পারে না, নিজেদের শরীরকে সঠিক ব্যবহার না করে নষ্ট করে ফেলে, তাই তাদের সুরক্ষা দিতে আনতেই হয় ঘোমটা, পর্দা। নিষিদ্ধ হয় তাদের নিজের শরীরের ওপর নিজেদের অধিকারের স্পর্ধাপ্রদর্শন। তাদের শরীর তাদের সম্পত্তি থাকে না আর, থাকে না আর তা নিয়ে যা খুশি করার অধিকার।
‘এই যে চাদ্দিকে এত অবাধে নারী ধর্ষণ, এ তো আসলে মেয়েদেরই দায়, তাদেরই দোষ, নিজের শরীরকে ক্রমাগত দেখিয়ে দেখিয়ে, নিজেদের শরীরের প্রদর্শনে পুরুষের লোভ জাগিয়ে জাগিয়েই মেয়েরা নিজেদের এই ক্ষতি ডেকে আনেনি কি?’ এমন কাল্পনিক সংলাপ রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখে, অ্যাটউডের গপ্পে। অন্ধকার সেই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দিনে, মেয়েদের পরিণত করা হয়েছে যন্ত্রে। জরায়ুযন্ত্রে। কারণ জনসংখ্যা কমে গিয়েছে, তাই জন্ম দিয়ে যেতে হবে তাদের। প্রেমহীন, এমনকী যৌনতারও আনন্দহীন, কেবলমাত্র সন্তানজন্মের ধারকে পরিণত হতে হয়েছে তাদের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অ্যাটউড যখন পড়ে পাওয়া, খেটে পাওয়া, লড়ে পাওয়া নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্র হিসেবে শরীরকে দেখার বিষয় নিয়ে দুঃস্বপ্নের জগৎ কল্পনা করেন, যেখানে মেয়েদের মুখ ঢাকা, চুল ঢাকা, সর্বশরীর দীর্ঘ গাউনে ঢাকা, সে দুঃস্বপ্ন আজও একটা ইরানে, একটা ভারতে, একটা পাকিস্তানে, একটা বাংলাদেশে কতটা জীবন্ত, ভেবে শিউড়ে উঠতে হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রশ্ন এইখানেই ঘুরপাক খেতে থাকে। সমাজের উদ্দেশে, রাষ্ট্রের উদ্দেশে, মেয়েদের শরীরকে কেন যে নিবেদিত, উৎসর্গীকৃত হতে হয়! যুগ যুগ ধরেই কেন যে ‘মহৎ’, ‘পবিত্র’ থাকতে হয়। এবং মাতৃত্ব অথবা সেবা বা মনোরঞ্জন বা পুরুষের বিনোদন এইসব নানা পূর্বপরিকল্পিত ভূমিকায় লিপ্ত হতে হয়। কেন যে মেয়েদের শরীর তার ইচ্ছেমত যা খুশি করার নয়। কেন যে গরমের দিনে, ছেলেদের মতো মেয়েরা গা খুলে ঘুরে বেড়াতে পারে না সর্বসমক্ষে।
অ্যাটউড শেষে লিখেছেন, এ বইটিতে যেসব অত্যাচার বা মনোভাবের কথা আছে নারীদের বিষয়ে, সেগুলো তাঁর নিজ সমাজ, কানাডা বা আমেরিকার সমাজে অভাবনীয় বা প্রচণ্ড পশ্চাৎপদ বলে মনে হলেও, বস্তুত সেগুলো সারাক্ষণই পৃথিবীর অন্য নানা প্রান্তে ঘটে চলেছে। তিনি বলেছেন, আমার এ বইতে আমি একটা কথাও লিখিনি যা বাস্তবে কোথাও না কোথাও ঘটেনি। অথচ বইটিকে ডিসটোপিক ফ্যান্টাসির নাম দেওয়াই চলে!
অ্যাটউড যখন পড়ে পাওয়া, খেটে পাওয়া, লড়ে পাওয়া নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্র হিসেবে শরীরকে দেখার বিষয় নিয়ে দুঃস্বপ্নের জগৎ কল্পনা করেন, যেখানে মেয়েদের মুখ ঢাকা, চুল ঢাকা, সর্বশরীর দীর্ঘ গাউনে ঢাকা, সে দুঃস্বপ্ন আজও একটা ইরানে, একটা ভারতে, একটা পাকিস্তানে, একটা বাংলাদেশে কতটা জীবন্ত, ভেবে শিউড়ে উঠতে হয়।
কিন্তু মার্গারেট অ্যাটউড আজীবন চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে তাঁর লেখাগুলিকে ‘সায়েন্স ফিকশন’ বলে না গণ্য করা হয়। তাঁর বক্তব্য, সাই-ফাই হল ‘টকিং স্কুইডস ইন আউটার স্পেস’। মানে একটা মহাকাশযান দুটো কথা বলা এলিয়েন না হলে সাই-ফাই হয় না। অ্যাটউডের ফ্যানেরা এতে যারপরনাই অখুশি। গা শিরশিরিয়ে তোলা ভয়াবহ ডিস্টোপিয়া ‘‘হ্যান্ডমেড’স টেল’’-এর একটা ছায়াপাত আমরা সবাই আমাদের বর্তমানের পশ্চাৎমুখী, ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতার দায়ে মেয়েদের গৃহমুখী ও ঘোমটা হিজাবমুখী করার চাপিয়ে দেওয়া ফতোয়ার মধ্যে দেখতে পাই, অ্যাটউড সম্ভবত তাঁর এই লেখাকে রাখতে চেয়েছেন যে কোনও লেবেলিং-এর বাইরে। ২০০০ সালের আশপাশে কিছু মার্কিন কানাডিয়ান লেখক চেয়েছিলেন তাঁদের লেখালেখিকে ‘গড়পড়তা কল্পবিজ্ঞান’ বা ‘মান্ডেন এস এফ’-এর বাইরে রাখতে। ২০০৪-এ প্রকাশিত হয় তাঁদের ম্যানিফেস্টো। মহাকাশযাত্রা নয়, মঙ্গলগ্রহবাসী নয়, কিন্তু স্পেকুলেটিভ ফিকশন শব্দগুচ্ছকে তিনিও মেনে নিয়েছিলেন। বারবার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কল্পবিজ্ঞান লেখকরা এই নতুন ধারণার সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছেন। বারে বারেই নতুন চিন্তার আগুয়ান লেখকেরা চেয়েছেন স্পেকুলেটিভ ফিকশনের ছাতার ভেতরেই গুরুগম্ভীর সাই-ফাইকে আঁটিয়ে দিতে। যা মারভেল কমিক্সের মতো ট্রিভিয়াল বা পাল্প ফিকশনের দৈনন্দিন গল্পের গরু, থুড়ি গল্পের এলিয়েনকে গাছে ওঠানোর কাজটি করবে না। তার চেয়ে অনেক বিস্তৃতভাবে বীতংস ভয়াবহ বর্তমানকে ভবিষ্যতের আয়নায় প্রতিফলিত করবে।
২০০৯ সালে উরসুলা লেগুইন মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং অ্যাটউডের সাম্প্রতিক বই ‘দ্য ইয়ার অফ দ্য ফ্লাড’ নিয়ে লিখতে গিয়ে বললেন, অ্যাটউড সম্ভবত চান না সাহিত্যের গোঁড়া পণ্ডিতেরা তাঁকে কোনও ঘেটো বা বস্তিতে ঠেলে দিক, যার নাম কল্পবিজ্ঞান। লেবেল সাঁটাই বলো, বা তাকে তুলে রাখাই বলো, অ্যাটউড সাই-ফাইকে অপমানজনক সংজ্ঞা দিয়ে এলোপাথাড়ি সংকীর্ণ একটা অঞ্চলে পরিণত করে ফেলে, নিজেকে ওই বিপদ থেকে বাঁচাতে চান কেবল। বস্তুত তিনি যা লেখেন, বৃহত্তর অর্থে তা কল্পবিজ্ঞান বটেই। যেমনভাবে জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ একটি স্পেকুলেটিভ ফিকশন, যেখানে যন্ত্র আছে, নৃশংসতা আছে এবং আছে সমাজের ভবিষ্যৎ চিত্র নির্মাণও।
উরসুলা অ্যাটউডের হয়ে এক ধরনের সাফাই দিলেন, তবে এ কথা ভুল নয় যে একদা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এই অন্যায় নিদান দিয়েছিল যে, ‘সায়েন্স ফিকশন উইল নেভার বি লিটারেচার উইথ এ ক্যাপিটাল এল’।
শেষ বিচারে আমরা কী বলব? ‘‘হ্যান্ডমেইড’স টেল’’ হল ‘জঁর বেন্ডিং’ নভেল। মানে স্পেকুলেটিভ ফিকশন আর সায়েন্স ফিকশন-কে যদি দু’টি মহাদেশ বলা যায়, তাহলে মাঝামাঝি যে কোনও জায়গায় পড়বে এই কাহিনি। পড়বেই তো। যেখানে একটি সমাজ সক্ষম জরায়ুর কিন্তু নিজেদের আদর্শের থেকে তথাকথিতভাবে বিচ্যুত, ‘নষ্টা’ নারীকে ধরে ধরে একটি নামগোত্রহীন সন্তান উৎপাদক যন্ত্রে পরিণত করে, আর শ্রমিকদের রাষ্ট্রকে গুপ্তচরের মতো লোকের বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করতে উৎসাহ দেয়, পুরস্কার হিসেবে উপহার দেয় অপাপবিদ্ধ ভার্জিনকে স্ত্রী হিসেবে– সেই সমাজের গল্পকে কী করে বাইরে রাখব এই বিশিষ্ট জঁরের?
‘দ্য ডেভিল ইজ ইন দ্য ডিটেইল’ গল্পটি লিখতে অ্যাটউড ব্যবহার করেছেন যন্ত্রকে (হঠাৎ একদিন মেয়েদের সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয় গিলিয়াডে, একদিন হঠাৎ তাদের ক্রেডিট কার্ড আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না, সিস্টেম থেকে মেয়েদের টাকাকে কেবল তাদের স্বামীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, স্বামীর সম্মতি ছাড়া সে কোনও টাকাকড়ির আদানপ্রদান করতে পারবে না বলে ) যানবাহনকে, বন্দুক, শাস্তিব্যবস্থা, ফাঁসির মঞ্চকেও। এই পরিমাণ সূক্ষ্ম ডিটেইলের কাজই তো একজন কল্পবিজ্ঞান লেখকের।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই