নবাবি খানসামারা যখন নবাবি রসুইখানা ছেড়ে সাহেবের কিচেনে এসে ঢুকল, ভোজন-প্রিয় বাঙালি ঘেঁটে গেল। শুনল যে, ফালি করে কাটার ইংরেজি নাম ‘চপ’, তাই সাহেবরা ফালি করে কাটা মাংসের পদকে ‘চপ’ নাম দিয়েছে। শহরবাসী নোলায় জল নিয়ে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু সাহস করে এগোতে পারে না।
মোঘলরা ভারতে এসে রাজত্ব শুরু করলে তাদের খাবারের খুশবু যেমন দিল্লি আর পাঞ্জাব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার খাবারের ওপরে প্রভাব বিস্তার করেছিল, সাহেবদের তৈরি শহর কলকাতায় সাহেবদের খাবারের প্রভাব তাই সেই জন্মকাল থেকেই পড়েছিল। বিলেত থেকে সাহেবরা এসে লন্ডনে ফেলে আসা চপ-কাটলেট এখানে বানিয়ে খেতে শুরু করলে বাঙালি প্রথমে বিশেষ পাত্তা দেয়নি, এটা সাহেবদের হেঁশেলের ব্যাপার বলে। কিন্তু যখন নবাবি খানসামারা হাওয়া-বদলের আভাস পেয়ে যখন নবাবি রসুইখানা ছেড়ে সাহেবের কিচেনে এসে ঢুকল, ভোজন-প্রিয় বাঙালি ঘেঁটে গেল, কারণ তখন আর ব্যাপারটা শুধু সাহেবি কিচেনের মধ্যে থাকল না। যারা এই রান্না রেঁধে খাওয়াচ্ছে, তাদের হাতযশে এই রান্নার সুবাস শহরে ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই খানসামারা এই শহরের বিভিন্ন কোণে বাসা বাঁধল আর শহরের বড়লোকদের দেওয়া ‘পার্টি’-তে রান্নার দাওয়াত পেতে লাগল। তাদের কাছে শুনল যে, ফালি করে কাটার ইংরেজি নাম ‘চপ’, তাই সাহেবরা ফালি করে কাটা মাংসের পদকে ‘চপ’ নাম দিয়েছে। শহরবাসী নোলায় জল নিয়ে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু সাহস করে এগোতে পারে না, কারণ যতই তারা সর্বভুক হোক, এই খাবারগুলো ভেড়া, শুয়োর, মুরগির মতো বিধর্মী জিনিস দিয়ে তৈরি, যা খাওয়া নিয়ে ভাবা অবধি এক অসৈরন ব্যাপার।
আরও পড়ুন: বাঙালি তেলে ভাজবে না ঘি-এ ভাজবে?
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। যারা মোটামুটি একই রকম দেখতে, ভারতীয় ভাষায় দিব্যি কথা বলতে পারে– তারাও যখন মটন চপ খেতে শুরু করেছে, বাঙালি গৃহস্থ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ চুষে চলবে এটা মেনে নেওয়াটা বেশ কষ্টকর ছিল। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা আবার শুধু মটন চপ, ব্রেস্ড কাটলেট খাচ্ছে না, নিজেদের দিশি জিভকে আরও আনন্দ দিতে কিমার সঙ্গে দিশি ধনেপাতা মাখছে আর পাউরুটির গুঁড়ো মাখিয়ে ভাজছে– যে পাউরুটি অবধি সনাতন হিন্দু হেঁশেলে ঢোকা নিষিদ্ধ! চাহিদাই চিরকাল উদ্ভাবনের কারণ থেকেছে– এখানেও অন্যথা হল না। বাঙালি বিভিন্ন পরীক্ষা করে আবিষ্কার করে ফেলল, আলু চটকে তাতে একটু মশলা মিশিয়ে বেসনের লেইতে ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজলে দিব্যি একটা চপের মতো জিনিস তৈরি হয়, যা খেতেও খুব সরেস। নামটা ‘আলুর চপ’ থাকলেই বা ক্ষতি কী!
এতে মজা পেয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত সবজিবাজার এনে উজাড় করল রান্নাঘরের উনুনের সামনে। পেঁয়াজ দিয়ে পেঁয়াজি, বেগুনের ফালি বেসনে ডুবিয়ে তোলা উনুনে ভেজে তৈরি হল বেগুনি, যত্ন করে মোচা কুচিয়ে তাই থেকে বানাল মোচার চপ– একে একে ফুলকপির বড়া থেকে হিঞ্চে শাকের চপ, পাঁচমিশালি সবজি দিয়ে ভেজিটেবিল চপ– কিছুই বাদ দিল না। এতরকমের চপ যে বানাল, সব কি আর চপের মতো দেখতে? দেখায় কী এসে যায়– খেতে ভাল লাগলেই হল– নিজেদের নামে ‘চপ’ শব্দটার পাশে ‘তেলেভাজা’ শব্দটা বসিয়ে নিলেই নিপাতনে সিদ্ধ! চপ-তেলেভাজার দোকান ছড়িয়ে পড়ল কলকাতার কোণে কোণে আর সেখান থেকে বাংলার কোণে কোণে।
সাহেবদের চপের সঙ্গে একটাই পার্থক্য থেকে গেল– সাহেবরা চপ, কাটলেট খায় লাঞ্চ বা ডিনারে, কিন্তু বাঙালি চপ-তেলেভাজা দিনের শুরুতে বা দিনের শেষে। দুপুরে চাড্ডি ভাত না খেলে বাঙালি পেটের প্রতি অবিচার করা হবে। অবশ্য ভাতের সঙ্গে ভাজা খাওয়ার দস্তর তো আজকের নয়, ৫০০ বছর আগে লেখা কবিকঙ্কন মুকুন্দের লেখায় আমিষ নিরামিষ মিলিয়ে ২৫-৩০ কিসিমের ভাজার উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুন: হাজার বছর পার করেও বাসি হয়নি শিঙাড়ার যাত্রা
বাঙালির পাতে মিষ্টি যদি সিনেমা হয়, গৃহস্থের হেঁশেলের বা পাড়ার মোড়ের দোকানের চপ-তেলেভাজা হচ্ছে টিভি সিরিয়াল। মিষ্টির জগতে যতই উত্তম-সৌমিত্র-অমিতাভ-ধর্মেন্দ্র, সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-মাধুরী-হেমা থেকে শুরু করে শাহরুখ-আমির-দেব-জিৎ সবাই আছে তাদের ফ্যানক্লাব সহ, চপ-তেলেভাজা কিন্তু একেবারে বাঙালির শোয়ার ঘর অবধি পৌঁছে গিয়েছে। মেঘলা দিনে বালিশে হেলান দিয়ে টিভি দেখতে দেখতে কোনও নাম না জানা অভিনেতার কেরামতি দেখে বাটি থেকে এক মুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে পেঁয়াজিটা আলগোছে তুলে একটা কামড় দিয়ে ‘বাঃ!’ শব্দটা যখন মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, সেটা সেই নাম-না-জানা অভিনেতার অভিনয়-নৈপুণ্যকে তারিফ করে, না, নাম-না-জানা চপের দোকানের রন্ধন-নৈপুণ্যকে তারিফ করে, সেটা বলা মুশকিল হয়ে যায়।