জীবন জানে, নিয়তির থেকে আশ্চর্য ঠাট্টা কোনও সিনেমা করেনি কখনও। প্রযোজনার ব্যবসায় ঢুকে, লোকসানে ডুবে গেলেন ভারত ভূষণ। কয়েক বছরের মধ্যে বিক্রি করতে বাধ্য হলেন দামি গাড়ি, চোখ-ধাঁধানো বইয়ের কালেকশন, সুশোভিত বাংলো। অমিতাভ বচ্চন, একদিন, সান্তাক্রুজের রাস্তায় যেতে যেতে, হঠাৎ দেখতে পেলেন, বাসস্টপের ভিড়ে, দাঁড়িয়ে আছেন ভারত ভূষণ। ফিফটিজের হার্টথ্রবকে চিনতে পারছেন না কেউ, অনেকে হয়তো নামই শোনেননি। অমিতাভ আকুল চাইলেন, গাড়ি দাঁড় করিয়ে, লিফট দেবেন তাঁকে। পারলেন না, সাহসে কুলোল না তাঁর।
বাঙালি মানেই বিপ্লবী, বাঙালি মানেই বোম মারবে– এরকম একটা ধারণা গেঁড়ে গেছিল ব্রিটিশ সরকারের মাথায়। তিনের দশকে, অফিশিয়াল পারমিশন ছাড়া, দার্জিলিংয়ে ঢোকার অনুমতি ছিল না বাঙালিদের। কারণ, গ্রীষ্মকালে, সেখানে গভর্নর বাহাদুর হাওয়া খেতেন।
উত্তরপ্রদেশের এক মা-মরা কিশোর, ১৯৩৫ সালে, বেড়াতে এলেন দার্জিলিং। সঙ্গে, বাবা আর দাদা। শিলিগুড়িতে এসে, কোনও কারণে, তাঁকে রেখে, বাকি দু’জন গাড়িতে চড়ে এগিয়ে গেলেন। শুনশান শিলিগুড়ি স্টেশন, ট্রেনের অপেক্ষা করছেন তিনি। এক ধুরন্ধর পুলিশ ইনস্পেক্টরের নজর পড়ল তাঁর ওপর; হাবভাবটা, ‘শোলে’-র সেই ‘আংরেজোঁ কে জমানে কা জেলার’। ইনস্পেক্টর জেরা করতে শুরু করলেন ছেলেটিকে। এবং, ‘বাঙালি নই, আলিগড় থেকে এসেছি’ জবাবে, খুশি হলেন না।
শুরু হল তল্লাশি। কিশোরের কাছে পাওয়া গেল একটা খেলনা এয়ারগান। ব্যাস, ‘পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’ প্রমাণ করতে, পাকড়াও করে, নিয়ে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।
ম্যাজিস্ট্রেট নাম জানতে চাইলেন। কিশোর বললেন, ‘জী, ভারত ভূষণ।’
অমনি, লাফিয়ে উঠে, মোকদ্দমা মজবুত করলেন ইনস্পেক্টর, ‘শুনুন, হুজুর, নামটা ভাল করে শুনুন…’; বাঙালি-জিভে, সব ধ্বনির শেষে অকারণ ও-কার গুঁজে, র, ষ, ণ-এর ষষ্ঠীপুজো করে, চেঁচাতে থাকলেন তিনি, ‘ভারোত ভুশোন… ভারোত ভুশোন…!’ এবং, স্থিরসংকল্প ঘোষণা করলেন, ‘এ ছেলে পাক্কা বাঙালি!’
সন্ধে ঘনিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘রাতটা কাস্টোডিতেই কাটাও, কাল দেখছি!’ লকআপে ঢোকানো হল ছেলেটিকে। একা-একা কী করবেন, বুঝে না পেয়ে, ইনস্পেক্টরের উচ্চারণ নকল করে, সারারাত নিজের নাম নিজেকে শোনাতে থাকলেন তিনি। ভোরের দিকে আত্ম-প্রত্যয় হল, তিনি নিশ্চয়ই ‘বাঙালি টেররিস্ট’।
সকালে, ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে দার্জিলিংয়ে পাঠালেন, পুলিশি হেফাজতে, বাবাকে খুঁজতে। বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলিয়ে, সে যাত্রায় গেরো থেকে বাঁচলেন ভারত ভূষণ।
গ্র্যাজুয়েশনের পর, বাড়ির অমতেই, কলকাতায় এলেন তিনি, অভিনেতা হতে। ঠিকঠাক সুযোগ না পেয়ে, গেলেন বম্বে। কে যে কখন কার মধ্যে কী খুঁজে পায়, সে বোধহয় ব্যাখ্যাতীত। মাত্র কয়েক বছর আগে যাঁকে দেখে ‘টেররিস্ট’ ভেবেছিলেন একজন, তাঁকেই কবিরের চরিত্রে বসালেন পরিচালক রামেশ্বর শর্মা। প্রস্তাব পেয়ে, প্রথমে, হাসি পেল ভারত ভূষণের। নিতান্ত অনিচ্ছাতেই, করলেন ‘ভক্ত কবির’।
‘ভক্ত কবির’ এত হিট হল, ভারত ভূষণকে দেখলেই, হুড়োহুড়ি শুরু হল পা ছুঁয়ে প্রণাম করার। কুণ্ঠায় কুঁকড়ে গেলেন সুদর্শন নায়ক; পালাতে চাইলেন ভিড় থেকে; পারলেন না। ইন্ডাস্ট্রির ফরমুলা মেনে, লাইন লেগে গেল প্রোডিউসার-ডিরেক্টরদের। একের পর এক কবি, গায়ক, সুফি-সন্তের রোল– ‘বৈজু বাওরা’, ‘মির্জা গালিব’, ‘শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু’, ‘আনন্দ মঠ’, ‘বসন্ত বাহার’, ‘ফাগুন’…। বিপরীতে, তুখোড় সব নায়িকা– মীনা কুমারী, মধুবালা, সুরাইয়া, গীতা বালি, মালা সিনহা…। হিন্দি সিনেমায় যে সময়ে ধুন্ধুমার করছেন রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার– সে সময়েই সমান্তরালে সাঁতরে চললেন ভারত ভূষণ।
একবার, এক প্রযোজক সাহির লুধিয়ানভির ফটো চাইলেন; ফটো দেখে, সাহিরকে বললেন, ‘তোমাকে দেখলে ঠিক কবি-কবি লাগে না!’ মুচকি হাসলেন সাহির, ‘এই দুনিয়ায় একমাত্র ভারত ভূষণ, পারফেক্ট কবি-কবি দেখতে।’ আসলে, অন্তর্মুখী ভারত ভূষণ নিজে ছিলেন বইপোকা; সংগীত নিয়েও সমান চর্চা তাঁর। তাই, সংগীত বা সাহিত্য-কেন্দ্রিক চরিত্রে সহজে ঢুকে পড়তে পারতেন। মহম্মদ রফি, মান্না দে, তালাত মাহমুদের কণ্ঠে যেসব রাগ-প্রধান গান তাঁর সিনেমায় থাকত, সেসবে লিপ মেলানো ইয়ার্কি ছিল না।
ভারত ভূষণ বলতেন কম, শুনতেন বেশি। গান-বাজনা-সাহিত্যের পাশাপাশি অফুরন্ত আগ্রহ বিজ্ঞানেও। ঘরোয়া মজলিশে, নিউক্লিয়ার সায়েন্স নিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনে, সাহির হাঁ। এত বই, এত বই– বাড়ি না লাইব্রেরি, বোঝা মুশকিল। একদিন, একটা দরকারে, সাহির দেখা করতে এসেছেন; তিনি নেই। অনেকক্ষণ পর, ফিরলেন। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত শায়র, দরজা খুলে, মজা করেই, বললেন, ‘কাকে চাই?’ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, একটু থেমে, উত্তর দিলেন নায়ক, ‘কথাটা ঠিকই… এ বাড়ি দেখে মনে হয়, এখানে কোনও অ্যাক্টর থাকে না, রাইটার থাকে।’
আলিশান বাংলো, শেভ্রোলে গাড়ি– কী ছিল না তাঁর! অথচ, বেশভূষা একেবারে সাধারণ। সাদা জামা-প্যান্ট আর চপ্পল, এই ছিল মার্কামারা পোশাক, সব জায়গায়। দুই রাস্তার কর্নার প্লটে ইংলিশ স্টাইলের কটেজ বানালেন। কোনও একটা রাস্তা ধরে, বাড়ির দু’দিক থেকেই ঢোকা যায়। একদিন সকালে, আবিষ্কার করলেন, একটা রাস্তার নাম ‘টেগোর রোড’; আরেকটা, ‘দত্তাত্রেয় রোড’। চমকে গেলেন ভারত ভূষণ, নিয়তি কি এভাবেই তাঁর জীবনে জুড়ে দিয়েছে কবিতা ও সন্ন্যাস! যেদিন বেরবেন শেষযাত্রায়, ফুরোবে এ জীবনের সব লেনদেন– সেদিন তো নিরালম্ব যেতে হবে হয় এক মহাকবির নামাঙ্কিত পথে, নয়তো এক পৌরাণিক ঋষির রাস্তায়!
জীবন জানে, নিয়তির থেকে আশ্চর্য ঠাট্টা কোনও সিনেমা করেনি কখনও। প্রযোজনার ব্যবসায় ঢুকে, লোকসানে ডুবে গেলেন ভারত ভূষণ। কয়েক বছরের মধ্যে বিক্রি করতে বাধ্য হলেন দামি গাড়ি, চোখ-ধাঁধানো বইয়ের কালেকশন, সুশোভিত বাংলো। অমিতাভ বচ্চন, একদিন, সান্তাক্রুজের রাস্তায় যেতে যেতে, হঠাৎ দেখতে পেলেন, বাসস্টপের ভিড়ে, দাঁড়িয়ে আছেন ভারত ভূষণ। ফিফটিজের হার্টথ্রবকে চিনতে পারছেন না কেউ, অনেকে হয়তো নামই শোনেননি। অমিতাভ আকুল চাইলেন, গাড়ি দাঁড় করিয়ে, লিফট দেবেন তাঁকে। পারলেন না, সাহসে কুলোল না তাঁর। ভাবলেন, আপাদমস্তক ভদ্রলোক হয়তো অপ্রস্তুত হবেন; লজ্জিত বিব্রত হবেন তিনি, সকলের সামনে। সেদিন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে, আরব সাগরের নোনা ঝাপটায়, অমিতাভের মনে পড়ছিল কাইফি আজমি, ‘ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যা হাসিঁ সিতম/ তুম রহে না তুম, হম রহে না হম…’
জনশ্রুতি আছে, কবিরা নাকি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা– হয়তো অতিশয়োক্তি, হয়তো নয়। আমরা ওসব জানি না। এটুকু জানি, মারা যাওয়ার দিন কয়েক আগে, দুই মেয়েকে ডেকে, ভারত ভূষণ বলেছিলেন, ‘মেরা প্যাকআপ হো গয়া…’
এ দেশে প্রসূতিসদন থেকে নবজাত শিশু ও প্রসূতিকে ছেড়ে দেওয়ার পরও স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত একজন চিকিৎসক বাড়িতে এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। এটা ছিল এখানকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।