সুরমা-সুপ্রভা-সুহাসিনী তিনজনকেই সে সময়ের শিক্ষাজগত একডাকে চিনত। সুপ্রভা দাসগুপ্ত ছিলেন চট্টগ্রামের ডক্টর খাস্তগীর গার্লস স্কুলের ডাকসাইটে প্রধান শিক্ষিকা। বিশের দশকে সুপ্রভা যখন চট্টগ্রামে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস হয়ে যোগ দেন, তখন সেই স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন সুরমা। দিদি শান্তিপ্রভার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আগে থেকে ভালোই চিনতেন সুপ্রভা। চট্টগ্রাম পর্বে সূচনা হল সুরমা-সুপ্রভার কর্মক্ষেত্রে যৌথতা ও অন্তরঙ্গ সখ্যের। এই জুটির দৌলতে স্কুলের সুখ্যাতি ছড়াল বহুদূর। কয়েক বছর পর সুরমা যখন নতুন কাজের ভার নিয়ে ঢাকা চলে গেলেন ‘ইন্সপেক্ট্রেস অফ স্কুল’ হয়ে, কিছুমাত্র আলগা হল না সেই বন্ধন। শুরু হল ‘দোসর’, আজ প্রথম পর্ব।
১.
সুরমা-সুপ্রভা-সুহাসিনী সখী সংবাদ
এ গল্প লিখতে বসে মন জুড়ে আসন পেতেছেন গল্পের মূল কথক। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটি পুরনো তেতলা বাড়ির একতলার লম্বা বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট আসছে, আমরা ঘরে ঢুকে বাগানে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কথা বলছি। সঙ্গে চা, চিড়েভাজা-আলুভাজা অথবা ওইরকমই কোনও ঘরোয়া জলখাবার।
যাঁকে নিয়ে আজকের সখী সংবাদ নয়, কিন্তু যাঁর মুখে তাঁর স্যুইটমাসি-মিনিমাসি-নেড়ুমাসির কথা আমি শুনি ১৫-১৬ বছর আগে, তিনি আবার আমার এক মাসি। শ্রীলা সেন, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভীকের মা। মাসিমা সেন (এই নামেই আমরা, অভীকের সহপাঠীরা, তাঁর উল্লেখ করতাম) বহু মানুষকে চিনতেন, অনেকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল এবং গল্প বলতে পারতেন দারুণ জমিয়ে। কলকাতার পাঠ ভবন স্কুলে সবাই তাঁকে জানত ‘পাপড়িদি’ বলে।
সেবার বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে, কথা বলেছিলাম ১৯৩০-’৪০-এর সময় ওই ইশকুলের কিছু প্রাক্তনীর সঙ্গে, যাঁরা ঢাকা-কলকাতা মিলিয়ে তখনও ছিলেন বেশ কয়েকজন। মাসিমা দেশভাগের পর দিনাজপুর থেকে কলকাতা চলে আসতে বাধ্য হন। ১৯৪৮-এ ভর্তি হন সাখাওয়াতে। গভীর মানসিক আঘাতে তখন ক্লাস নাইনের মেয়েটি রুগ্ন। সে বছরই ওই স্কুলে ঢাকা থেকে এসে হেড-মিস্ট্রেস হন সুহাসিনী বিশ্বাস, মাসিমার নেড়ুমাসি। তিনের দশকে কুমিল্লার ফৈজুন্নিসা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে আগেই তিনি সুনাম কুড়িয়েছিলেন।
নেড়ুমাসি কী করে মাসিমার মাসি হলেন? এইবার গল্পটা সখী সংবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
………………………………………………..
সুরমার বোন সুহাসিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপানের ফুকুসিমা বন্দিশিবির থেকে ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে ফিরে প্রথমে দিদির বাসায় উঠেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ইন্সপেক্ট্রেস হওয়ার দরুন সুরমাকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে যেতে হত। সেই কারণে ১৯৪৬-’৪৭-এর অনেকটা সময় ২৬ র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে বন্ধুর বাড়িতে থেকে সুহাসিনী ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধার করেন। মাসিমা বলেছিলেন, ওই সময় তাঁর নেড়ুমাসির সব দাঁত পড়ে গিয়েছিল। প্রবল অপুষ্টি, ভীষণ দুর্বল তিনি তখন। আর তাঁর গায়ের চামড়া পুড়ে মিশকালো। বন্দিদশায় বছর তিনেক অর্ধাহার ও নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয় তাঁকে, যেমন বরফের উপর হাঁটানো, রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা।
………………………………………………..
মাসিমারা ব্রাহ্মসমাজের। ওঁর মা শান্তিপ্রভা নাগ (অ্যানি) অঙ্কের মেধাবী ছাত্রী ও নামকরা শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর অনেক কাজের মধ্যে একটি হল, ১৯৩৫ থেকে পরম যত্নে ও শিক্ষক-স্বামীর সহযোগিতায় দিনাজপুর গার্লস হাই স্কুল গড়ে তোলা। শান্তিপ্রভার স্বামী নির্মলচন্দ্র ঢাকা থেকে দিনাজপুরে গিয়ে ওই ইশকুলেই ইংরেজি পড়ানোর কাজ নেন। শুনেছি, প্রধান শিক্ষিকা স্ত্রীর সঙ্গে ইশকুলে কাজ করতে তিনি সম্পূর্ণ স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তাঁর ‘পৌরুষে’ ঘা লাগেনি। শান্তিপ্রভা-নির্মলচন্দ্র নাগের যৌথতার আখ্যানটিও অনবদ্য। কিন্তু আজ সে গল্প থাক।
বিশ শতকের অবিভক্ত বাংলায় শান্তিপ্রভার যে বেশ কয়েকজন বান্ধবী থাকবে শিক্ষাক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। তাঁদেরই মধ্যে দু’জন সুরমা বিশ্বাস ও তাঁর ছোট বোন সুহাসিনী। তাঁরা যে শুধু শান্তিপ্রভার খুব কাছের মানুষ ছিলেন তা-ই নয়, তাঁর পুরো পরিবারেরই আপনজন ছিলেন এই দুই বাঙালি খ্রিস্টান শিক্ষাবিদ– সুরমা ও সুহাসিনী। মাসিমার স্যুইটমাসি ও নেড়ুমাসি এবং তাঁর কথায়, ‘আমার রোলমডেল’। আর মাসিমার মায়ের পেটের বোন হলেন সুপ্রভা– মিনিমাসি। অ্যানির বোন মিনি।
স্যুইটমাসি-মিনিমাসি-নেড়ুমাসি, তিনজনকেই তখনকার দিনে শিক্ষাজগতে সকলে একডাকে চিনত। মিনি বা সুপ্রভা দাসগুপ্ত ছিলেন চট্টগ্রামের ডক্টর খাস্তগীর গার্লস স্কুলের ডাকসাইটে প্রধান শিক্ষিকা। বিশের দশকে সুপ্রভা যখন চট্টগ্রামে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস হয়ে যোগ দেন, তখন সেই স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন সুরমা। দিদি শান্তিপ্রভার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আগে থেকে ভালোই চিনতেন সুপ্রভা। চট্টগ্রাম পর্বে সূচনা হল সুরমা-সুপ্রভার কর্মক্ষেত্রে যৌথতা ও অন্তরঙ্গ সখ্যের। এই জুটির দৌলতে স্কুলের সুখ্যাতি ছড়াল বহুদূর। কয়েক বছর পর সুরমা যখন নতুন কাজের ভার নিয়ে ঢাকা চলে গেলেন ‘ইন্সপেক্ট্রেস অফ স্কুল’ হয়ে, কিছুমাত্র আলগা হল না সেই বন্ধন।
ঢাকার রমণায় সুরমা যে সরকারি বাংলো পেলেন, সেই বাড়িটা হয়ে উঠল মাসিমাদের দ্বিতীয় বাপের বাড়ি। ঢাকার র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে শান্তিপ্রভাদের বাড়িটাও ছিল সুরমা-সুহাসিনীর নিজের জায়গা। সুরমার বোন সুহাসিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপানের ফুকুসিমা বন্দিশিবির থেকে ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে ফিরে প্রথমে দিদির বাসায় উঠেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ইন্সপেক্ট্রেস হওয়ার দরুন সুরমাকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে যেতে হত। সেই কারণে ১৯৪৬-’৪৭-এর অনেকটা সময় ২৬ র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে বন্ধুর বাড়িতে থেকে সুহাসিনী ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধার করেন। মাসিমা বলেছিলেন, ওই সময় তাঁর নেড়ুমাসির সব দাঁত পড়ে গিয়েছিল। প্রবল অপুষ্টি, ভীষণ দুর্বল তিনি তখন। আর তাঁর গায়ের চামড়া পুড়ে মিশকালো। বন্দিদশায় বছর তিনেক অর্ধাহার ও নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয় তাঁকে, যেমন বরফের ওপর হাঁটানো, রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা।
ফৈজুন্নিসা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার এ অবস্থা কেন? ১৯৪১-এ সুহাসিনীর একটা সুযোগ এসেছিল অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনের সহায়তায় অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার। যুদ্ধ চলা সত্ত্বেও নির্ভীকচিত্তে বিদেশে পাড়ি দেন তিনি এবং অস্ট্রেলিয়ায় কাজ শেষ করে ১৯৪২ সালে দেশে ফেরার জাহাজে ওঠেন। কিন্তু মাঝপথে তাঁদের জাহাজ এস.এস. ন্যানকিন জাপানি আক্রমণের মুখে পড়ে এবং সব যাত্রীরা হয়ে যান যুদ্ধবন্দি বা ‘prisoner of war’। ফুকুসিমায় এভাবেই পৌঁছন তিনি।
‘গীতাঞ্জলি’-র একটি কপি সঙ্গে ছিল তাঁর। সুহাসিনী জাপানি-ক্যাম্প কর্তৃপক্ষকে ধোঁকা দেন এই বলে যে, ওই বইটি আসলে বাংলায় বাইবেল। গভীর সংকট কালে সেটি আঁকড়ে, গানের পাশে পাশে কিছু মনের কথা লিখে, যুদ্ধশেষে ঘরে ফেরেন মাসিমার নেড়ুমাসি। বছর দুই চিকিৎসা ও বিশ্রামে কাটাতে না কাটাতেই হয়ে যায় দেশভাগ।
১৯৪৮-এ তাঁর প্রাণপ্রিয় চট্টগ্রাম ও ডক্টর খাস্তগীর গার্লস স্কুল ছেড়ে চলতে আসতে হয় সুপ্রভাকে। বদলি হয়ে যান জলপাইগুড়ি গার্লস হাই স্কুলের প্রধান হয়ে। আর সুরমাকে ছাড়তে হয় ঢাকা। কলকাতায় উদ্বাস্তু পুর্নবাসন দপ্তরে কোনও একটা পদে যোগ দেন তিনি। তবে স্যুইটমাসি-মিনিমাসি-নেড়ুমাসির বন্ধুত্বে কোনও ছেদ পড়েনি। বরং দু’-চার বছর পর অবসর জীবনে আরও কাছাকাছি আসেন তাঁরা। বিশেষ করে সুরমা ও সুপ্রভা।
এঁদের ভাই-বোন, ভাইপো-ভাইঝি-বোনপো-বোনঝি এবং আরও অনেক রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয় নিয়ে জমজমাট পরিবার ছিল। সেইসব পরিবারের মানুষের সঙ্গে এঁদের যাতায়াত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের বাইরেও এই স্বাধীনচেতা মেয়েরা অন্যরকম পরিবার তৈরি এবং যৌথতায় বিশ্বাসী ছিলেন।
পাঁচের দশকের গোড়ায় সুরমা ও সুপ্রভা গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতনে এক আস্তানা, পূর্বপল্লির রেললাইনের ধারে জনহীন প্রান্তরে। সুপ্রভা সেখানেই থাকতেন ১৯৭২-’৭৩ সাল অবধি। তারপর স্ট্রোক হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় কলকাতার দিলখুশা স্ট্রিটে দিদির বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হন। ১৯৫৩-’৫৪ থেকে, সুরমা এ শহরের মালেন স্ট্রিটে তাঁর বাপের বাড়িতে কিছুদিন করে থাকতেন এবং বাকি সময়টা সুপ্রভার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে। সুপ্রভা অসুস্থ হয়ে পড়ার কিছুদিন আগে সুরমার মৃত্যু হয়।
কলেজ পড়ুয়া মাসিমা প্রায়ই যেতেন শান্তিনিকেতনে মাসির বাড়িতে। তাঁর স্যুইটমাসি-মিনিমাসি দু’জনে নাকি ছিলেন সম্পূর্ণ দু’রকম। ভীষণ শৌখিন স্যুইটমাসি খুব সুন্দর করে নতুন বাড়ির সব ঘর সাজাতেন, নিজে হাতে বাগানটা তৈরি করেছিলেন। রান্নাবান্নাতেও ওস্তাদ। উনি থাকলে নিত্যনতুন খাওয়াদাওয়া হত। রবিবার গির্জায় যাওয়ার কোনও পাট ছিল না সুরমার। সকালে উঠেই মুরগির রোস্ট রাঁধার পরিকল্পনা হত বরং। অন্যদিকে, সুপ্রভা রান্নাঘরের ধারেপাশেও যেতেন না, সারাদিন পড়াশোনা করতেন। যেদিন সুরমা কলকাতায় যাওয়ার ট্রেন ধরতেন, সেদিন সুপ্রভা বোনঝিকে বলতেন, ‘আজ আমরা দুধ-মুড়ি-কলা খেয়ে চালিয়ে নেব, কেমন?’
…………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………………..
বাগানবিলাসী, শৌখিন, রন্ধনপটিয়সী মাসিমার কাছে স্যুটিসমাসি কেন ‘রোলমডেল’ ছিলেন, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। নেড়ুমাসি কেন– এটা জিজ্ঞেস করায় মাসিমা বলেছিলেন, ‘for her grit, determination and zest for life’। যুদ্ধশেষে বন্দিশিবির থেকে ছাড়া পাওয়ার স্বস্তিতে যখন সকলে ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত, তখন সুহাসিনী বিশ্বাস নাকি জাপানিদের বলেছিলেন– ‘এতদিন তোমাদের দেশে থাকলাম, তাও চেরি ব্লসম দেখা হলো না! যাই বলো বাপু, আমি কিন্তু চেরি ব্লসম না দেখে দেশে ফিরছি না’।
ছবি ঋণ: জয়তী গুপ্ত, সুনীপা বসু, শর্মিষ্ঠা দাস