‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনে মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে। জোড়াবাগান থানার পুলিশের একটি দল মলয়কে কোমরে দড়ি বেঁধে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে গ্রেপ্তার করে আনে, ধারা ছিল ১২০বি, ১৯২ ভারতীয় দণ্ডবিধিতে। একই অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ ঘোষ, এবং মলয়ের দাদা সমীর। মামলাকারী রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন।
‘গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন। টেবিলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেকসে কলম ডুবিয়ে কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে। এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের স্বতঃস্ফুর্তিতে। অর্থব্যঞ্জনা ঘন হোক অথবা ধ্বনি পারস্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ও ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে।’
চমকে উঠবেন না মাননীয় পাঠক, উল্লিখিত লাইনক’টি একটি হাংরি জেনারেশনের বুলেটিনের সামান্য অংশ। যার জনক এই দেশের অন্যতম চিন্তাবিদ মলয় রায়চৌধুরী। আজ, ২৬ অক্টোবর সকালে প্রয়াত হয়েছেন, মুম্বইয়ে কান্দিভেলিতে। শেষ জীবনের আগে চাকরি করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কে, অবসর নিয়েছিলেন চিফ জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে। দক্ষিণ কলকাতার বরিষা বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে জন্ম, স্ত্রী সলিলা বিদর্ভের মহিলা হকি দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। যাঁর সপ্তম পূর্বপুরুষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মাত্র ১৩৫০ টাকায় কালীঘাট থেকে দক্ষিণেশ্বর গঙ্গাতীরস্থ জমি বিক্রি করেছিলেন। মলয়ের বাবা ছিলেন ফোটোগ্রাফার, দুই ভাই– সমীর বড়, মলয় ছোট। মলয়রা তখন বিহারের পাটনার পাশে থাকতেন, সমীর চাইবাসায় ছিলেন ফিসারিজ-এর অফিসার। বন্ধু সুনীল-শক্তির নিয়মিত যাতায়াত ছিল ওখানে। বিহারে থেকে, একটা কিছু বাংলা সাহিত্যের জন্য বদল আনা দরকার, এই ভাবনা থেকে হাংরি আন্দোলনের জন্ম। তথ্য যা দেখা যাচ্ছে, প্রথম হাংরি বুলেটিনটি লিখিত ইংরেজিতে, ১৯৬০ সালে নিমডি থেকে, ওখানে বাংলা কোনও প্রেস ছিল না। যাতে দেখা যাচ্ছে: ক্রিয়েটার মলয় রায়চৌধুরী, লিডার শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এডিটর দেবী রায়। আসল নাম হারাধন ধাড়া, যেমন কলকাতা কর্পোরেশনের করণিক পশুপতি চট্টোপাধ্যায় পরিচিত ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নামে। এভাবে মলয়ের অভিভাবকত্বে হাংরি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল বাংলায় তথা কলকাতায়। তখনকার সমসাময়িক লেখক বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর, যাঁরা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক লেখক ছিলেন, এঁদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ শুরু হল। যেহেতু মলয়দার নেতৃত্বে এইসব চলছিল, তাই আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নেওয়া হল মলয়কে। তাঁর একটি কবিতা, যা ‘হাংরি বুলেটিন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল, ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’– এই কবিতাটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনে মলয়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে। বিহারের নিমডির বাসভবন থেকে।
জোড়াবাগান থানার পুলিশের একটি দল মলয়কে কোমরে দড়ি বেঁধে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে গ্রেপ্তার করে আনে, ধারা ছিল ১২০বি, ১৯২ ভারতীয় দণ্ডবিধিতে। একই অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ ঘোষ, এবং মলয়ের দাদা সমীর। মামলাকারী রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন, ডিসি ডিডি দেবী রায়। এঁদের মধ্যে সুবো আচার্যকে পুলিশ ধরতে পারেনি, বাকিরা মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। মলয় যেহেতু লক্ষ্য, তাই মলয়কে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে পেশ করা হয়। ১৯৬৫-র ৩ মে, কেস নং ৫৭৯/১৯৬৫, ২৯২ ধারায় ব্যাঙ্কশাল কোর্টে বিচারপতি এ.কে. মিত্র মলয়কে দোষী সাব্যস্থ করেন, বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার জন্য শাস্তি!
তৎকালীন হাংরিদের একটা বড় অংশ মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিলেন, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয় কিছু লেখা বা বলার জন্য এক বছরের স্কলারশিপে আমেরিকায় আছেন। তিনি এসবের খবর রাখতেন সন্দীপন মারফত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাক্ষী দিলেন মলয়ের পক্ষে। এছাড়া অধ্যাপক তরুণ সান্যাল, সত্রাজিৎ দত্ত-রা ছিলেন। যদিও যে কবিতার জন্য মলয়কে জেল খাটতে হল, ওই কবিতাটি বিশ্ব সেরা কবিতা সংকলনে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে জায়গা পায় ‘দ্য স্টার্ক ইলেকট্রিক জেসাস’ নামে। এইসব সাক্ষী সাবুদ হওয়ার পর মামলা যায় হাইকোর্টে, ২৬ জুলাই ১৯৬৭ সালে মাননীয় বিচারপতি তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে বেকসুর খালাস হন মলয়।
মলয় যশলোভী ছিলেন না। তাঁর লেখা ‘সূর্যের সপ্তম অশ্ব’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদ পুরস্কার তিনি সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কবি শঙ্খ ঘোষ আমার কাছে প্রমাণ দেখতে চেয়েছিলেন এর সত্যাসত্য জানার জন্য, আমি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। হাংরি কবি ফাল্গুনী রায় সংখ্যায়, আমার সম্পাদিত পত্রিকা ‘চন্দ্রগ্রহণ’-এও ছেপে দিয়েছিলাম। উত্তরবঙ্গের কবি অরুণেশ ঘোষ শঙ্খ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাঁকে জানতে চাওয়া হয়েছিল হাংরি কবিতা কি অশ্লীল? ওঁর জবাব ছিল, ‘পাঠকের কাছে অশ্লীলতা কথাটির কোনও মানে হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আপাত শ্লীলতার মধ্য দিয়েও বহু লেখা ব্যর্থ হয়, আপাত অশ্লীলতার মধ্য দিয়েও বহু লেখা উত্তীর্ণ হয়। প্রশ্ন এই ব্যর্থতা আর উত্তীর্ণতার, শ্লীলতা অশ্লীলতার নয়।’
‘মহেঞ্জদড় প্রাচীন বলে
বৃন্দাবনে বিধবা মহিলাদের ডাঁই অউসউইৎস’
‘একিলিসের গোড়ালিতে নিক্ষিপ্ত তীরের প্রতি’ (মলয় রায়চৌধুরী)
মলয়দার জীবনের শেষ পনেরো-কুড়ি বছর, আমি ওঁর সঙ্গে যোগাযোগে ছিলাম। অনেক কথা বলা গেল না। আবার কখনও অন্য কোন স্থানে, অন্য কোনও দিন সময় সুযোগ হলে লিখব, বলব!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved