শ্যামাসুন্দরী দেবী মায়ের কাছে পূজার জন্য কিছু চাইলে মা বললেন, ‘অত ল্যাঠা আমি পারব না। একবার পূজা হল, আবার ল্যাঠা কেন? দরকার নেই, ও পারব না।’ অবাক কাণ্ড! সেই রাতে মা সারদা স্বপ্ন দেখলেন– মা জগদ্ধাত্রী জয়া ও বিজয়া-সহ উপস্থিত। তাঁরা মা সারদাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁরা চলে যাবেন কি না। মা ভয় পেয়ে বললেন, ‘না, তোমরা কোথা যাবে? না, না, তোমরা কোথা যাবে? তোমরা থাকো, তোমাদের যেতে বলিনি।’ সেই থেকে প্রতি বছর জগদ্ধাত্রী পূজা চলতে থাকে। জগদ্ধাত্রীর দুই পাশে জয়া ও বিজয়ার মূর্তি থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, জগদ্ধাত্রীরূপের মানে যিনি জগৎ ধারণ করে আছেন। তিনি ধারণ না করলে জগৎ স্থিত থাকে না। এই পরিবর্তনশীল জগৎকে কোনও এক মহাশক্তি ধারণ করে রয়েছে। মা জগদ্ধাত্রী সেই ধারণকারিণী মহাশক্তি। কথিত রয়েছে, নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই পূজার প্রচলন করেন। তিনি একবার নৌকা করে মুর্শিদাবাদ থেকে নদীয়ায় আসছিলেন। নৌকাতে থাকা অবস্থাতেই বুঝতে পারেন সেদিন বিজয়া দশমী। সে বছর দুর্গাপূজা করতে পারেননি বলে দুঃখে কাতর হলেন। দেবী দুর্গা তাঁকে জগদ্ধাত্রী মূর্তিতে দেখা দিয়ে একমাস পরে তাঁর পূজা করতে বলেন। কার্তিক মাসের শুক্লা পক্ষ্মের নবমী তিথিতে এই পূজা হয়।
মা সারদার জীবনের সঙ্গে জগদ্ধাত্রী পূজার সম্পর্ক বহুকালের। ১২৮৪ সালের কথা। জয়রামবাটীর গ্রামে কালীপূজার সময় নব মুখুজ্যে আড়াআড়ি করে সারদা মায়ের মা শ্যামাসুন্দরী দেবীর জমানো পূজার চাল ইত্যাদি নিলেন না। তিনি সারারাত কাঁদেন যে, মা কালীর জন্য জমানো চাল তো অন্য কেউ খেতে পারবে না! সে রাতে স্বপ্নে দেখলেন রক্তবর্ণের এক দেবী দুয়ারে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে আছেন। তিনি বললেন, ‘তুমি কাঁদচ কেন? কালীর চাল আমি খাব, তোমার ভাবনা কী?’ দেবী মূর্তিকে জিজ্ঞেস করলেন , ‘তুমি কে?’ উত্তর এল, ‘আমি জগদম্বা, জগদ্ধাত্রীরূপে তোমার পূজা গ্রহণ করব।’ শ্যামসুন্দরী দেবী কিছু বুঝতে না পেরে পরদিন সারদা মা-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লাল রং, পায়ের উপর পা দিয়ে– ও কী ঠাকুর?’ মা জগদ্ধাত্রীর দেবীর কথা বললেন।
শ্যামাদেবী শুনে পুজোর আয়োজন শুরু করলেন। সময় অল্প। বিশ্বাসদের কাছে থেকে পাঁচ মনের মতো ধান আনা হল। কিন্তু তখন অবিরাম বৃষ্টি চলছে। কিন্তু মা জগদ্ধাত্রীর কৃপায় এমন হল যে চারিদিকে বৃষ্টি, কিন্তু শ্যামাসুন্দরী দেবীর চাটাইয়ে রোদ। আগুন জ্বেলে প্রতিমা শুকিয়ে সেবার রং করা হয়েছিল। প্রসন্নকুমার সেবার দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে সংবাদ দিয়ে তাঁকে আসতে অনুরোধ করলেন। তিনি শুনে খুশি হয়ে বললেন, ‘মা আসবেন, মা আসবেন– বেশ বেশ, তোদের বড় খারাপ অবস্থা ছিল যে রে?’ শ্রীরামকৃষ্ণদেব আসতে পারেননি। আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘এই আমার যাওয়া হল, যা, বেশ পুজো করগে। বেশ বেশ, তোদের ভাল হবে।’ সেই থেকে শুরু হল জগদ্ধাত্রী পূজা। গ্রামসুদ্ধ লোক প্রসাদ পেয়েছিলেন। বিসর্জনের দিন বিজয়ার দিন শ্যামাসুন্দরীদেবী জগদ্ধাত্রীর কানে কানে বললেন: ‘মা জগাই, আবার আসছে বছর এসো। আমি তোমার জন্য সারা বছর ধরে সব জোগাড় করে রাখব।’
প্রথমবার পুজোর দিন বুধবার হওয়ায় বিধিমতো বিসর্জন পরের দিন বৃহস্পতিবার হওয়ার কথা। মা সারদা আপত্তি জানালেন, বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীবারে মাকে বিদায় দেওয়া চলে না। পরদিন আবার সংক্রান্তি এবং তৃতীয় মাস-পয়লা। বিসর্জন হল না। বিসর্জন হয়েছিল চতুর্থ দিন রবিবারে।
পরের বছর শ্যামাসুন্দরী দেবী মায়ের কাছে পূজার জন্য কিছু চাইলে মা বললেন, ‘অত ল্যাঠা আমি পারব না। একবার পূজা হল, আবার ল্যাঠা কেন? দরকার নেই, ও পারব না।’ অবাক কাণ্ড! সেই রাতে মা সারদা স্বপ্ন দেখলেন– মা জগদ্ধাত্রী জয়া ও বিজয়া-সহ উপস্থিত। তাঁরা মা সারদাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁরা চলে যাবেন কি না। মা ভয় পেয়ে বললেন, ‘না, তোমরা কোথা যাবে? না, না, তোমরা কোথা যাবে? তোমরা থাকো, তোমাদের যেতে বলিনি।’ সেই থেকে প্রতি বছর জগদ্ধাত্রী পূজা চলতে থাকে। জগদ্ধাত্রীর দুই পাশে জয়া ও বিজয়ার মূর্তি থাকে।
একবারের ঘটনা। জগদ্ধাত্রী পূজার সময় হলদে হলদে পুকুরের রামহৃদয় ঘোষাল এসে উপস্থিত হলেন। মা সারদা তখন জগদ্ধাত্রীর সামনে বসে ধ্যান করছেন। তিনি অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না, কে মা সারদা, আর কে জগদ্ধাত্রী। ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।