ফাঁকা জার নিয়ে নিজের রুমে ফিরতে ফিরতে অনিমেষ ভাবে, গারবেজ ম্যানেজমেন্টের মতো ধোঁয়ারও একটা ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। আগে নাকি গারবেজও এভাবেই ফেলতে হত। সে সব গিয়ে জমা হত ধাপার মাঠে। তার আবার পচনশীল, অপচনশীল ভাগ করারও ব্যাপার ছিল। পুরনো সেই দিনের কথা তাকে অবাক করে। গারবেজ রিসাইকল মেশিনই নাকি তখন ছিল না, ঘরে ঘরে থাকা তো দূরের কথা। এক সময় নাকি ওয়াশিং মেশিনও ছিল না, কাপচোপড় সব হাতেই কাচতে হত; তাজ্জব ব্যাপার!
হুইসেলটা তীক্ষ্ণ গলায় কেঁদে উঠতেই ধাঁ করে ঘুম ভাঙল অনিমেষের। কাল শুতে রাত হয়েছিল; তবে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল, সকালের হুইসেলটা মিস করলে চলবে না, ধোঁয়া তাকে ফেলতেই হবে। গত দু’দিন আলসেমির চোটে মনে হয়েছে বাঁশি শুনে আর কাজ নেই। তাতে যে পরিমাণ ধোঁয়া জমেছে কাচের বাকেটে যে আর রিস্ক নেওয়া চলে না। কর্পোরেশন থেকে এখন বাড়ি বাড়ি স্মোকোমিটার বসিয়ে গেছে। এক তো বাড়ির ধোঁয়া বাইরে বেরনো মানা। সবটুকু ধোঁয়া পাইপ দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে এসে জমা হয় এই কাচের জারে। তবে যেটুকু ধোঁয়া আটকানো যায় না, তারও মাপ আছে। স্মোকোমিটার অহরহ তা মাপতে থাকে। তার উপর বাই এনি চান্স এখন যদি কাচের জার উপচে খানিক ধোঁয়া চুঁইয়ে বেরিয়ে আসে তাহলে তো চিত্তির! রেড অ্যালার্ট খেয়ে যাবে অনিমেষের বাড়ি, তার দরুন মোটা ফাইন। আগে তবু কর্পোরেশনে লোকজন ছিল, যাদের বুঝিয়ে বললে কিংবা টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করা যেত। এখন সবই এইআই অ্যাসিস্ট্যান্ট। মানুষই নেই তো মানুষের আলসেমির মূল্য দেবে কে! এই আক্রার বাজারে আর ফালতু টাকা গচ্চা দিতে চায় না অনিমেষ। ধোঁয়ার জার নিয়ে সে নিচে নামে। প্রায় প্রত্যেকেই নাম এ সময়। হুইসেল বাজানো নীলকণ্ঠ গাড়ি এসে এক এক করে শুষে নেয় জারের ধোঁয়া-বিষ।
ফাঁকা জার নিয়ে নিজের রুমে ফিরতে ফিরতে অনিমেষ ভাবে, গারবেজ ম্যানেজমেন্টের মতো ধোঁয়ারও একটা ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। আগে নাকি গারবেজও এভাবেই ফেলতে হত। সে সব গিয়ে জমা হত ধাপার মাঠে। তার আবার পচনশীল, অপচনশীল ভাগ করারও ব্যাপার ছিল। পুরনো সেই দিনের কথা তাকে অবাক করে। গারবেজ রিসাইকল মেশিনই নাকি তখন ছিল না, ঘরে ঘরে থাকা তো দূরের কথা। এক সময় নাকি ওয়াশিং মেশিনও ছিল না, কাপচোপড় সব হাতেই কাচতে হত; তাজ্জব ব্যাপার! ধোঁয়ার জন্যও এরকম একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে রোজ রোজ এই হুইসেলের কান্নায় ঘুম ভেঙে উঠতে ইচ্ছে করে না। ঘরে ঢুকে ফাঁকা জারটা পাইপের মুখে ফিট্ করতে করতে একটা কথা মনে পড়ে অনিমেষের, আর তার হাসিই পায়। এক সময় নাকি ধোঁয়া সমৃদ্ধির চিহ্ন হিসাবে দেখা হত। কোন একজন অভিনেত্রী নাকি প্রথমবার নেত্রী হয়ে উন্নয়নের খতিয়ান দিতে গিয়ে বলেছিলেন, চারিদিকে ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া…! অর্থাৎ সরকার বহু কলকারখানা করেছে। আর তাই শুনে সকলেই খুব হাসাহাসি করেছিল। কেননা শিল্প নাকি যত হওয়ার কথা ছিল, তত হয়নি। সবাই মশকরা করে বলেছিল, উন্নয়নই ধোঁয়া হয়ে গিয়েছে। হায় ভারী শিল্প! ভারি তো শিল্প! অতীতের এই গল্প অনিমেষ শোনে ‘দ্য নস্টালজিয়া’ পডকাস্টে। খুব কাজের জিনিস কিছু না। গপ্পসপ্প, তবে শুনতে ভালোই লাগে, বেশ এন্টারটেইনিং। ওই পডকাস্টেই সে শুনেছে, একসময় করোনা প্যান্ডেমিক এসেছিল আর মানুষকে মাস্ক পরতে বলেছিল, অনেকেই নাকি বিরক্ত হচ্ছিল। মাস্ক খুলে নাকি চা দোকানে চলে যেত আর বলত, খাব না আমরা চা, আমরা কি চা খাব না? তখন জোর করে, ফাইনের ভয় দেখিয়ে মাস্ক পরাতে হচ্ছিল মানুষকে। আর এখন? বাইরে বেরোলেই অক্সিজেন সাপোর্ট মাস্ক তো মাস্ট। কতদিন যে রাস্তায় চেনা কারও মুখ দেখেনি অনিমেষ!
…………………………………………………………………………………
অবশ্য ধোঁয়া নিয়ে এখন যে বাড়াবাড়িটা হচ্ছে, তা আটকানো গেলেও যেতে পারত। অনিমেষের তখন জন্মই হয়নি, সেই ২০২২ সাল নাগাদ WHO বলে দিয়েছিল যে, বছর তিনেক ধরেই বিশ্বের অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ যে বাতাসে শ্বাস নেন, তাকে অন্তত তাঁরা শ্বাস নেওয়ার মতো শুদ্ধ বাতাস বলতে পারছেন না। তাঁদের গাইডলাইন বাতাস মানতে পারছে না তা নয়, মানুষই বাতাসকে সেভাবে থাকতে দিচ্ছে না। অ্যানথ্রোপোজেনিক উৎস থেকে যে ধোঁয়া বাতাসে মিশছে, অর্থাৎ মানুষের যা স্বখাতসলিল, তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই কথা বলা শুরু হয়েছিল।
………………………………………………………………………………….
অবশ্য ধোঁয়া নিয়ে এখন যে বাড়াবাড়িটা হচ্ছে, তা আটকানো গেলেও যেতে পারত। অনিমেষের তখন জন্মই হয়নি, সেই ২০২২ সাল নাগাদ WHO বলে দিয়েছিল যে, বছর তিনেক ধরেই বিশ্বের অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ যে বাতাসে শ্বাস নেন, তাকে অন্তত তাঁরা শ্বাস নেওয়ার মতো শুদ্ধ বাতাস বলতে পারছেন না। তাঁদের গাইডলাইন বাতাস মানতে পারছে না তা নয়, মানুষই বাতাসকে সেভাবে থাকতে দিচ্ছে না। অ্যানথ্রোপোজেনিক উৎস থেকে যে ধোঁয়া বাতাসে মিশছে, অর্থাৎ মানুষের যা স্বখাতসলিল, তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই কথা বলা শুরু হয়েছিল। ঘরে আর বাইরে বাতাসের বিষ মিশিয়ে ফেলার দৌলতে অন্তত ৬.৭ মিলিয়ন মানুষের কাছে যমদূত সময়ের অনেক আগেই এসে হাজির হচ্ছিল। আর সহজেই অনুমেয় যে, সেই মৃত্যুমিছিল মূলত গরিব আর মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলিতেই। অ্যারোসলস বা পার্টিকল পলিউশন নিয়েও তখন বিস্তর আলোচনা। এক শত্তুরের নাম PM10, অন্যের নাম PM2.5। ফ্যাক্টরি, পাওয়ার প্ল্যান্ট, যানবাহনের দৌলতে এরা মিশে যাচ্ছিল বাতাসে। নামের পাশে সংখ্যা দু’টি এদের ডায়ামিটার বুঝিয়ে দেয়। মানুষের মাথার একগাছা চুলের ডায়ামিটার যদি হয় ৫০-৭০ মাইক্রন, তাহলে বোঝাই যায় এরা কতখানি খুদেস্য খুদে। সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা এক কণা বালির থেকেও ছোট। কিন্তু শক্তি? সোজা ঢুকে পড়তে পারে ফুসফুসে এমনকী, রক্তজালিকাতেও। অতএব ভয় পাওয়ার বিষয়ই বটে।
পরিবেশের বদল নিয়ে তখনই অশনিসংকেত। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জায়গা প্রায় তার চরিত্র বদলে ফেলছিল। যেখানে গ্রীষ্মের বরফ গলার কথা সেখানে বরফ জমছে, যেখানে বরফ জমার কথা সেখানে বিশ্ব উষ্ণায়নের দরুন বরফ গলছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। তারও অভিঘাত সবথেকে বেশি এসে পড়ে গরিব দেশগুলিতে। প্রকৃতির রোষে গরিব মানুষ এক লহমায় সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। দোষ তাঁদের নয়। তবে, প্রকৃতি তো আর জানে না যে, কার দোষে সে রুষ্ট হল। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ক্রমাগত তাকে উত্ত্যক্ত করে তুললে একদিন সে ফুঁসে ওঠে। আর সে ধকল সইতে হয় বিশ্বের গরিবদের। এতে আবার রাজনীতির সুবিধা হয়। মানুষ যত গরিব, যত অসহায়, তত ধর্ম আর এথনিসিটির বড়ি গিলিয়ে তার উপর আধিপত্য ফলানো যায়। এই ফরমুলায় দক্ষিণপন্থীদের তখন রমরমা গোটা বিশ্বেই। আমাজন পর্যন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল নির্বিচারে। বুক বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বোলসনারো। পরের ভোটে সেই সরকারকে অবশ্য মানুষ সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে তো পরের কথা। ততক্ষণে পরিবেশের যা বারোটা বাজার তা তো বেজেই গেল। ২০২৩-এ বিশ্বের নেতারা দুবাইয়ে বসে আলোচনা করেছিলেন, কার্বন নিঃসরণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ে চিন্তাভাবনা তখন কুলীন ফ্যাশন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও গিয়েছিলেন সেই সমাবেশে। পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে মোকাবিলায় অর্থ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে তাঁর বক্তব্য মহা গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছিল সর্বত্র। সে বছরই ভারত সরকার একটি বিল পাশ করায়, যেখানে লিথিয়াম-সহ অন্তত ছ’টি পারমাণবিক খনিজ সন্ধানে প্রাইভেট সেক্টরকে অনুমতি দেওয়া হয়। বিলটি সংশোধনীর আগে পর্যন্ত এ-কাজ শুধু ছিল সরকারি মালিকানাধীন সংস্থার। রাজ্যসভায় সে-বিল পাশ হয়েছিল ধ্বনিভোটে, কেননা বিরোধীরা তখন মণিপুর হিংসা নিয়ে আলোচনা চাইছিলেন। সেই হট্টগোলের ভিতরই চুপিচুপি গুরুত্বপূর্ণ খনিজের দখল চলে যায় বেসরকারি হাতে। পরিবেশ নিয়ে বিশ্বমঞ্চে ভাবনা আর সেই পরিবেশের উপরই সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে তা পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া কি সাযুজ্যপূর্ণ? অনিমেষ শুনেছে, তখন দেশে একটা মন্দির নিয়ে এত তুলকালাম চলছিল যে, এসব ভাবনা চাপা পড়ে যায়।
পুরনো সে সব কাসুন্দি! আজ এত বছর পরে ঘেঁটে কোনও লাভ নেই। মানুষের পক্ষের যে-কোনও ভাবনাকেই তখন প্রান্তিক করে দেওয়া হচ্ছে; পরিবেশচিন্তাও তার ব্যতিক্রম নয়। কেউ যে ভাবেননি, তা নয়; কিন্তু তাঁদের কথা শুনবে কে? দেশের বেড়া দিয়ে তো আর পরিবেশকে আটকে ফেলা যায় না। এদিকে বিশ্বায়নের রংবেলুন যে অতিরিক্ত উৎপাদনের কল তৈরি করেছিল, তাতে জ্বালানি জুগিয়ে যাচ্ছিল মানুষই। মানুষের লোভ, মানুষে অতিরিক্ত অধিকারের প্রবৃত্তি। এর প্রতিরোধ ছিল আসক্তিহীন, ন্যূনতম যাপন, সংযমে। মানুষ প্রলোভন অস্বীকার করতে পারেনি। যাঁরা মানুষকে সে বিষয়ে সচেতন করতে চেয়েছে, তাঁদের অন্যপন্থী কিংবা দেশদ্রোহী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনিমেষের ইতিহাসজ্ঞান খুব প্রখর এমন নয়; তবে যেটুকু সে জানে, তাতে বুঝতে পারে দক্ষিণপন্থীরা চিরকাল ক্ষমতায় থেকে যায়, তা নয়; তবে তারা পুঁজির খাতিরে প্রকৃতির উপর এত চোটপাট করে যায়, এত গভীর ক্ষতের জন্ম দেয়, যে, জীবন দিয়ে তার দাম দিতে হয় উত্তরকালের মানুষকে। যেমন অনিমেষকে। গাছ আজকে আর কোথায়! এককালে নাকি জল কিনতে হত বলে মানুষ বিরক্ত হত, আর এখন অক্সিজেন না কিনে উপায় নেই। নেতারা এসে ভোটের সময় বিনামূল্যে অক্সিজেন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, অক্সিজেনের মূল্যে ভরতুকির কথা বলে। মানুষ ওদের আর বিশ্বাস করে না। অনিমেষ তো করেই না। কেন কে জানে যারা এভাবে বাতাস বিষিয়েছে অনিমেষ তাদের ক্ষমা করতে পারে না।
শুধু নেতারাই নয়, সেই সময়কার মানুষ! তারা কি আর একটু সচেতন হতে পারত না! রোজা লুক্সেমবার্গ যেমন জেলে বসেই ভাবছিলেন, কেন জার্মানি থেকে গান গাওয়া পাখিগুলো সব হারিয়ে যাচ্ছে? পাখিরা যে আর মানুষের জন্য গান গাইবে না, শুধু সেটুকুর জন্যই তাঁর কষ্ট নয়। তিনি কেঁদেছিলেন এই ভেবে যে, প্রতিরোধহীন অসহায় একটি ছোট্ট প্রাণী কেমন নীরবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে সেই ভেবে। অনিমেষ ভাবে, তখনকার মানুষও যদি একটু ভাবত যে, কেমন মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, তাহলে আর অনিমেষদের এমন মুখ-ঢাকা অবস্থায় দিন কাটাতে হত না। মাটির পেটের ভিতর বিছিয়ে রাখা জালের রাস্তায় তাদের চলাচল করতে হত না। মাটিরের উপর দিয়েও হতে পারত তাদের যাতায়াত। অনিমেষের তো ভাবতে বেশ ভালো লাগে, পুরনো বাসের যে ছবি সে দেখেছে, তারই কোনও একটার উইন্ডো শিটে বসে চলেছে সে। খোলা রাস্তা। দু’পাশে গাছ দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট। জানলা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস এসে বিলি কাটছে তার চুলে। আর হঠাৎ আচমকাই সে মুখ বের করে দিয়েছে সেই একচিলতে জানলা দিয়ে বাইরে, তাকিয়েছে যত দূর চোখ যায়, অনন্তে, আকাশে…
বহুদিন হয়ে গেল, ধোঁয়ার পুরু চাদর পেরিয়ে অনিমেষ আর আকাশ দেখতে পায় না। তবু আকাশকুসুম ভাবতে তার ভালই লাগে।
অশোক ঘোষ মনে করতেন, ট্রাম আন্দোলন কলকাতার হকারদের একটি রাজনৈতিক চেতনা জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কেরানি, হকার, আর উদ্বাস্তুদের লড়াই। আর ট্রাম-ডিপো মানেই হকার। এইসব দোকানেই আন্দোলনকারীদের আড্ডা বসত। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের কথা আলোচনা হত। সকালে হয়তো কোনও এক চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়ে খবরের কাগজ পড়া হত।