দশ বছর বয়স হওয়ার আগেই বুঝি আমি জাত ঘটি, আর বাঙালরা ঘটমান বর্তমান। এমনিতে আমাদের পাড়ায় ওই স্পিসিস আতশ কাচ দিয়ে খুঁজতে হয়, কিন্তু ম্যাচ জিতলেই কে যে বাড়ির দরজায় পচা গলদা ঝুলিয়ে দিয়ে যায় কে জানে! তখন যেহেতু ইলিশ সম্বৎসর পাওয়া যেত না এবং এখনকার মতো টিভি সিরিয়ালের ধাঁচে ডার্বি হত না, তাই ওই এক কি দু’-ঘর বাঙাল বাড়ির দরজায় পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক। ফলে আমাদের আক্রোশ বেড়ে যেত।
মোহনবাগান যখন গুছিয়ে হারে, বিশেষত, ইস্টবেঙ্গলের কাছে, সেই সময়কাল যে সুবিধের নয় তা জ্ঞান হওয়া ইস্তক বুঝেছি। পঁচাত্তরে যখন পাঁচ গোল তখন তো ইমারজেন্সি চলছে দেশে! আবার উনআশির গোড়ায় যে তিন গোল খেলাম তার অশনি সংকেত তো কয়েক মাস আগেই অকাল বন্যায় পাওয়া গেছিল। এর মানে কি রাজনীতি বা প্রকৃতি যে প্রলয়ংকর ব্যাপার ঘটাবে, তার ফল ভোগ করবে ঘটিরা আর লাভের গুড় খেয়ে যাবে বাঙালরা? দশ বছর বয়স হওয়ার আগেই বুঝি আমি জাত ঘটি, আর বাঙালরা ঘটমান বর্তমান। এমনিতে আমাদের পাড়ায় ওই স্পিসিস আতশ কাচ দিয়ে খুঁজতে হয়, কিন্তু ম্যাচ জিতলেই কে যে বাড়ির দরজায় পচা গলদা ঝুলিয়ে দিয়ে যায় কে জানে! তখন যেহেতু ইলিশ সম্বৎসর পাওয়া যেত না এবং এখনকার মতো টিভি সিরিয়ালের ধাঁচে ডার্বি হত না, তাই ওই এক কি দু’-ঘর বাঙাল বাড়ির দরজায় পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক। ফলে আমাদের আক্রোশ বেড়ে যেত। ভুল করে তাদের কেউ দু’-একটা মাতৃভাষা আওড়ে ফেললে, আমরা তাকে ‘হাবুল সেন’ বলে আওয়াজ দিতাম। ঘটিদের প্রতিটি শব্দের উচ্চারণে একটি গোলগাল ব্যাপার আছে যা বাঙালদের রণংদেহি লব্জে একেবারেই অনুপস্থিত। এই ট্রেনিং-ই পেয়েছি ছোটবেলা থেকে। যেমন, আকাশবাণীতে অতুলপ্রসাদের গানের অনুষ্ঠান। ঘোষক ‘অ’ কে ‘অ’ উচ্চারণ করলেন। অমনি বাবা বলে উঠলেন, ‘‘কোত্থেকে সব বাঙাল ধরে এনেছে, ‘ওতুল’ বলতে পারে না?”
পড়ুন আরও পাল্টি: গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ
আরেকটু বড় হয়ে শুনলাম সব বাঙালই নাকি রিফিউজি আর যাদের দুটো পদবী জোড়া থাকে তারা সবাই বাঙাল। যেমন সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত, রায়চৌধুরী ইত্যাদি। আইডেনটিটি ক্রাইসিস না হলে এটা সম্ভব? কিছু বাঙাল সাতচল্লিশের, আবার কিছু একাত্তরের। স্বাধীনতার বাঙালরা একটু উচ্চাসনে আসীন, এই হাইপোথিসিস পাড়ার আলোচনাচক্রে নিপাতনে সিদ্ধ হল। ভিটেমাটি ছাড়ার কঠিন দিনগুলোয় ‘ওপার’-এর ‘পাবলিক’-এর অসহনীয় যাপন ঘটি মনে দাগ কেটে থাকলেও মুখে চুকচুক শব্দ করিনি। এক তুতো দাদার সঙ্গে যখন বাঙাল মেয়ের লাভ ম্যারেজ হল তখন আমাদের পরিবারের মুখ থমথমে। আমার কিন্তু মেয়ের বাড়ির গোকুল পিঠে বেশ ভালো লেগেছিল। নিজের লাভ খোঁজার সময় অবিশ্যি ঝামেলা এড়াতে মূলত ঘটি মেয়েদের দিকেই তাকিয়েছি। তবে জীবন তো কম্প্রোমাইজে ভরা আর যৌবন থেমে থাকে না। তাই বাড়িতে জানাই। ‘বাঙাল নাকি?’ “আজ্ঞে, হাফ মানে বাটি। বাবার সাইড ওপার, মা’র গড়পার”। আরও আশ্বস্ত করার জন্য বলি যে, হবু শ্বশুরের পরিবার স্বাধীনতার অনেক আগেই এই বঙ্গে ঠাইঁ নিয়েছেন। গুরুজনদের ভ্রূ কুঁচকায়, এই নতুন ক্যাটেগরি আবার কোথা থেকে এল। হয়তো এক্সেপশন এবং সেটাই যে একটি ‘রুল’কে মান্যতা দেয় তা বাঙালেও বোঝে।
পড়ুন আরও পাল্টি: মানুষ হয়ে জন্মেছি, ব্যাং কী করে জন্মায়, তা জেনে কী হবে?
মানিকতলা ছেড়ে কয়েক বছর দেশ-বিদেশ-কেষ্টপুর ঘুরে কাঁকুড়গাছি। সস্ত্রীক ভোটার আইডি বানানোর লাইনে দাঁড়িয়েছি। দিনকাল বদলেছে দেখে মনখারাপ হয়। ঘটি কই? কানের কাছে হয় হিন্দি নয় বাঙাল ভাষা– ‘গেলুম, খেলুম, পেলুম’ থেকে এ কোন দেশে এলুম? নিজেকে রিফিউজি মনে হয়। এবং অবাক কাণ্ড, সরকারি আধিকারিক তেমনটাই মনে করেন। আমি যত বোঝাই যে, শেষ ভোট দিয়েছি নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এবং পরপর দু’-বার কারণ পটাপট সরকার উল্টে ছিল– স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু লাভ হয় না। পাসপোর্ট দেখাই, তখন আধারের যুগ শুরু হয়নি। তবু তিনি আমার নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। বলেন, “আপনার মা’র রেশন কার্ড নিয়ে আসুন”। আরে রেশন তুলেছি সেই ছোটবেলায়, সেটাও মানিকতলায়। এই লোকটা নির্ঘাত বাঙাল। প্রায় হাতাহাতি লেগে যায়। আমি বলি দরকার নেই আমার ভোটার কার্ড। উনি নির্লিপ্তভাবে বলেন, ‘তাহলে সরে দাঁড়ান, ম্যাডামকে আসতে দিন।’ ম্যাডাম মানে আমারই স্ত্রী– হাফ বাঙাল। আমি প্রবল অপমানিত বোধ করি। পাঁড় ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টারের হাতে আমার ঘটিবাটি সঁপে দিয়ে রাস্তায় নেমে মাটির ভাঁড়ে চা খাই।
কিছুক্ষণ পর সহধর্মিণী আসেন, অভয় দেন। বলেন উনিই দৌড়ঝাঁপ করবেন। আমায় সই ছাড়া কোনও ধকল নিতে হবে না। মনে মনে ভাবি, এ তো সুভাষ ভৌমিক! গোল লাইনে বল নিয়ে দাঁড়িয়ে লোক ডেকে গোল দিচ্ছে। তবে নাগরিকত্ব অতি প্রয়োজনীয় বস্তু, তার ওপর আমায় খাটতে হচ্ছে না। ঘটিধর্ম মেনে নিমরাজি হই। উচাটনে কাটে কিয়ৎকাল, তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত ল্যামিনেটেড কার্ড। পদবীর জায়গায় ‘দাশগুপ্ত’ লেখা আছে।