ইন্ডিয়া ইজ ফেমাস ফর হোয়াট?– প্রশ্নটা আমাকেই। ইন্ডিয়া কী জন্য বিখ্যাত? কী সহজ প্রশ্ন, কী কঠিন উত্তর। কী বলি? এমারসন আমাকে বাঁচায়। বলে– ‘গ্যানডি, গ্যানডি। অ্যান্ড ডরজিলিঙ টি। অ্যান্ড…’ আমার মুখের দিকে তাকায় এমারসন। আমায় কিছু যোগ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায় বলে লাভ নেই, চিনবে না। কী বলি? ভারতের বিখ্যাত কিছু বলতে হবে। দুর্নীতি, জাতপাত– এসব তো বিখ্যাতই তবে বাইরের দেশে কি বলা যায়? আমি হুট করে বলে দিই, ‘ম্যাঙ্গো, ম্যাঙ্গো। ইন্ডিয়া ইজ দি ল্যান্ড অফ ম্যাঙ্গো।’
১৩.
ফ্রাঙ্কফুর্টের আন্তর্জাতিক বইমেলায় ২০০৬ সালের ‘থিম কান্ট্রি’ ছিল ভারত। উদ্বোধক ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। এই উপলক্ষেই একদল ভারতীয় লেখকও আমন্ত্রিত হয়েছিল। আমার সেবার শিকে ছিঁড়েছিল। শুধু ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অংশগ্রহণই নয়, জার্মানিতে প্রায় এক মাস অবস্থানও সম্ভব হয়েছিল। তিন সপ্তাহ বার্লিন, এক সপ্তাহ ফ্রাঙ্কফুর্টে থেকেছি। অনেক টুকরোটাকরা ঘটনার স্মৃতি এখনও ঝুমঝুমির মতো বাজাই।
বার্লিনে যে-বাড়িতে ছিলাম, সেই বাড়িটির একতলায় বইপত্র বিক্রি হয় এবং রেস্তরাঁ, দোতলায় অডিটোরিয়াম, তিনতলায় অফিস, চারতলায় অতিথিনিবাস। এটি ‘গ্যেটে ইনস্টিটিউট’-এর বাড়ি। একটি মেয়ে এসেছিল, রেডিও কালটুর (কালচার)-এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিতে। আমি নানাজনকে উপহার দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম কিছু ধূপকাঠি, আমসত্ত্ব, টেরাকোটার পেপারওয়েট ইত্যাদি। মেয়েটিকে এক প্যাকেট ধূপকাঠি এবং আমসত্ত্ব দিয়েছিলাম। মেয়েটি পরে ফোন করে জানায় ‘অ্যামেজিং ফ্রাগরান্ট স্টিকস এবং হার্ড ম্যাঙ্গো কনসেন্ট্রেটেড’ পেয়ে ওর বয়ফ্রেন্ড খুব খুশি! ও কি তোমার সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারে? ও আরব এবং ইন্ডিয়া নিয়ে খুব উৎসাহী।’ আমি বলি, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
ছেলেটির নাম এমারসন। সে ঘরে ঢুকবার আগেই জুতো খুলতে লাগলে। বললাম, জুতো খোলার দরকার নেই চলে এসো। ও বলল, ‘আমি জানি, তোমাদের দেশের এটিকেট জুতো বাইরে রাখা, ইট ইজ ভেরি হাইজিনিক, অ্যান্ড সায়েন্টিফিক।’ এখনকার ছেলেমেয়েরা ইংরিজি জানে, বলে। যাদের জন্ম ১৯৫০ সালের আগে, তাঁরা বেশিরভাগই ইংরিজি জানেন না। ছেলেটি বলতে থাকে, ‘আরব এবং ভারত যখন মহাকাশ চর্চা করছিল, ইউরোপ তখন ১০০-র বেশি গুনতে পারত না। ভারত যদি মশলার ব্যবহার না শেখাতে, আমরা আজও ঝলসানো মাংস খেতাম। এই যে আমার গার্লফ্রেন্ড টিউলিপ, লিপস্টিক লাগাচ্ছে ঠোঁটে, ওটা তো কালার্ড ওয়াক্স। ইন্ডিয়া নাকি একটা পাতা পাওয়া যায়, ডিপ গ্রিন কালার, সামান্য চুন ঘষে চিবোতে হয়, তাতেই নাকি জিভ লাল হয়ে যায়, ঠোঁট লাল হয়ে যায়, অ্যাট দ্য সেম টাইম ডাইজেশনেও সুবিধা হয়।’ ইত্যাদি-প্রভৃতি নানা কথা বলে এমারসন ওর ওরিয়েস্টাল বিমুগ্ধতা প্রকাশ করতে থাকে। আমি ওকে চা করে খাওয়াই। ও জিজ্ঞাসা করে, ‘ডরজিলিঙ টি?’ আমি বলি, হতে পারে। ও আবার মুগ্ধ। এবার জিজ্ঞাসা করি, স্মোক কর? ও বলে, ‘ইয়েস উইথ শেম’। আমি বলি, এই অন্যায় ফর্মটি আমিও একটু করে ফেলি। কয়েক প্যাকেট বিড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম, একটা বিড়ি দিলাম। প্রথমে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলে, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করে ধরাব?’ আমি একটা ধরাই, তাই দেখে ও ধরায়। প্রথম ধোঁয়াটা ছেড়ে বলল, ‘অ্যামেজিং!’
বিড়ি নিয়ে পরে বিস্তারিত আরও বলব। ও লজ্জা লজ্জা ভাবে ওর গার্লফেন্ডের জন্য কয়েকটা চাইল। আমি দিলাম, ও কাগজে মুড়ে যত্ন করে বুকপকেটে রাখল। এরপরই আমার বন্ধু হয়ে গেল। আমাকে অনেককিছু দেখাল। ইহুদি পাড়া, বিয়ার পাব, নাইট ক্লাব, আরও কত কী। আমি ওকে একবার বললাম, আমাকে একবার একটা গ্রামে নিয়ে যেতে পারো এমারসন? খুব ইচ্ছে, জার্মানির গ্রামজীবন দেখি। বড় বড় শহর তো সারা পৃথিবীতেই প্রায় একই রকমের হয়। গ্রাম না দেখলে একটা দেশকে বোঝা যায় না। এমারসন একটু চিন্তা করে বলল, ‘হ্যাঁ, যাব, এখান থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূর, ওখানে ক্ষেত আছে, জমি চাষ হয়, লম্বা ফ্রক পরা মেয়েরাও আছে। একজন চাষির বাড়ি নিয়ে যাব। ভালোই হল, আমারও অনেকদিন শহরের বাইরে যাওয়া হয়নি।’
কংক্রিটের হাইওয়ের পাশ দিয়ে বেরনো হাইওয়ের বাচ্চা। তারপরে, সেই রাস্তা থেকে বের হল পিচের মসৃণ রাস্তা। দু’পাশে ক্ষেত। অনেকটা ফাঁকা জমি। এমারসন বলল, ‘জমি ফাঁকা রাখতে হয়। বেশি জমিতে চাষ হলে ফসলের উৎপাদন বেড়ে গেলে ফসলের দাম কমে যাবে। চাষির লাভ কম হবে। তাই হিসেব করে জমি ফাঁকা রাখতে হয়। যাদের জমি, তারা চাষ না করেও একটা টাকা এমনিই পেয়ে যাবে। চাষ না করার দাম। এমনিতেই এরা চাষের কাজে আসতে চায় না। আগেকার পূর্ব জার্মানি থেকে কিছু চাষিকে নানা সুবিধা দিয়ে আনানো হয়েছে। ওদেরকে তো দেখতেই হবে। চাষবাস না থাকলে তো খেতে পাব না। পুরোপুরি এশিয়া-আফ্রিকার ওপর নির্ভরশীল হলে কি চলে? নিজেদের আলুটা, স্ট্রবেরিটা, বার্লিটা তো করতে হবে। বার্লি না হলে বিয়ারটাও তো হবে না। চাষিদের বেশ পুতুপুতু করে রাখতে হয়।’
কয়েকটা ঘাসের ক্ষেত দেখলাম, মানে, মাঠ, শুধু ছোট ছোট ঘাস। দু’জন মেশিনে ঘাস কাটছে। ভাবলাম, ঘোড়ার ঘাস। জিজ্ঞাসাও করলাম। ও বলল, ‘এগুলো ফুটবল মাঠ। মাঠগুলো যত্ন করে রাখা হয়। প্রত্যেক ৫০০ মানুষ পিছু একটা করে মাঠ হচ্ছে।’ আমি বলি, জার্মানি তো ফুটবলের জন্য বিখ্যাত। এমারসন আমার দিকে এমন করে তাকাল যেন কলকাতার ট্রাকের পিছনের লেখাটা পড়তে পারলাম ওর চোখে– দেখলে হবে? খরচা আছে!
গাড়িটা থামাল এক জায়গায়। অনেকগুলো একতলা বাড়ি। দোতলাও আছে। বাড়িগুলোর ওপরে চিমনি। বেশিরভাগ বাড়িই তালা বন্ধ। এমারসন বলল, ‘বাড়ির মালিকরা কোনও শহরে কাজ-টাজ করে, হয়তো উইকএন্ডে আসে।’ বাড়িগুলোর ভিতরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। ফুলের গাছটাছ আছে। কোনও কোনও বাড়িতে বুড়োবুড়িদেরও দেখলাম। দু’-চারটে ঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘোড়ার ওপর পুরুষ বা নারী। এমারসন আমাকে বোঝাল, এই ঘোড়াগুলো যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয় না, মজার জন্য। ‘দে অল আর ফান হর্সেস।’ তবে কাঁধে দুটো বিনুনি ঝুলছে এমন কিশোরীও দেখা গেল, শহরে যা দেখা যায় না।
আর একটু এগিয়ে গেলাম পিচের মসৃণ রাস্তা দিয়ে। একটা বেশ বড় জমি কাঁটাতার ঘেরা। এমারসন বলল, ‘একজন চাষির সঙ্গে কথা বলতে চাও জানিয়েছিলে না? চলো, এই যে চাষির বাড়ি।’ ‘চাষি’ বোঝাতে গিয়ে এমনসন ‘ফার্মার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিল।
একটা গেট আছে, খোলাই ছিল। এমারসন ফোন করল মোবাইলে। আমরা ঢুকলাম না। অল্পক্ষণেই চাষি চলে এলেন, পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে টি-শার্ট, মাথায় হ্যাট, হাতে কুকুরের চেইন প্রান্ত। এমারসন পরিচয় করিয়ে দিল– ‘এই যে আপনার চাষি, জন হার্গেন’। হার্গেনকে আমার পরিচয় দিল এমারসন, একটা টিনের শেড পেরোলাম, ওখানে প্রচুর ভুট্টা ডাঁই করা। তারপর আর একটু এগিয়ে একটা বাড়ি। দোতলা, দোতলায় দুটো ঘর, বাকিটা খোলা ছাদ। একতলাতেই ওরা থাকেন বোঝা গেল। আমাকে ওদের বাইরের ঘরে বসাল। পাশেই একটা গ্যারেজ। ওখানে ট্র্যাক্টর, আরও সব কৃষি-যন্ত্রপাতি, আর দুটো গাড়ি। একটা ভ্যান ধরনের– বড়, আর একটা মাঝারি মাপের।
হার্গেন ইংরেজি বোঝেন না। এমারসন অনুবাদ করে দিচ্ছিল। হার্গেন বলছিল, “সাহিত্য বেশি বুঝি না। তবে টমাস মান, হারমান হেস-এর দু’-তিনটে বই পড়েছি। হেস তো ইন্ডিয়ার পটভূমিতে একটা বই লিখেছিলেন। সিদ্ধার্থ। তাই না? ইনডিয়া সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। ‘বুড্ঢা’ ওখানেই তো জন্মেছিলেন, তাই না? আমার ঘরে একটা ‘বুড্ঢা’র শো পিস আছে। আমার মেয়ের এক ফ্রেন্ড গিফ্ট করেছিল! ‘ইন্ডিয়া ইজ ফেমাস ফর হোয়াট?”
প্রশ্নটা আমাকেই। ইন্ডিয়া কী জন্য বিখ্যাত? কী সহজ প্রশ্ন, কী কঠিন উত্তর। কী বলি? এমারসন আমাকে বাঁচায়। বলে– ‘গ্যানডি, গ্যানডি। অ্যান্ড ডরজিলিঙ টি। অ্যান্ড…’ আমার মুখের দিকে তাকায় এমারসন। আমায় কিছু যোগ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায় বলে লাভ নেই, চিনবে না। কী বলি? ভারতের বিখ্যাত কিছু বলতে হবে। দুর্নীতি, জাতপাত– এসব তো বিখ্যাতই তবে বাইরের দেশে কি বলা যায়? আমি হুট করে বলে দিই, ‘ম্যাঙ্গো, ম্যাঙ্গো। ইন্ডিয়া ইজ দি ল্যান্ড অফ ম্যাঙ্গো।’
লাফিয়ে উঠল হার্গেন– ‘উন্ডেরবার! উন্ডেরবার! শেরগুট!’ আরও কত কী উচ্ছ্বাসের শব্দ বলে চলেছেন। এমারসন অনুবাদ করে দেয়, ‘দারুণ ব্যাপার। আম হল আমার প্রিয়তম ফল। এটা স্বর্গীয় ফল। এই ফলের মতো স্বাদ গন্ধ আর কিচ্ছুতে নেই। আপেল, স্ট্রবেরি, পিয়ারা সব কিছু আমের কাছে নাথিং। এখানে আমের ভীষণ দাম। তোমাদের দেশে আমের কেজি কত করে?’ তখন ভালো আম ২০ টাকার বেশি ছিল না। আমি বললাম, তোমাদের এক ইউরোতে আড়াই কেজি আম অনায়াসে পাওয়া যায়। এবার আরও বেশি লাফিয়ে উঠল হার্গেন। ‘বলো কী? আমরা তো এক কেজি কিনি ১০ ইউরোতে!’ এমারসন বলল, ‘তাও ব্রাজিলের আম। ইন্ডিয়ান আম এখানে পাওয়া যায় না। লন্ডনে খেয়েছিলাম। ওঃ এক্সিলেন্ট!’
হার্গেন জিজ্ঞাসা করে, ‘ বছরে তাহলে তোমরা অনেকবারই আম খাও, তাই না?’ আমি বলি– মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত রোজই একটা করে পাকা আম খাই। হার্গেন বলে, ‘রোজ? ভাবা যায় না। আমি বছরে দু’-একবার খেতে পারি। তোমরা তো স্বর্গে আছো হে।’
এমারসন বলে, ‘স্বর্গের বাকি আছে হার্গেন। তোমার কাছে বিড়ি আছে চক্রবর্তী?’ আমি বের করি। এমারসন হার্গেনকে একটা ধরিয়ে দেয়। হার্গেন চোখ বুঁজে ধোয়া ছাড়ে। বলে, ‘হিমেল! হিমেল!’
এমারসন বলে দেয়, ‘হেভেন! হেভেন!’ হার্গেন বলে, ‘নিশ্চয়ই খুব দামি, তাই না?’ আমি হিসেব করে বলি, তোমাদের এক ইউরোতে এরকম ১৫০টা বিড়ি হয়ে যাবে।
উচ্ছ্বাসে আবার লাফায় হার্গেন। মাতৃভাষায় উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হতে থাকে।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved