১৩। সংখ্যার দুনিয়ায় কপালপোড়া এক নাম। তাকে কেউ সঙ্গে নেয় না অঘটন ঘটার ভয়ে। কারণটা যদিও জিজ্ঞেস করলে ঠিক বলতে পারে না তবু লোকের মুখে বদনামটা চাউর হয়ে গেছে কে জানে কার অভিশাপে! সে বেচারা এই উপেক্ষা মেনে নিয়েছে একা একা, সবার অলক্ষ্যে, চুপচাপ।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সৌকর্য ঘোষাল
৩.
১৩ নম্বর অপয়া। এই ধারণায় অনেক ছোটবেলায় জল ঢেলে দিয়েছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। না-হলে অঙ্কে ১৩ পাওয়ার পরেই ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ অমন রূপকথার মতো ভালোবেসে বুরুনের বেস্ট ফ্রেন্ড হত না। আমি অবশ্য কখনও ১৩ পাইনি অঙ্কে। শূন্য পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমার ভাগ্যে বন্ধুত্ব জোটেনি ভূতের। তবু ১৩ যে একটা আস্ত গেরো– একথা মানুষ মাত্রই জানে। তা না হলে নতুন ক্লাসের প্রথম দিন রোল কলের সময়, সবাই অপেক্ষা করে থাকত না এটা দেখার জন্য যে, কার কপালে ১৩ নাচছে। যার রোল নম্বর ১৩ হত, তার নাম ডাকার পরই গোটা ক্লাস এমন একটা চাহনি দিত যেন চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। আর সারা বছর সেই ১৩-নম্বরি কোনও এক অলীক শক্তির কন্সপিরেসির চোটে ফেল করার ভয়ে হাবুডুবু খেত। মুশকিলটা হল আমাদের ইশকুলে রোল নম্বর রেজাল্টের মার্কস দিয়ে না-হয়ে অ্যালফাবেট অনুযায়ী হত। তাই ইংরেজি অক্ষরের ‘এ’ বা ‘বি’-দের ১৩ নম্বর রোলের উত্তাপ পোহাতে হত সবচেয়ে বেশি। যার রোল নম্বর ১৩ হত, তার প্রতি সকলের সহমর্মিতা থাকলেও আমার মনকেমন করত ওই ‘১৩’-টার জন্যেই। বছর বছর রোটেশন করে ১৩ নম্বর রোল জুটত বিভিন্ন ছেলেমেয়ের ভাগ্যে। পর পর দু’বছর একজনই ১৩ রোল নম্বর পেয়েছে– এ আমি অন্তত দেখিনি। তাই যে বছর যে ১৩, পরেরবার সে ১২ বা ১৪ হয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও স্বয়ং ১৩ নম্বরের হাঁফ ছাড়ার কোনও উপায় থাকত না। সে তো জন্ম অপয়া। সংখ্যার দুনিয়ায় কপালপোড়া এক নাম। তাকে কেউ সঙ্গে নেয় না অঘটন ঘটার ভয়ে। কারণটা যদিও জিজ্ঞেস করলে ঠিক বলতে পারে না তবু লোকের মুখে বদনামটা চাউর হয়ে গেছে কে জানে কার অভিশাপে! সে বেচারা এই উপেক্ষা মেনে নিয়েছে একা একা, সবার অলক্ষ্যে, চুপচাপ।
আনলাকি থার্টিন-এর কনসেপ্টটা মূলত পশ্চিমের। যিশুর ‘লাস্ট সাপার’-এর ১৩ নম্বর চেয়ারটা বরাদ্দ ছিল বিশ্বাসঘাতক জুডাসের জন্যে। এর পরেই ক্রাইস্ট ক্রুশবিদ্ধ হন আর ১৩-র নাম জড়িয়ে যায় ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। মধ্যযুগে ইউরোপে ক্রিশ্চানিটির প্রভাব যত বাড়তে থাকে, ১৩-র বদনামও হয়ে ওঠে গগনচুম্বি। একদল পণ্ডিতের মতে, প্রভু যিশুর ক্রুসিফিকেশনের দিনটিকে ‘ফ্রাইডে দ্য থার্টি’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার পর ব্যাপারটা মাত্রা পায় আরও বেশি। একথা সত্য যে, প্রভু যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিনটি ছিল শুক্রবার, কিন্তু তা সে মাসের তেরো নম্বর দিন ছিল কি না, স্পষ্ট নয়। অন্য দলের পণ্ডিতদের মতে শুক্রবার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি লাস্ট সাপারের ১৩ নম্বর সদস্যের ষড়যন্ত্রের কারণে হয়েছিল বলে ফ্রাইডের সঙ্গে দ্য থার্টিনথ্-এর নাম জুড়ে গেছে ওতপ্রতভাবে।
সেই থেকে ১৩ আর আর বাকি পাঁচটা সংখ্যার মতো কুলীন নয়। সে হয়ে ওঠে আতঙ্কের অপর একটি নাম। যদিও এ আতঙ্কের জন্য ত্রিশ্চানিটিকে সম্পূর্ণ দায়ী করলে অসত্যকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। ‘১৩’ সংখ্যা নিয়ে মানুষের ভীতি বা ফোবিয়ার উল্লেখ রয়েছে তারও অনেক আগে, গ্রিক দর্শনে। ‘ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া’ বলে একটি মানসিক ব্যাধি যার সূত্রপাত হয় ১৩ সংখ্যার প্রতি ভয় থেকে। গ্রিক ভাষার এই ধারণা এসেছে নর্স মাইথোলজির হাত ধরে। নর্সের গল্পেও লাস্ট সাপারের মতো একটি ডিনার পার্টির উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে ১৩ নম্বর অতিথি ছিলেন ছলনার দেবতা ‘লোকি’। গ্রিকদের পরম বিশ্বাস ছিল লোকির ছলনায় আলোর দেবতা ‘বাল্দার’-এর প্রাণ যায়। ঘটনাটি বাইবেল-এর লাস্ট সাপারের সঙ্গে হুবহু মিলে গেলেও এর জন্য গ্রিকদের কোনও ক্রেডিট দিতে নারাজ জার্মানরা। কারণ বাল্দার-এর উল্লেখ জার্মানিক মাইথোলজিতেও বিদ্যমান। মোদ্দা কথা গ্রিক হোক, জার্মান হোক বা রোমান, মাইথলজির ডিনার টেবিলে ১৩ নম্বরটা যে কেন বারবার ভিলেনদের জন্য বরাদ্দ হয়, তার কারণ অজানা। পশ্চাত্যে যদিও ভাগ্য নির্ধারণের জন্য আদি যুগ থেকে যে ট্যারো কার্ডের প্রচলন রয়েছে, সেখানে ১৩ নম্বর কার্ডটি মৃত্যুর। তাই ১৩ নম্বরকে বিনাশের নম্বর হিসেবে দাগিয়ে দেওয়াটা একটা সুপরিকল্পিত চেষ্টা হলেও হতে পারে। হয়তো তাই জুডাস হোক বা লোকি যারাই নাশ করতে এসেছে শুভ শক্তিকে, তাদের ১৩ নম্বরি বানিয়ে দেওয়া গেছে স্বজ্ঞানেই।
তবে শুধু গ্রিক, জার্মান বা রোমানদেরই এ ব্যাপারে দোষ দিয়ে লাভ নেই এসবরও অনেক আগে মায়া সভ্যতার যে ক্যালেন্ডার পাওয়া যায়, তারও শেষ তারিখটি ১৩। যেখান থেকে এই ধারণার আমদানি হয় যে ১৩-র পরই ধ্বংস আসন্ন। অন্যদিকে ব্যাবিলনের যে কোড, সেখানেও ১৩ নম্বর আইনের কোনও উল্লেখ নেই যা হয়তো অপয়া ছুঁৎমার্গের কারণেই বঞ্চিত।
ভারত আবার এসবের ধার ধারেনি কোনও দিন। তাই একটি বছরে বারোটা মাসের বেশি বন্দোবস্ত না করে থাকতে পারলেও তেরো পার্বণ চালু করে দিয়েছে দেদার আনন্দে। এমনকী, সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে– একথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছে রোম্যান্টিক মন। আসলে ১৩ নম্বরের সঙ্গে শিবের যোগ খুব নিবিড়। তাই ১৩ দিনের উপবাসের পর ত্রয়োদশীতেই শিবের পুজো করেন এদেশের মানুষেরা আত্মজনের দীর্ঘায়ু কামনায়। তাই ভারতে ১৩ মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে। মৃত্যু অবশ্য যেহেতু আমাদের দর্শনে আত্মার হয় না, তাই কোনও মানুষের দেহাবসানের পর ১৩তম দিনেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের চল রয়েছে আত্মার মুক্তি প্রার্থনায়। এমনকী, জীবনের ধারাকে আরও ঝলমলে করে তোলার দিন ‘ধনতেরস’ শব্দটা ১৩ থেকেই আগত– যা পালন হয় কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতেই।
তবে ভয় মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয়। এমনকী, শিকড়ও। একথা বুঝেছি অনেক পরে। একটি অফিসের লিফ্টে উঠে প্রায়ই ১৮ তলায় যেতে হয়। ভিড়ের মধ্যে পড়ি কি মরি অবস্থায় নাকচোখ বুজে আঠারো নম্বর বোতামটা টিপে দেওয়াই দস্তুর। একদিন রবিবার দুপুরবেলা ফাঁকাই ছিল এলিভেটর। তাই তাড়াও ছিল না বোতাম টেপার। লক্ষ করলাম, ২২টা বোতামের মধ্যে ১৩ নম্বরটা উধাও। বারোর পরে রয়েছে এক অদ্ভুত নম্বর, বারোর-এ। তার পরেই ১৪। অর্থাৎ ২২ তলা বিল্ডিংয়ে আদতে তেরোর নামে একটা তলাও বরাদ্দ হয়নি। পরে জেনেছিলাম, এ বুদ্ধিটা জ্যোতিষ দিয়েছে। নিউমারোলজির দোহাই দিয়ে বুঝিয়েছে ১৩ নম্বর ফ্লোর না থাকলে ভূমিকম্পেও নাকি ইমারত ভেঙে পড়বে না। সেদিন বুঝেছিলাম শিব ঠাকুরের আপন দেশে ১৩ আর অপয়াও নেই, সোজা উধাও হয়ে গেছে!
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
মানুষের মনের ভিতর যে ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ, তাকে মানুষ প্রশমিত করে রাখে কখনও ‘ঈশ্বর’ নামে কল্পনার নীতি দেবতাটিকে আশ্রয় করে, কখনও পরিবার-পরিজনের প্রতি স্নেহ-দুর্বলতা-ভালবাসায়, কখনও সমাজরক্ষায়। আর এই নীতিবোধের শিক্ষা বা চর্চা, চলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে অথবা প্রজন্মবাহিত পারিবারিক শিক্ষায়। দুঃখের বিষয়– এই দুই ব্যবস্থাটিই প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে।