বিদ্যাসাগর সর্বদা নিজের টাকায় পরের হিতসাধন করতেন। ঠকলে নিজে ঠকতেন। তাঁর দয়াধর্মে জন-অর্থ ব্যবহার করতেন না। একবারই বিধবাদের পেনশনের জন্য জন-অর্থ সংগৃহীত হলে বিদ্যাসাগর তাতে যোগ দিয়েছিলেন তবে পদত্যাগ করতে বিলম্ব করেননি। রবীন্দ্রনাথ পল্লিপুনর্গঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নানা জায়গায় হাত পেতেছেন। নিজের নোবেল পুরস্কারের অর্থ গ্রামের হিতসাধনের জন্য মূলধন হিসেবে ব্যয় করেছেন। জমিদার হিসেবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষিকার্য চালানোর জন্য মহাজনের কাছে ঋণ নিয়ে ঠকেছেন। পরে বিশ্বভারতীর পল্লি-পুনর্গঠনের কাছে কেবল দেশের মানুষের কাছে নয় বিদেশের কাছেও হাত পেতেছেন। বিশ্বমানবের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছেন যে!
৪৭.
রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন জমিদারির সূত্রে। জমিদারের ধর্ম কী হওয়া উচিত– সে বিষয়ে তাঁর ভাবনার শেষ ছিল না। পিতার আদেশে জমিদারি দেখতে গিয়ে ‘জমিদারি প্রথার লোপ করা উচিত’ এমন বৈপ্লবিক ঘোষণা রবীন্দ্রনাথ করেননি ঠিকই, তবে হিতবাদী জমিদার হতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর অভিমত, রায়তকে সচেতন ও স্বাবলম্বী করাই জমিদারের কাজ। জমিদার বণিক নন, দীনভাবে আদায় করার উপায়গুলি খুলে রাখা তাঁর উদ্দেশ্য হতে পারে না। আবার প্রজার জন্য কেবল টাকা খরচ করাই কিন্তু যথেষ্ট নয়। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাহায্যে বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘এ কথা যেন না মনে করি যে দূরে বসিয়া টাকা ঢালিতে পারিলেই রায়তের হিত করা যায়। এ সম্বন্ধে একটি শিক্ষা কোনোদিন ভুলিব না। এক সময়ে আমি মফস্বলে কোনো জমিদারি তত্ত্বাবধান-কালে সংবাদ পাইলাম, পুলিসের কোনো উচ্চ কর্মচারী কেবল যে একদল জেলের গুরুতর ক্ষতি করিয়াছে তাহা নহে, তদন্তের উপলক্ষ করিয়া তাহাদের গ্রামে গৃহস্থদের মধ্যে বিষম অশান্তি উপস্থিত করিয়াছে। আমি উৎপীড়িত জেলেদের ডাকিয়া বলিলাম, তোরা উৎপাতকারীর নামে দেওয়ানি ও ফৌজদারি যেমন ইচ্ছা নালিশ কর্, আমি কলকাতা হইতে বড়ো কৌঁসুলি আনাইয়া মকদ্দমা চালাইব। তাহারা হাত জোড় করিয়া কহিল, কর্তা, মামলায় জিতিয়া লাভ কী। পুলিসের বিরুদ্ধে দাঁড়াইলে আমরা ভিটায় টিকিতেই পারিব না।’ (‘সভাপতির অভিভাষণ’, সমূহ)
জমিদার ভালো হলেই প্রজার ভালো হয় না। পীড়কের নানা গোত্র। এ-সমস্ত অভিজ্ঞতার কথা পড়লে মনে হয় জমিদারি বিষয়টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট ভেবেছিলেন। এ-ও বুঝেছিলেন জমিদার হিসেবে পল্লির উন্নয়ন করা কঠিন। প্রজারা তাঁকে ‘জমিদার’ বলে জানে। তাই হয় ভয় পায়, নয় অবিশ্বাস করে। সহজে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ যেখানে পল্লি পুনর্গঠনের কাজে যথার্থভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন সেখানে শান্তিনিকেতনের নিকটবর্তী গ্রামের মানুষদের সঙ্গে তাঁর জমিদার-প্রজা সম্পর্ক ছিল না, ফলে জমিদার এই আত্মপরিচয়ের বিড়ম্বনা তাঁকে সইতে হয়নি। অন্য বিড়ম্বনার অভাব ছিল না। অনেকেই এসব তাঁর নিতান্ত শখ বলে মনে করতেন।
তবে বিড়ম্বনা কি একরকম? অনেক রকম। একটি বিচিত্র পত্রের কথা বলা যাক। এ-পত্র যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন হিতবাদী জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নানা কর্মোদ্যমের সঙ্গে মানুষের পরিচয় হয়েছিল কিন্তু বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে পল্লি পুনর্গঠনের কাজ তখনও সুদূর ভবিষ্যৎ গর্ভে। পত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘কৃষক’ নামের সাময়িকীতে। লিখেছিলেন জনৈক অংশীদার।
পত্রকার জানিয়েছেন, দেওঘরে ‘উপনিবেশ’ স্থাপনের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। উপনিবেশ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি ভদ্রলোকেরা বিভিন্ন জনবিরল, অরণ্য ও প্রকৃতি সংলগ্ন ভূমিতে ‘উন্নয়ন’ প্রয়াসে বসতি স্থাপন করলে তাকে ‘উপনিবেশ’ বলা হত। সাহেবদের উপনিবেশ ভারতবর্ষ, আবার ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ভদ্রলোকেরা যেন সাহেবদের মতোই উপনিবেশ স্থাপন করছেন। সাহেবদের অনেকে মনে করতেন এদেশের উপকার করতেই তাঁদের উপনিবেশ স্থাপন! দেশজ উপনিবেশ স্থাপন বেশ লাভজনক ব্যবসা। উন্নয়নের জন্য মনুষ্য-বিরল অঞ্চলে চাষ-বাসের ব্যবস্থা, শিক্ষালয়, কৃষিকেন্দ্র এসব স্থাপন করতে টাকা লাগে। সে টাকা অনেকক্ষেত্রেই একার নয়। অর্থের জন্য দরপত্র বিজ্ঞাপিত।
‘কৃষক’ পত্রিকার বৈশাখ ১৩১৪ সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, ‘কিছুদিন পূর্ব্বে মাননীয় শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ সেন, শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীযুক্ত মির্জা সুজাত আলি ও শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদিগের নামে দেওঘরে উপনিবেশ স্থাপনের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ইহাতে অনেক লাভের কথা থাকে। লাভের কথা তাহার উপর দেওঘর স্বাস্থ্যপ্রদ স্থান এই কথা শুনিয়া অনেক ভদ্রলোক অংশগ্রহণ করিয়াছেন।’ পত্রকার তাঁর চিঠিতে সচেতন করে দিয়েছেন এই বলে যে, উপনিবেশে লাভ হবে না। যাঁরা লাভের কথা ভেবে লগ্নি করছেন তাঁদের ক্ষতির সম্ভাবনা। কারণ, স্কুল কলেজ হাসপাতাল তৈরির কথা হয়েছে। তার ব্যয়ভার অংশীদারদের বহন করতে হবে। আর পাথুরে জমিতে চাষও তেমন হবে না। সুতরাং অর্থলগ্নি অনুচিত, অংশীদারদের সাবধান হওয়া কর্তব্য।
অনেকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম দেখে কৌতুক জাগে! রবীন্দ্রনাথের নাম তাঁর অনুমতিক্রমে ব্যবহৃত হয়েছিল কি না বলা কঠিন। গ্রামোন্নয়নের প্রকৃত পরিকল্পনার সঙ্গে ভদ্রলোকের উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনার বিস্তর পার্থক্য। হিতবাদের খোলসে ব্যক্তিগত লাভের যে ঘটনা একালে পরিদৃশ্যমান, তা সেকালে খুব দেখা যেত না। তবে হিতসাধনের নামে জনগণের টাকার অপব্যবহার যে একেবারে হত না, তা নয়। বিদ্যাসাগর সর্বদা নিজের টাকায় পরের হিতসাধন করতেন। ঠকলে নিজে ঠকতেন। তাঁর দয়াধর্মে জন-অর্থ ব্যবহার করতেন না। একবারই বিধবাদের পেনশনের জন্য জন-অর্থ সংগৃহীত হলে বিদ্যাসাগর তাতে যোগ দিয়েছিলেন তবে পদত্যাগ করতে বিলম্ব করেননি। রবীন্দ্রনাথ পল্লিপুনর্গঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নানা জায়গায় হাত পেতেছেন। নিজের নোবেল পুরস্কারের অর্থ গ্রামের হিতসাধনের জন্য মূলধন হিসেবে ব্যয় করেছেন। জমিদার হিসেবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষিকার্য চালানোর জন্য মহাজনের কাছে ঋণ নিয়ে ঠকেছেন। পরে বিশ্বভারতীর পল্লি-পুনর্গঠনের কাছে কেবল দেশের মানুষের কাছে নয় বিদেশের কাছেও হাত পেতেছেন। বিশ্বমানবের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছেন যে!
কৃষক পত্রিকার খবরটি পড়ে, পত্রাঘাত দেখে তাই রবীন্দ্রনাথকে ‘বেওসাদার’ ভাবার দরকার নেই। হিতসাধন সত্যি সত্যি বড় বালাই। যা দিনকাল পড়েছে এবার হয়তো নির্মোহ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের নামে শুনতে হবে রবীন্দ্রনাথ অনৈতিক উপায়ে টাকা তুলেছিলেন!