আনন্দ আমাদের নিজের মধ্যেই। আমাদের কাজ অন্তরে মগ্ন হওয়া, অন্তরের দীপটিকে জ্বালানো। বুদ্ধদেব শেষ শয্যায়। একজন বললেন, আপনি চলে গেলে সব যে অন্ধকার হয়ে যাবে, কে-ই বা আলো দেখাবে। বুদ্ধদেব বললেন, জ্ঞানের প্রদীপ যে নিজের ভেতরেই জ্বলছে, সেই আলোকে অনুসরণ করো। ১৪ পর্বে লেখা এই ‘উদ্বোধনী’ কলামের, শেষ পর্ব।
আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চলছে। বিচিত্র সেই লড়াইয়ের গতি। কখনও বাইরের বিরুদ্ধতার সঙ্গে, কখনও নিজের সঙ্গে। এসবের উদ্দেশ্য একটাই– আমরা আনন্দ চাই, আনন্দময় জীবন চাই। তবে উপায়, আমরা অনেক সময়ই জানি না। জীবনে কোন বিষয়গুলি চাই, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে আমাদের মঙ্গল-অমঙ্গল। গীতায় রয়েছে মানুষই নিজের বন্ধু হতে পারে, আবার মানুষই পরিস্থিতিতে নিজের শত্রু হয়ে উঠতে পারে। কারণ মানুষের শুভ প্রচেষ্টা তার কল্যাণ করে, আবার প্রচেষ্টা যদি অশুভ হয়, তাই তার অমঙ্গল নিয়ে আসে। তাই বিচার করে পথে চলতে হয়।
আরও পড়ুন: ধর্ম আসলে গভীর অরণ্যে একলা হাঁটার মানচিত্র
কঠোপনিষদে রয়েছে শ্রেয় এবং প্রেয়-র কথা। কঠোপনিষদে রয়েছে যম ও নচিকেতার কথোপকথন। নচিকেতা বাজশ্রবার পুত্র। বাজশ্রবা ঋষিদের গোদান করবেন। কিন্তু সেসব গরু অতি নিকৃষ্ট মানের। তাঁর মনে আঘাত লাগল। পিতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাকে কোন ঋষির কাছে অর্পণ করবেন?’ একবার নয়, তিনবার পিতাকে এই প্রশ্ন করলেন নচিকেতা। পিতা রেগে গিয়ে বললেন, ‘তোমাকে যমের কাছে অর্পণ করলাম।’ পিতৃ আজ্ঞা পালনে তিনি গেলেন যমের কাছে। তিনি যখন যমের গৃহে গেলেন, তখন যম অনুপস্থিত। তাই তিনদিন নচিকেতা আতিথ্য গ্রহণ করলেন না। যম ফিরে এসে বললেন, তুমি অতিথি হয়ে তিনদিন আমার এখানে অনাহারে থেকেছে, তুমি তিনটি বর চাও। প্রথম বরে চাইলেন তাঁর পিতা যেন তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ না থাকেন, তাঁর প্রতি প্রসন্ন থাকেন। তিনি ফিরে গেলে তাঁকে যেন চিনতে পারেন এবং সুব্যবহার করেন। যম তাকে বর দিলেন যে, তাঁর পিতা তাঁকে দেখে চিনতে পেরে আগের মতোই স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করবেন। দ্বিতীয় বরে, স্বৰ্গকামী মানুষ যে-অগ্নিবিদ্যার সাহায্যে অমরতা লাভ করে, সেই অগ্নিবিদ্যা তিনি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জানতে চাইলেন। সে বরও নচিকেতা লাভ করলেন। এবার তৃতীয় বরে তিনি জানতে চাইলেন আত্মতত্ত্ব। বালক নচিকেতা জিজ্ঞাসু। এরপর যমরাজ বললেন অপূর্ব সব কথা– বিষয়: আত্মতত্ত্ব।
আরও পড়ুন: অন্তরে দেবত্ব প্রকাশিত হবে যে পথে
এই প্রসঙ্গেই এসেছে শ্রেয় আর প্রেয়’র কথা। এই দু’টিই মানুষের কাছে উপস্থিত হয়। প্রেয় আপাত সুখের, পরিণামে তা আমাদের হৃদয়ে যে পরম আনন্দ লাভের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তা মেটায় না। শ্রেয় অনেক সময় আপাত সুখের না হলেও, তা আখেরে আমাদের কল্যাণ করে। তাই প্রয়োজন বিচার-বিশ্লেষণ। জীবনে চলার পথে প্রেয় থেকে শ্রেয়কে আলাদা করে নিয়ে গ্রহণ করতে হয়। কারণ শ্রেয়ই কল্যাণপ্রদ। কোনও বস্তু শ্রেয় কি না, তা বুঝব কী করে? তার জন্য নিজের কাছে কিছু মানদণ্ড রাখা দরকার। আর তা পাওয়া যায় শাস্ত্র থেকে, মহাপুরুষদের জীবন থেকে। আনন্দ আমাদের নিজের মধ্যেই। আমাদের কাজ অন্তরে মগ্ন হওয়া, অন্তরের দীপটিকে জ্বালানো। বুদ্ধদেব শেষ শয্যায়। একজন বললেন, আপনি চলে গেলে সব যে অন্ধকার হয়ে যাবে, কে-ই বা আলো দেখাবে। বুদ্ধদেব বললেন, জ্ঞানের প্রদীপ যে নিজের ভেতরেই জ্বলছে, সেই আলোকে অনুসরণ করো। ‘আত্মদীপো ভব’– নিজেই নিজের দীপ হও। ধর্মকে আশ্রয় করে, শ্রেয়কে গ্রহণ করে পথ চললে মানুষ নিজ অন্তরে বিকশিত হয়, আনন্দে পূর্ণ হয়।