প্রথমে ছেলেদের তো ধরেবেঁধে আনা হল। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন। কেউ নাচতে রাজি নয়। ওদের কাছে নাচটা মেয়েদের ব্যাপার। মেয়েরা আবার অন্যদিকে খুব খুশি। আমি প্রথমদিন ওদের সঙ্গে আলাপ করলাম, নিজেকে চেনালাম। বললাম, আমি কোনও দিনও তোমাদের জিজ্ঞেস করব না কেন তোমরা এখানে। লিখছেন অলকানন্দা রায়।
১.
জীবনে তেমন কোনও পরিকল্পনা ছিল না আমার। এই বয়সে এসে বুঝতে পারি, তেমন কোনও উচ্চাশাও ছিল না। নাচতে ভালবাসি, কিন্তু পারফর্ম করতে ভালবাসি না। আমাকে কেউ একান্তে নাচতে বললে, ভীষণ খুশি হয়ে নাচব। কিন্তু সবসময় স্টেজে উঠতে ভাল লাগে না। কস্টিউম পরো, মেকআপ করো– এই বাঁধাধরা ছকে হাঁপিয়ে উঠতাম। বুঝতে পারতাম, একটা জিনিস চাই আমার, যেটা না পেলে হাঁপিয়ে উঠব। সেটা হল মুক্তি, স্বাধীন হওয়ার অদম্য ইচ্ছা। সেই জন্যই বোধহয় ছোট থেকেই অন্যের স্বাধীনতাকেও সম্মান দিতে শিখেছিলাম আমি। গোটা অডিটোরিয়ামে কেউ নেই, আমি একা মঞ্চে নাচছি– এটাই শুধু চেয়েছি। কিন্তু হলভর্তি লোকের সামনে, কস্টিউম পরে, মেক আপ করে নাচছি– হাঁপিয়ে উঠছিলাম আমি ক্রমশ। আমার ছাত্রছাত্রীদেরও সেটাই বলি সবসময়। আমার থেকে নাচটা শেখো, টেকনিকটা শেখো, কী বলতে চাইছি, জেনে নাও, কিন্তু আমাকে অনুকরণ করো না। তোমার শরীরটা আমার থেকে আলাদা, তাই তোমার শরীরী ভাষাটাও তোমার মতো করে চলবে, তোমার কথা শুনবে। তোমার শরীর তোমাকে কী বলছে, সেটা শোনো। নিজের কথায় কান দাও।
প্রথমবার যখন জেলে গিয়েছিলাম, এই কথাটাই শুধু মনে হচ্ছিল সেদিন। শুধু তো অপরাধের জন্য তারা বন্দি, তা তো নয়। তাদের হাত-পা যেন সর্বত্র বাঁধা। যতই ভাল ভাষায় আমরা বলি যে, এটা সংশোধনাগার, কিন্তু দিনের শেষে তা জেল-ই। ওদের নিয়মগুলো গোটা সমাজের থেকে আলাদা। ওখানে কেউ স্বাধীন থাকতে পারে না। তবে বাইরেটাও আলাদা কিছু নয়। ওদের এটাই বলি বারবার, আমরাও সমাজ-সংসারে বন্দি। ফলে, আমরা তখনই বুঝব আমরা মুক্ত, যখন আমাদের অন্তর মুক্ত হবে। যে কারণে ওদের বারেবারে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ নাচটা শেখাই। ওরা প্রত্যেকে এই গানটা জানে।
২০০৭ সালের ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবসে প্রথমবার প্রেসিডেন্সি জেলে যাই, ফিমেল ওয়ার্ডে, ওদের একটা অনুষ্ঠান ছিল, তারই বিশেষ অতিথি হিসাবে। যদি আমি পরের বছর যেতাম, তাহলে কিন্তু আমি প্রেসিডেন্সি জেলে যেতাম না। পরের বছরই তৈরি হল আলিপুর উওমেন্স জেল। সেখানেই যেতাম আমি। তাহলে এই গোটা ঘটনাটাই ঘটত না।
অনুষ্ঠানটা যেখানে হবে, সেখানে তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছি। ঢুকে অবাক আমি, এটা জেল নাকি? সিনেমায় যেমন দেখি, কই তেমন তো নয়। এ তো দেখি খোলা মাঠ, বড় বড় গাছ। তখন তাড়া ছিল বলে, গাছপালাই দেখেছি শুধু, মানুষগুলোকে ভাল করে লক্ষ করিনি। অনুষ্ঠানটা হয়ে যাওয়ার পর মেয়েরা জিজ্ঞেস করে পাঠাল, আমি ওদের নাচ শেখাতে পারি কি না। আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যাই। আর পাঁচজনের মতো আমারও কৌতূহল ছিল, ওদের জীবনটা কীরকম, সেটা জানার। ওরা মানুষ হিসাবে কীরকম, সেটাও জানতে ইচ্ছে করছিল খুব। ওখান থেকে যখন বেরিয়ে আমি জেলটা ঘুরে ঘুরে দেখা শুরু করি, তখন আমি প্রথম লক্ষ করি ছেলেদের। হঠাৎ কী হল কে জানে, ওদের দেখে ওদের মায়েদের কথা মনে হচ্ছিল খুব। আমি জিজ্ঞেস করে ফেলি আইজি মি. শর্মাকে। আমি কি ছেলেদেরও শেখাতে পারি? শুনে উনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভয় করবে না? আমি খুব নিশ্চিত হয়ে বলেছিলাম সেদিন, ওরা কী করবে আমার? আমার কোনও ভয় নেই। সবাই আমার ছেলের বয়সি। শেষমেশ উনি রাজি হলেন। সেই থেকে শুরু।
প্রথমে ছেলেদের তো ধরেবেঁধে আনা হল। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন। কেউ নাচতে রাজি নয়। ওদের কাছে নাচটা মেয়েদের ব্যাপার। খুব স্বাভাবিক ওদের এই ভাবনাটা। মেয়েরা আবার অন্যদিকে খুব খুশি। মেয়েরা ছিল সংখ্যায় দশজন মতো। আমি প্রথমদিন ওদের সঙ্গে আলাপ করলাম, নিজেকে চেনালাম। বললাম, আমি কোনও দিনও তোমাদের জিজ্ঞেস করব না কেন তোমরা এখানে। এটা আমার জানার কথা নয়। আর আমি তোমাদের এমন কোনও নাচ শেখাব না, যাতে তোমরা অস্বস্তি পাও। আমি শুরুই করব মার্শাল আর্ট, ক্যারাটে, কুংফু, কালারিপাট্টু দিয়ে। ওরা যেন হাতে চাঁদ পেল এটা শুনে। খুব খুশি হয়ে নাচতে শুরু করল।
ধীরে ধীরে ভারতীয় লোকনৃত্যের সঙ্গে ওদের পরিচয় করালাম। ডান্ডিয়া, ভাংড়া। অসম্ভব উপভোগ করতে শুরু করল সবাই। ওই তাল, ছন্দ, গান শুনে ওরা প্রথম দিনেই উত্তেজিত হয়ে পড়ল। নাচটা এমন একটা জিনিস, যা শরীর, মন, আত্মাকে একটা বিন্দুতে এনে ফেলে। একটা মহৎ একাত্মবোধ যেন ঘিরে ফেলে তখন। আমি শুধু ওইটুকুই করেছি, ওদের ফিজিক্যাল এনার্জিটা চ্যানেলাইজ করে দিয়েছি। খেলাধুলোও অনেকটা তাই, কিন্তু খেলায় একটা প্রতিযোগিতা আছে, একটা শক্তি প্রদর্শন আছে। নাচে সেটা নেই। নাচে সবাই মিলে, একসঙ্গে একটা কিছু করা। যে লোকনৃত্য শুরু করল ওরা, আরও ছেলেরা এসে যুক্ত হল। সংখ্যাটা শেষমেশ দাঁড়াল ৬০ জন। এতদিন ওরা দূর থেকে দেখত, সামনে আসত না। একজন একজন করে এগিয়ে আসতে শুরু করলে ওরা দল বেঁধে যোগ দিতে শুরু করল। পুরো পরিবেশটা বদলে গেল যেন তারপর। ওরা এত আনন্দ পেতে শুরু করল যে, যারা ভেতরে কাঠের কাজ করত, তারা ডান্ডিয়া বানাতে শুরু করল। কত যে কারুকাজ তার মধ্যে। মুক্তো বসানো, জরি বসানো– সে যে কী হইহই ব্যাপার! আমি দেখেশুনে হেসে মরে যাই, বলি, ওরে, এটা তো আর ডান্ডিয়া নেই, কৃষ্ণের বাঁশি হয়ে গিয়েছে রে!
একজন অবতার-পুরুষ যুগকে কেন্দ্র করেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই যুগের ব্যাধি, বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে কখনও ভুল করতে পারেন? আমরা এইবার কথামৃত পাঠ করব। ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু ভগবানের কথা স্মরণ ও ভাবার প্রয়োজন।