দেবতা ভাবতে শুরু করলেন মনই কি আত্মা। কিন্তু মনের বৃত্তি যে পরিবর্তনশীল। সুতরাং তা কখনও আত্মা হতে পারে না। আবার গুরুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। গুরু বললেন, তুমি নিজে খুঁজে বের কর। দেবতা ফিরে গেলেন। সত্য জানার জন্য তাঁর অন্তর ব্যাকুল হল। কিছুদিন পরে তাঁর মধ্যে জ্ঞানের উদয় হল। তিনি বুঝলেন যে, তিনি সমস্ত বৃত্তির অতীত আত্মা। তাঁর জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। কোনও কিছুই একে বিনাশ করতে পারে না। আত্মা শরীর, মনের অতীত। এই জ্ঞান লাভ করে দেবতা আনন্দে পূর্ণ হলেন।
আত্মজিজ্ঞাসু হয়ে এক দেবতা ও এক অসুর– দু’জনেই গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন এক জ্ঞানীর কাছে। তাঁরা সেই মহাপুরুষের কাছে অনেক দিন বাস করে শিক্ষালাভ করলেন। মহাপুরুষ একদিন তাঁদেরকে বললেন, তোমরা যাঁকে খুঁজছ, তোমরাই সেই পুরুষ। তাঁরা ভাবল, তাঁদের দেহই আত্মা।
সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেল। আত্মীয়স্বজনের কাছে বলল, আমরা সব শিখে এসেছি। আমরাই সেই আত্মা, এছাড়া আর কিছু নেই। চল আমরা পান, ভোজন করি, আনন্দে মত্ত হই।
অসুর ছিল অজ্ঞানের অন্ধকারে, তাঁর মনে কোনও প্রশ্ন উঠেনি। নিজের দেহকে আত্মা ভেবে সে সন্তুষ্ট চিত্তে দিন কাটাতে লাগল। দেবতাটি ছিল শুদ্ধ স্বভাবের। সে ভ্রমে পড়ে কিছুদিন এই শরীরকেই ব্রহ্ম ভেবেছিল। তার যত্ন নিতে হবে, সুস্থ রাখতে হবে। সমস্ত প্রকার দৈহিক সুখের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন পরে তাঁর মনে হল যে, গুরুদেবের কথার অন্য কিছু অর্থ রয়েছে। তিনি গুরুদেবের কাছে গেলেন।
গুরুদেবকে বললেন, আপনি বললেন, এই দেহই আত্মা। কিন্তু দেহ তো কিছুদিন পর নষ্ট হয়ে যাবে। আত্মার তো কখনও বিনাশ হবে না। গুরু উত্তরে বললেন, তুমি নিজে এর অর্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করো; তুমিই সেই আত্মা। দেবতা ভাবলেন, হয়তো শরীরের ভেতরের প্রাণই আত্মা। কিন্তু দেখলেন, আহার করলে প্রাণ তাজা থাকে, আও উপোসী হলে প্রাণ দুর্বল হয়। তিনি আবার গুরুর কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন যে, তিনি প্রাণকেই আত্মা বলেছেন কি না। এবারও আচার্য বললেন তুমিই সেই, তুমি নিজে এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করো।
দেবতা ফিরে এসে আবার ভাবতে শুরু করলেন তাহলে মনই কি আত্মা। কিন্তু মনের বৃত্তি যে পরিবর্তনশীল। সুতরাং তা কখনও আত্মা হতে পারে না। আবার গুরুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। গুরু বললেন, তুমি নিজে খুঁজে বের কর। দেবতা ফিরে গেলেন। সত্য জানার জন্য তাঁর অন্তর ব্যাকুল হল। কিছুদিন পরে তাঁর মধ্যে জ্ঞানের উদয় হল। তিনি বুঝলেন যে, তিনি সমস্ত বৃত্তির অতীত আত্মা। তাঁর জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। কোনও কিছুই একে বিনাশ করতে পারে না। আত্মা শরীর, মনের অতীত। এই জ্ঞান লাভ করে দেবতা আনন্দে পূর্ণ হলেন। অত্যন্ত দেহাসক্তি থাকায় অসুর বেচারার অবস্থা একই থেকে গেল। স্বামী বিবেকানন্দ ‘ছান্দোগ্য উপনিষদ’-এর এই কাহিনি সরল কথায় বলেছেন তাঁর ‘রাজযোগ’-এর আলোচনায়। এই জগতে দেবতা ও অসুর দুই প্রকৃতির লোকই আছে।
এক মুহূর্তের জন্যও শরীরের পরিবর্তন কেউ আটকাতে পারে না। অনেকটা নদীর মতো, প্রতি মুহূর্তে নতুন জলরাশি এলেও, দেখতে ঠিক আগের মতো। আমাদের শরীরও সেইরকম। তবে আমরা দেহসর্বস্ব নই, আমরা স্বরূপত আত্মা, তা জেনেও শরীরের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। কারণ শরীরই আমাদের শ্রেষ্ঠ যন্ত্র। এই শরীরকে আশ্রয় করেই আমাদের জ্ঞান লাভ করতে হবে। মানুষই আত্মজ্ঞান লাভের অধিকারী। তাই মনুষ্য জন্ম শ্রেষ্ঠ জন্ম, মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব।