জেঠিমা প্রতিদিন নিয়ম করে তিন রকমের মাছ, শীতকালে শুঁটকি এবং ছেলে আসামের তেল কোম্পানি থেকে ছুটি নিয়ে বউ, নাতি-নাতনি-সহ ফিরলে পাঁঠা, শুয়োরের মাংস রাঁধতেন। ওই একই হেঁশেলে মাটিগাড়ার কুমোর কাম ওস্তাদ ফুটবল খেলোয়ার জিতেন সাউ সকাল থেকে একটু একটু মদ খেতে খেতে, খুব হইচই সহকারে আদা-জিরে বাটা দিয়ে গরুর মাংস রাঁধলে বিকেল তিনটে নাগাদ রোদে পিঠ দিয়ে বারান্দায় বসে এই বড় বড় কাঁচা লঙ্কা মটমট করে ভেঙে ঝোল-ভাত খাওয়া হত। খেয়ে উঠে গায়ে দোলাই টেনে জেঠিমার সে কী নাক ডাকিয়ে ঘুম! আমরা ছাদময় দাপাদাপির ফাঁকে ছেলের বউকে বাড়ির সমস্ত কাজ করতে দেখেছি। বিকেলে যাদবজিকে গাছে জল দিতে দেখলে জেঠিমা আবার কেন যে হাই তুলে সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে ‘কারও তো কিছুই হল না, আমিই ভাবছি ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাব’ বলত, তারও কোনও কারণ কেউ কখনও খুঁজে পায়নি।
১৭.
বাঙালির জীবনে ছোটখাটো ভয়গুলো ওই হিন্দুত্ববাদী ক্রিমিনালদের আজকালকার এই হঠাৎ সংখ্যাধিক্যের চাইতে অনেক বেশি জ্যান্ত। যাদবজি রামজেঠুর বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকত। বিহার থেকে তল্পিতল্পা গুঁটিয়ে আসাম যাওয়ার পথে যখন এসেছিল, তখন সিনেমা হল, খোট্টার দোকান, তেলকল, পেট্রোল পাম্প কিচ্ছু হয়নি। জেঠিমা সদ্য বিয়ের পর রাতে কলঘরে যাবে, হ্যারিকেনের পলতে উসকে দেখে উঠোনে এক প্রকাণ্ড বাঘ বসে জুলজুল করে ওর দিকে চেয়ে ঠোঁট চাটছে। ও বাড়ি কে তৈরি করেছিল রামজেঠুর মনে নেই, তবে ইয়া মোটা দেওয়াল আর কড়িকাঠের ছাদঅলা ঘরগুলো গ্রীষ্মের প্রবল গর্মিতেও বেজায় ঠান্ডা থাকত। তবু জেঠিমা কেন যে যাদবজিকে বারান্দায়, কলতলায় এধার-ওধার করতে দেখলেই কেবল জেঠুকে শুনিয়ে-শুনিয়ে ‘তোমার তো কিছু হল না, আমিই ভাবছি ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাব’ বলত, তার কোনও কারণ কেউ কখনও বুঝে উঠতে পারেনি।
জেঠিমার নিজস্ব রান্নাঘর ছিল। তার সামনে দরজার একপাশে খানিকটা ঢাকা বারান্দায় যাদবজির স্ত্রী, অর্থাৎ কি না আমাদের চাচি রান্না করত। দেওয়ালে জীর্ণ পলেস্তরা খসা তাকে মশলার কৌটো থেকে ঝকঝকে পেতলের বাসন অবধি, সবই রাখা দেখেছি, কখনও চুরি হয়েছে এমনটা শুনিনি! দুই মধ্যবয়সির মধ্যে একটানা কথা চলত দিলীপ কুমার, মিনা কুমারী, ওয়াহিদা, দেবানন্দ থেকে অড়হরের ফলন অবধি। জেঠিমা প্রতিদিন নিয়ম করে তিন রকমের মাছ, শীতকালে শুঁটকি এবং ছেলে আসামের তেল কোম্পানি থেকে ছুটি নিয়ে বউ, নাতি-নাতনি-সহ ফিরলে পাঁঠা, শুয়োরের মাংস রাঁধতেন। ওই একই হেঁশেলে মাটিগাড়ার কুমোর কাম ওস্তাদ ফুটবল খেলোয়ার জিতেন সাউ সকাল থেকে একটু একটু মদ খেতে খেতে, খুব হইচই সহকারে আদা-জিরে বাটা দিয়ে গরুর মাংস রাঁধলে বিকেল তিনটে নাগাদ রোদে পিঠ দিয়ে বারান্দায় বসে এই বড় বড় কাঁচা লঙ্কা মটমট করে ভেঙে ঝোল-ভাত খাওয়া হত। খেয়ে উঠে গায়ে দোলাই টেনে জেঠিমার সে কী নাক ডাকিয়ে ঘুম! আমরা ছাদময় দাপাদাপির ফাঁকে ছেলের বউকে বাড়ির সমস্ত কাজ করতে দেখেছি। বিকেলে যাদবজিকে গাছে জল দিতে দেখলে জেঠিমা আবার কেন যে হাই তুলে সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে ‘কারও তো কিছুই হল না, আমিই ভাবছি ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাব’ বলত, তারও কোনও কারণ কেউ কখনও খুঁজে পায়নি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভয়বাংলা। পর্ব ১৫: গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এসবেও চাচির রান্নায় কখনও বেঘাত ঘটেছে, তা নয়। ওরা পাশে বসেই খেত– আড্ডা তো আর মিস করা যায় না বাপু– বা উঠোনে পাতা খাটিয়া থেকে বড়ি এবং আচারের থালাগুলো সরিয়ে একপাশে প্রিকারিয়াসলি ঝুলে হাতে ধরা সানকি থেকে ইয়াব্বড়বড় গেরাসে ভাত আর লাউকির ঝোল নানারকম আচার সহযোগে সাঁটাত চড়বর চড়বর আওয়াজ করে। বিহারে চাচির বাড়ি যে গাঁয়ে, তার অনতিদূরে নেপালি বউরা ভেড়ার লোমের কম্বল বিক্রি করতে আসে প্রতি বছর কোনও এক মেলায়। বহু দূরে, সাত-আট দিনের পথ পেরিয়ে তাদের গ্রাম। বাবা একটা কিনেওছিল খুব সম্ভবত কুম্ভমেলা থেকে ফেরার পথে বেগুসরাইয়ের কাছে কোনও এক পাঞ্জাবি ধাবা মালিকের থেকে– সে কম্বল এখনও আছে। সে যাক। মেলার পর, বেচা-কেনা মিটলে ওই নেপালি মহিলারা তিন-চারটে মোষ কাটাত গ্রামের কষাইয়ের হাতে সামান্য পয়সা ধরিয়ে– তাকে একটা মাথা, বা কয়েকটা পা-ও দেওয়া হত বখশিশ স্বরূপ। খুব ভোজ হত দিন ১৫ অমানুষিক খাটুনির পর গ্রামে ফেরার আগে। সকলেই চার-পাঁচ কিলো শুকনো মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরত বাকি তৈজসের সঙ্গে। একপাশে মেলার মাঠে কালী মন্দিরে পুজোর মহা ধুমধাম। এরা প্রত্যেকে মনোস্কামনা মোতাবেক পুজোর উপাচার সাজিয়ে ডালা শুদ্ধু নদীতে চান সেরে নিজেদের ভাষায় গান গাইতে গাইতে যেত মন্দিরে– কয়েকটা নকুলদানা, চিমটিখানেক সিঁদুর, এক চাকলা নারকেল আর দুটো ধুপকাঠি থেকে এমনকী, কুঁচিটাক সোনাও মায়ের ভোগে চড়িয়ে ভক্তিভরে প্রণাম ঠুকে আসত মেয়েরা। প্রসাদের টুকরি পিঠের বস্তায় মাংসের সঙ্গেই পুরে ফিরতি পথ ধরলে কেউ কখনও আপত্তি জানায়নি– জানালে চাচি আমাদের বলত। ওদের গ্রামে এক নাপিত তিনবারের বেলা এগারো বছরের মেয়েকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করতে গেলে বজ্জাতের পো মোড়ল অবধি আপত্তি জানিয়েছিল। সুযোগ পেলেই সে গল্প বলবে রসিয়ে রসিয়ে, আর নেপালি মেয়েদের ঝুটঝামেলার গল্প বলবে না হয়?
জেঠু অবশ্য জেঠিমার ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকত। এটা ছিল আমাদের কমন নলেজ। রোজ সকালে বাজার থেকে একটু বজরি, শীতে খানিকটা পুঁটি, বোয়াল, আড় বর্ষায় এক ভাগা নদিয়ালি গজার চিংড়ি, গোটাকতক দারা সিং টাইপের মাগুর, কই, আর সস্তায় দিল বলে শঙ্কর মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে থানার পাশে একবালের দোকানে চা খাওয়ার কালে সে নিয়ে ভয়ানক মনোবেদনাও ব্যক্ত করেছেন বরাবর। মাছ-মাংস ছাড়লে জীবনীশক্তি কমে যায়, দাঁত পড়ে, চুল ওঠে, বেরিবেরি বা তার চাইতেও ভয়ানক রোগে বেঘোরে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ইত্যাদি ‘চাইলেই দেওয়া যায়’ জাতীয় হাতেগরম প্রমাণ-সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও ওখানেই জোগাড় হয়েছিল। সবাই সান্ত্বনা দিত। কমলের বড়দা, ‘তারাপদ শু হাউজের’ ন্যাশনাল ডিরেক্টার অবনীদা বললে, ‘অভ্যেস হয়ে যাবে, আপনি বরং তরকারিতে কম মশোল্লা খাওয়া শুরু করেন।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভয়বাংলা। পর্ব ১৬: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তারপর সে কী ঝামেলা ঝঞ্ঝাট চিল্লামিল্লি! জেঠু একহাতে বাজারের ব্যাগ আর অন্য হাতে রাবারের চটি উঁচিয়ে আস্তিন গুটিয়ে রেডি– ‘দুকান খুললে মাইরাই ফালামু।’ সকলে বুঝিয়ে শান্ত করলে বুড়ো ফোঁপাতে ফোঁপাতে যা বললে, তার সারমর্ম হচ্ছে, জেঠিমাকে কম মশলায় রান্না করতে বলায় নাকি তিনি বুড়োর ঝোল পেঁপে কাঁচকলা গাঁদাল পাতা আর জিরে বাটায় সেরে নিজের শঙ্কর মাছ রেওয়াজি খাসি আর রায়গঞ্জের বড় কাতলা-টাতলা আজকাল পেঁয়াজ আদা রসুনে কষিয়ে রাঁধা শুরু করেছে। সঙ্গে ‘কারও তো কিছুই হল না, আমিই ভাবছি ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাব’ ইত্যাদিও চলছে। সে একেবারে টেরিবল অবস্থা। বুড়ো আপত্তি জানানোয় অনেকটা পিছন ফিরে আঁচল দিয়ে থালা ঢেকে গপাগপ খাচ্ছে, নাহলে রান্নাঘরের এককোনায় বসে চেঁচিয়ে বলছে, ‘ভেজিটেরিয়ান হয়ে গেলে তো ছোঁয়াছুয়ি মানতে হবে, তাই এখন থেকে প্যাকটিস কচ্ছি।’ জেঠু হাত থেকে জুতো নামায় না কিছুতেই। ‘হালায় বাপের দুকানে বইস্যা বিড়ি ফুঁইক্যা ন্যাশনেলের ডির্যাক্টরি আইz আমি ঘুচাইয়া দিমু।’ এদিকে অবনীদা বেপাত্তা। শোনা গেল, হাটে বড় তেঁতুল গাছের তলায় তার অস্থায়ী ওপেন এয়ার উইকলি শোরুমটিতেও সে নেই। কমল বললে, ‘ফিরে আসবে, বউদি মনে হয় আবার পেগনেন্ট। পালিয়েছে বাপের ভয়ে।’
একটু ঘুরিয়ে কথা বলা আমাদের সময়কার কেতাবাজদের রেওয়াজ ছিল। স্কুলে যাওয়ার আগে ভাতের থালায় শেষ চাটন দিয়ে কমলকেই বলতে শুনেছি ‘আজ ডালটা একেবারে ফাশক্লাশ। বিপিন বাপ মারা যাওয়ার পর এরকম সাবুগোলা খেত রোজ সকালে। এখন থেকে অভ্যেস করলে পরে কষ্ট কম হবে’ বলেই এক ছুটে রেললাইন পেরিয়ে স্কুলে। কাকিমা কাউকে না পেয়ে আমার পায়েই হাতার বাড়ি বসালে– ‘জানোয়ার, এই শিখিস তোরা স্কুলে?’ তারপর আবার কানমলাও জুটল। কী আর করবে, ঝাল মেটাতে কাউকে চাই তো!