সন্ধেয় এক ঠোঙা মুড়ি-বেগুনি-আলুর চপ পরিবেশনের কথা ইডেন কস্মিনকালেও কল্পনা করতে পারবে না। ঢাকা পারে। মীরপুরের শের-ই-বাংলা প্রেসবক্স পারে। আর পারে বলেই ক্রিকেট মাঠ এখনও ও দেশে অকৃত্রিম ভালবাসার উঠোন। গা ধুয়ে সাঁঝবেলায় যেখানে এসে বসে লোকে। ক্রিকেট নামক উপাসনার ‘তুলসীমঞ্চে’ শ্রদ্ধার প্রদীপ জ্বালিয়ে।
স্বগোত্রীয় ইলিশ আর ভুনা খিচুড়ির মতো পদ্মাপারের আরও এক মনোহরা আয়োজন আছে। ভাল নাম ‘আপ্যায়ন’, ডাক নাম ‘আতিথেয়তা’। পশ্চিমে দিন-দিন যা কমছে বটে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্ত ডাক-খোঁজের প্রচলন আজও বেশ বিদ্যমান। সব সময় কেমন এক আপন-আপন মনকেমন ছেয়ে থাকে চারদিকে, দেখলে ইংরেজদের জন্য বেশ করুণা হয়। শত অপচেষ্টায় বাংলা ভাগ হয়েছে বটে। কিন্তু বাঙালি ভাগ আর হল কোথায়!
সোনার বাংলার অকাতর আদর-খাতির-যত্ন-আত্তি পেতে নিবাস কলকাতা হলেই যথেষ্ট! তার উপর সাংবাদিক হলে তোয়াজ বহুগুণ বেশি। এ পেশায় এসে নয়-নয় করে কম দেশ ঘোরা হয়নি। ফ্রান্স। ইংল্যান্ড। শ্রীলঙ্কা। আরব। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রতি সম্মান ও অতিথিবৎসলতায় বাংলাদেশের আশপাশে কেউ থাকবে কি না, সন্দেহ! রাস্তা-ঘাটে-বাজারে-হাটে সাংবাদিক নজরে পড়লে সম্ভ্রম এমনই হাঁটু গেড়ে বসবে যে, রাঘববোয়াল জ্ঞানে আত্মদর্শন হতে বাধ্য! মীরপুরের বিশ্রী জ্যামজটে অসহায় সাংবাদিক আবিষ্কার করে ধমকে-ধামকে ট্র্যাফিক পুলিশ জ্যামের জট ছাড়াতে উদ্যত হচ্ছেন, দেখেছি। আবার প্রিয় সাংবাদিককে ধাওয়া করে, রীতিমতো মাঠের নিরাপত্তা কর্ডন ফুঁড়ে ভক্তের প্রেসবক্স পর্যন্ত উঠে আসা, তা-ও চাক্ষুষ করেছি। যার পর মনে হয়েছে, বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
২০১৫ সালে শেষ বাংলাদেশ যাওয়া। মাঝের বছর আটে কতটা সজ্জাগত পরিবর্তন হয়েছে ওপারের, জানা নেই। কিন্তু হলফ করে লেখা যায়, মজ্জাগত বদল কিছুই আসেনি। পদ্মাপারে ‘দাওয়াত’ বিষয়টা ডাল-ভাতের মতোই সাধারণ। সামান্য চেনা-পরিচিতি-সখ্য গড়ে উঠলেই ‘দাওয়াত’-এ ডাক পড়ে। এবং সে দেশ থেকে ফিরে এসেও তা থামে না! বরং ইলিশের মরশুমে নিয়মিত ফোন বাজে। সবিস্তারে জানানো হয়, কত করে কেজি যাচ্ছে, বাড়ির ফ্রিজে কত কেজি মজুত করা রয়েছে, গেলে ইলিশের কী কী পদ রেঁধে খাওয়ানো হবে– সব। শেষে, শেষ পাতের মিষ্টির মতো ডাক, ‘চইল্যা আসেন দাদা।’ পাসপোর্ট-ভিসা-ফ্লাইট টিকিটের খরচাপাতির ‘মানসাঙ্ক’ সে আবেগ-তোড়ে কাজ করে না। আধুলির মতোই তা অচল।
ক্রিকেট স্টেডিয়ামও পদ্মাপারে ঠিক ‘স্টেডিয়াম’ নয়, বরং যেন উত্তর কলকাতার রোয়াক! সন্ধে নামলে যেখানে আড্ডা বসে, মুড়ি-আলুর চপ সহযোগে! না, ভুল পড়েননি। এ জিনিসও চোখে ও চেখে দেখা। কার্ডাস বর্ণিত নিছক ‘সামার গেম’ থেকে সরতে-সরতে ক্রিকেট এখন বদলে গিয়েছে প্রচুর। বদলে গিয়েছে ক্রিকেটের রাজ-সজ্জা। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো খেলা দেখাতে সম্প্রচারকারী সংস্থাকে আর অর্থ দিতে হয় না দেশজ বোর্ডদের। উল্টে সম্প্রচারের সত্ত্ব পেতে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যেই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, অর্থ এখন তারাই দেয়, ক্রিকেট বোর্ডদের কোষাগার ফুলেফেঁপে ওঠে অর্বুদ কাঞ্চনমূল্যে। যে বিত্তের ছোঁয়া পড়ে সর্বত্র, পরিকাঠামো থেকে প্রচারমাধ্যমের খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত। ইডেনে আন্তর্জাতিক ম্যাচ কিংবা আইপিএল থাকলে সন্ধে নাগাদ মুখবন্ধ একটা প্যাকেট আসে। যেখানে কেতাদুরস্তভাবে সাজানো থাকে স্যান্ডউইচ থেকে চিকেন ইংলিশ ফ্রাই। সঙ্গে ফ্রুট কেক। রাংতায় মোড়া মিষ্টি। সন্ধেয় এক ঠোঙা মুড়ি-বেগুনি-আলুর চপ পরিবেশনের কথা ইডেন কস্মিনকালেও কল্পনা করতে পারবে না। ঢাকা পারে। মীরপুরের শের-ই-বাংলা প্রেসবক্স পারে। আর পারে বলেই ক্রিকেট মাঠ এখনও ওদেশে অকৃত্রিম ভালবাসার উঠোন। গা ধুয়ে সাঁঝবেলায় যেখানে এসে বসে লোকে। ক্রিকেট নামক উপাসনার ‘তুলসীমঞ্চে’ শ্রদ্ধার প্রদীপ জ্বালিয়ে।
আর সোনার বাংলার মানুষ যেমন, ক্রিকেটাররাও তেমন। সাদাসিধে। আন্তরিক। অমায়িক। সোনার। প্রথম সাক্ষাতে যেখানে সহজ প্রশ্ন আসে, ‘ভাই, কেমন আছেন? কলকাতায় সব ঠিক তো?’ মাঠের রেষারেষিকে মাঠে ফেলে এসে। অধুনা ভারত-বাংলাদেশ খেলা পড়লে সোশাল মিডিয়ায় কিছু ধর্মান্ধ ‘পিশাচ’ পাওয়া যায়, পৈশাচিক উল্লাসে একে অন্যের অসম্মানই যাদের মোক্ষ। দু’দেশেই। কিন্তু বাস্তব হল, এরা সব গণ্ডমূর্খ মুষ্টিমেয়। খেলা যারা বোঝে না। খেলাকে যারা খেলাও রাখে না। আর এরা কখনওই দু’দেশের ক্রিকেট-সমর্থনের বৃহত্তর অংশ নয়। ‘কেকেআর’-এ খেলার সময় সাকিব-আল-হাসানের কদর ইডেন সমর্থকদের কাছে কম ছিল না কি? নাকি বাংলাদেশে সৌরভ-ধোনি-কোহলিরা কম সমাদৃত হন? ভারতীয় সাংবাদিকদেরও পদ্মাপারের ক্রিকেটাররা প্রভূত সম্মানের নজরে দেখেন। ২০১৮ এশিয়া কাপেই যেমন, ভারত-বাংলাদেশ ফাইনালের ঠিক আগে। দুর্ধর্ষ ক্রিকেটে খেলে পাকিস্তান বধ করে এশিয়া কাপ ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান ম্যাচের মহানায়কের সাক্ষাৎকার নিতে চাইছিলাম। টিম ম্যানেজার মারফত অনুরোধ পৌঁছনো মাত্র যিনি রাজি হয়ে গেলেন, প্রাক্-ফাইনাল সাংবাদিক সম্মেলন পিছিয়ে। আর এসে বললেন, ‘চলেন, একটা সিগারেট খেতে-খেতে কথা বলি।’
ভাবা যায়? ক্রিকেটের এই পেশাদারি যুগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক ক্রিকেট-বীর কি না ভিনদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন এত সহজে, এত অক্লেশে! রাখঢাকে যাঁর কোনও আগ্রহ নেই, ইচ্ছেও নেই? যিনি কি না প্রেস রিলিজের পৃথিবীতে অবলীলায় দেখিয়ে দিচ্ছেন নিজের চোটগ্রস্ত হাত, উড়ে গিয়ে ক্যাচ ধরার ‘পুরস্কার’ যা। কী জানতে চান এবার, ক্রিকেটারের নাম? থাক না। সব বলা উচিত হবে না। কী বললেন, বলতেই হবে? ঠিক আছে, চলুন। সাংবাদিকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খাওয়া তো আর গর্হিত অপরাধ নয়।
মাশরাফি-বিন-মোর্তাজা! ওপারের ক্রিকেটের উত্তমকুমার!
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।