রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো হাজারো ফেরিওয়ালা, হকার, তাঁরাও আসলে নিজের জিনিসটি বিক্রি করার জন্য ক্যাচলাইন হাঁকেন। তাঁদের বলার ভাষা, গলার স্বর, সব মিলিয়েই দেখা যায় জ্যান্ত টলটলে বিজ্ঞাপনগুলি। আজ সেরকমই তিনটি বিজ্ঞাপনী কাণ্ড। নানা সময়ের, একসূত্রে বাঁধা গেল।
১০.
এটা আমার মতে অবশ্যই একটা গবেষণার বিষয় যে, দেশের বিভিন্ন শহরের ফেরিওয়ালারা শুধু শব্দব্রহ্ম নির্ভর করে কীভাবে তাঁর নিজের বা প্রোডাক্টের একটা আইডেন্টিটি তৈরি করে। এই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে প্রয়াত ঐতিহাসিক রাধাপ্রসাদ গুপ্তর কলকাতার ফেরিওয়ালার হাঁক-ডাকের বিষয়ে লেখা বইটির কথাই মনে পড়ছে। আমি এই কলকাতা শহরেরই কিছু ক্রিয়েটিভ ফেরিওয়ালার কথা বলব।
বিএ পাস বাদামওয়ালা
বিকেল হলেই এই ৪টে নাগাদ গলি থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসত। বিএ পাস.. বিএ পাস…আর চারপাশের বাচ্ছারা খেলা ছেড়ে হুড়মুড় করে দৌড়ত বিএ পাসের ডাকে। এ যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। এক ডাকে এতগুলো বাচ্চা খেলা ফেলে দৌড়চ্ছে। তক্কে তক্কে ছিলাম। এক রবিবার বিকেলে বিএ পাস আওয়াজ কানে আসতেই কাচ্চাবাচ্ছাদের সঙ্গে আমিও ছুটলাম। অবাক কাণ্ড! দেখলাম এক ঠেলা বাদাম নিয়ে হাসিমুখে বাচ্চাদের ছোট ছোট ঠোঙায় বাদাম ভরে দিচ্ছে গর্বিত বাদাম বিক্রেতা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিএ পাস’ কেন? সপ্রতিভ উত্তর, ’স্যর বিএ পাস করেও যখন পেট চালানোর জন্য বাদামওয়ালা হলাম, তখন নিজের একটা আইডেন্টিটি তৈরি করলাম। কাজও হল স্যার। দেখছেনই তো!’
শব্দব্রহ্মে দক্ষিণী ‘ধোসা’
এই শহরের অধিকাংশ পাড়ায় সন্ধে একটু গড়ালেই শুনতে পাওয়া যায়, এক অদ্ভুত শব্দ বা ঝংকার– যা আর বাকি শব্দ, যেমন টেলিভিশন, রেডিও, মিউজিক সিস্টেম, গাড়ি-ঘোড়া প্রভৃতির কান কালা করা শব্দকে ছাড়িয়ে আপনার কানে পৌঁছবেই। শব্দটির উৎস একটি গরম বেশ বড় মাপের মোটা লোহার তাওয়া, তাতে একটা মোটাসোটা লোহার খুনতির আঘাত। সেই অদ্ভুত শব্দ- ঝংকার পাড়া-প্রতিবেশীর নাকে কাল্পনিক লালা ঝরানো গরম ধোসার গন্ধ পৌঁছে দেবেই। আর পাড়ার বউরা একে একে সেই তপ্ত তাওয়ার পাশে ভীড় জমাতে শুরু করবে। ভাবুন তো, একটা লোহার তাওয়ার ‘টং’ শব্দটা কী সহজভাবে গরম ধোসার বিজ্ঞাপনের কাজ করছে!
জ্যান্ত সবজি
এটা লকডাউনের সময়।
সকাল থেকেই শুরু হত দুয়ারে বাজার। শাক-সবজি, মাছ, ফলমূল সব কিছুতেই ফেরিওয়ালার আধিক্য বেড়ে গিয়েছিল। তাদের নানারকম আওয়াজ গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে একটা নতুন আওয়াজ শুনলাম। এক ফেরিওয়ালা ‘জ্যান্ত সবজি, জ্যান্ত সবজি’ বলে চিৎকার করে চলেছে। জ্যান্ত মাছ শুনেছি, কিন্তু জ্যান্ত সবজি!
দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ছেলেটিকে ডাকলাম। হাসি হাসি মুখ করে সে এগিয়ে এল। বললাম, ‘জ্যান্ত মাছ শুনেছি, তোমার ওই জ্যান্ত সবজিটা কী ভাই?’ এক অর্ধ-শিক্ষিত ফেরিওয়ালার জবাব শুনে চমকে উঠলাম!
বিজ্ঞাপনী শিক্ষায় একটি বিষয় আছে, যাকে বলে ইউনিক সেল্স প্রপোজিশন। অর্থাৎ প্রোডাক্টকে ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করতে এক বিশেষ বিশেষণে ভূষিত করা। এই শিক্ষা নিশ্চিত ওকে কেউ দেয়নি। সে কত সহজভাবে বলল, ‘যেহেতু সব সবজিওয়ালারা বলে ‘টাটকা সবজি’ যেটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। তাই আমার সবজির দিকে ক্রেতাদের নজর কাড়তে ‘টাটকা’র বদলে ‘জ্যান্ত’ বলতে শুরু করলাম স্যর। বিক্রিবাটাও অনেক বেড়ে গেছে।’
বলে এককান এঁটো হাসি হেসে সে চলে গেল। আমি তো থ!