সরু সরু খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে চলেছি জেলেদের নৌকো করে, ওরা আমাদের মুখোশ পরিয়ে দিয়েছে, মাথার পিছনে যেন আরেকটা মুখ, বাঘকে ভড়কি দেওয়ার ফন্দি, বাঘ কি আর অত বোকা, ঘাড় মটকানোর হলে লাফিয়ে আসতেই পারে নৌকোয়। ফেরার সময় নৌকো থেকে নামতে গিয়ে আমার পা আটকে গেল এঁটেল মাটিতে, পড়ে যাই আর কী, কোনওমতে কাদা মাখামাখি করে উঠতে পারি সুব্রতদাকে ধরে। আরেকটা ছোট গ্রামে যাই জেলেদের পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে। কত আন্তরিক ওরা! এই হল প্রথম তথ্যচিত্র করতে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প।
১৪.
১৯৮৮ থেকে দূরদর্শনের জন্য তথ্যচিত্রের কাজ শুরু করি। প্রথম কাজ, সুন্দরবনের জেলেদের (স্থানীয় লোকেরা বলে ‘মাছ-মারা’) নিয়ে ‘ভাসমান পরম্পরা’। আমি ও সজয় দাশগুপ্ত যৌথভাবে পরিচালনা করলাম। স্ক্রিপ্ট লিখেছিল জিৎ সরকার, জিৎ তখন আমাদের সংবাদ পাঠক। ওই এই তথ্যচিত্রের কমেন্ট্রি করেছিল। এই বিষয়টি নির্বাচনের নেপথ্যে একটা গল্প আছে। শুটিংয়ে যাওয়ার মাস খানেক আগে আমরা দূরদর্শনের সহকর্মী বন্ধুরা এবং তাঁদের পরিবার মিলে লঞ্চে করে সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সলিলদা, সলিল দাশগুপ্ত– এই ট্রিপের আয়োজন করেছিলেন। সব্বাই মিলে দারুণ আনন্দ করেছিলাম ক’দিন! লঞ্চ সারাদিন চলছে, সন্ধের পর নোঙর ফেলে নিরাপদ স্থানে দাঁড়ানো, ঘন অন্ধকার চারিদিকে, দলে বেশ ক’জন বাচ্চা, তাদের মধ্যে আমাদেরই তো দুটো, তাদের নিয়ে গা-ছমছমে রাত্রিবাস। বাদাবন আর মাতলা নদীর সঙ্গে প্রেম তখন থেকে। লঞ্চে বসেই সুব্রতদা (ক্যামেরাম্যান সুব্রত কর) আর সজয়ের সঙ্গে ঠিক হল, নিজেদের প্রাণ সংশয়ের তোয়াক্কা না করে জীবিকার তাড়নায় সুন্দরবনের যে মানুষেরা যায় মাছ ধরতে, তাদের নিয়ে কাজ করব। মধু সংগ্রহকারীদেরও একইরকম জীবন সংশয় থাকে। বাঘের মুখ থেকে কেউ ফেরে কেউ ফেরে না।
এই ট্রিপেই আলাপ হল প্রদীপ ঘোষের সঙ্গে, লঞ্চটা তারই, নাম ‘অরুণা’। এই আলাপের সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে বন্ধুত্ব এবং রাজা দূরদর্শনের জন্য ‘সোঁদামাটি নোনাজল’ নামে যে ধারাবাহিক করেছিল আব্দুল জব্বারের ‘বাঙলার চালচিত্র’ অবলম্বনে, তার ব্যবস্থাপনার অনেকটাই প্রদীপ দায়িত্ব নিয়েছিল। সেই শুটিংয়ের সময়েও সুন্দরবন গেছি। ফিরে আসি ‘ভাসমান পরম্পরা’র কথায়। সরকারি তরফে সব ব্যবস্থা করে ছোট টিমে আমরা ক্যানিং থেকে রওনা হলাম লঞ্চে। বিকেলের আলো যখন পড়ে এসেছে তখন আমরা একটা গ্রামে বনবিবির পুজোর শুটিং করলাম। বনবিবির পুজো করে তবেই মাছমারার দল বেরয় যে-যার নৌকোয়। আমাদের রাত্রিবাস সজনেখালি রেস্ট হাউসে, টিমটিম করছে আলো।কোনও ক্রমে রাতটা কাটিয়ে ভোর থেকে বেরিয়ে পড়ি শুটিংয়ে। এদিনের শুটিং কিছুটা বিপজ্জনক ছিল। সরু সরু খাঁড়ির মধ্য দিয়ে চলেছি জেলেদের নৌকো করে, ওরা আমাদের মুখোশ পরিয়ে দিয়েছে, মাথার পিছনে যেন আরেকটা মুখ, বাঘকে ভড়কি দেওয়ার ফন্দি, বাঘ কি আর অত বোকা, ঘাড় মটকানোর হলে লাফিয়ে আসতেই পারে নৌকোয়। ফেরার সময় নৌকো থেকে নামতে গিয়ে আমার পা আটকে গেল এঁটেল মাটিতে, পড়ে যাই আর কী, কোনওমতে কাদা মাখামাখি করে উঠতে পারি সুব্রতদাকে ধরে। আরেকটা ছোট গ্রামে যাই জেলেদের পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে। কত আন্তরিক ওরা! এই হল প্রথম তথ্যচিত্র করতে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প।
দ্বিতীয় কাজ ‘কিংবদন্তীর বিষ্ণুপুর’, বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলি এবং তার অন্তরালে থাকা কিংবদন্তি– এই হল বিষয়। আর্কিওলজিক্যাল মনুমেন্টস নিয়ে আমার যে আগে খুব আগ্রহ ছিল, তা নয়। কিন্তু রাজার সঙ্গে ‘পুরাকীর্তির সংরক্ষণ’ তথ্যচিত্র শুটিংয়ের সময় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে আগ্রহ জন্মায়। হরিসাধন দাশগুপ্তর টেরাকোটা মন্দির নিয়ে তথ্যচিত্র দেখার অভিজ্ঞতাও হয়তো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। সব মিলিয়ে মনে হল, ‘অনাদি অতীত’-এ প্রাণ সঞ্চার করা যাক। এই সময়ের কিছু আগে আলাপ হয় উৎপল চক্রবর্তীর সঙ্গে। বাঁকুড়ার ছান্দারে তাঁর ডেরা, অভিব্যক্তি নামে তাঁর একটি সংস্থা আছে। তাঁর ‘বিলুপ্ত রাজধানী’ নামে বইটি পড়ে কাজ করার ইচ্ছেটা প্রবল হল। আবার আমাদের সেই টিম সজয়, সুব্রতদা একজোট হই। বিষয়টি নিয়ে ঐতিহাসিক হিতেশরঞ্জন সান্যালের দ্বারস্থ হই। হিতেশদা স্ক্রিপ্ট করতে রাজি হয়ে যান।
প্রণবেশ সেন (বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথিকা পড়তেন, তার লেখক ছিলেন তিনি) তখন আকাশবাণী থেকে দূরদর্শনে যোগ দিয়েছেন এবং ‘ঘরের কাছে আরশিনগর’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেন। উনি যাচ্ছিলেন ওঁর কাজের জন্য রেকি করতে, আমরাও একই সঙ্গে অফিস অর্ডার বের করে নিলাম আমাদের কাজের জন্য রেকি করতে, অর্থাৎ ‘লোকেশন’ দেখতে যাব বলে। যাওয়ার পথে হিতেশদার কাছ থেকে স্ক্রিপ্ট তুলে নিলাম, আগে থেকে পুরো প্ল্যান করা থাকলে শুটিং টাইম কম লাগবে। বিষ্ণুপুর টুরিস্ট লজে একটা মাত্র ঘর পাওয়া গেল কোনওমতে, ‘যদি হয় সুজন…’ করে চারজনে থেকে গেলাম সেখানে। সকাল হতেই লোকেশনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া। যতবারই দেখি ওইসব মন্দির, ততবারই পোড়ামাটির নিপুণ কাজ দেখে চমকিত হই! সুব্রতদা স্টিল ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখছেন, দিনের কোন সময় কোন মন্দিরে কোনদিক থেকে আলো পড়ে, তার একটা আন্দাজ করে নেওয়ার জন্য।
সেদিনের বিকেলের কথা না বললেই নয়, কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যা সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকে। সূর্যের তেজ কমে আসছে, গোধূলির রং ধরেছে বিকেলের গায়ে, আমরা এসে বসেছি লাল মাটির উন্মুক্ত প্রান্তরে ছোট ছোট ঢিবির ওপর, দূরে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের চূড়াগুলি। প্রণবেশদা দরাজ গলায় গান ধরলেন, ‘দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে, তব দয়া…’ ব্যাকুল হৃদয় সত্যিই যেন কেঁদে মরছিল যখন উচ্চারণ করছিলেন, ‘দিও নাগো দিও না আর ধূলায় শুতে…’, ওই নিবেদন ছড়িয়ে পড়ছিল সন্ধের আকাশে।
হিতেশদাকে বলে এসেছিলাম, ফিরতি পথে দেখা করে যাব, সেইমতো গেলাম ওঁর বাড়ি। দরজা খুললেন, হিতেশদার মতোই এক দীর্ঘদেহী পুরুষ, ঘরের আলো অন্ধকারে কেবল মনে হল, বয়স যেন কিছু বেশি। ওঁর বাবা। বললেন, ‘হিতেশ কাল রাত্রে চলে গেছে।’
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
ঘুমপাড়ানি গান থেকে শুরু হয়ে বেডটাইম স্টোরি, ছবির বই হয়ে বেডসাইডে রাখার মতো বই বা অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসে মানুষকে উপনীত হতে হয় জীবনের গতির সঙ্গে। এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এসেছে এমপিথ্রি, অডিও বুক। কিন্তু মা-ঠাকুমার ঘুমপাড়ানি গান, সুরে বা বেসুরে গুনগুনিয়ে ওঠা লুলাবাই কিংবা বাবার কোল ঘেঁষে শুয়ে গল্প শোনার আরাম অগ্রাহ্য করা যায় না এখনও।