বন্দুকের জোরে নয়, আরও কোনও সুচতুর কায়দায় দখল হচ্ছে জমি। খেতমজুরদের দিয়ে যে কাজ করানো হচ্ছে, তা মোটেই কৃষিকাজ নয়। তা বস্তা বওয়ার। তৈরি হচ্ছে পেশার সংকট।
৫.
পঞ্চায়েতবাবু দেবেশ্বর মাজি ঘোষণা করেছিলেন এলাকায় একটা ছোট সিমেন্ট কারখানা হবে। অনেকে বুঝে, অনেকে না-বুঝে হাততালি দিয়েছিল। এই বিপদের যে ঠিক কীরকম, সেটা সম্প্রতি মাথা চাড়া দিতে বোঝা যাচ্ছে।
না। গুলিগোলা চালিয়ে জমি দখল করতে হয়নি মন্দার ইন্ডাস্ট্রিজকে। গভীর কায়দায় কাজ হয়েছে। এসব দিকে একলপ্তে বেশি জমি কম। জঙ্গল বেশি, অল্প চাষের জমি, বাকি ছোট ছোট ঢিবি, টিলা। পশ্চিমগড়ের দিকটাতেই যেটুকু চাষবাস হয়। তারও লাগোয়া শাল-পিয়ালের বন।
এখন শোনা গিয়েছে, বাঁশরিলালবাবু টুকটুক করে প্রায় আট-দশ একর জমি কিনে রেখেছেন। কিছু ক্ষেত্রে জমির মালিকদের টাকা দরকার হলেই ধার দিয়েছেন। শোধ হয়েছে চাপের মুখে জমি দিয়ে। মোদ্দা কথা, সিমেন্ট কারখানার জন্য যে জমি লাগবে, তার অধিকাংশটাই একা বাঁশরিলালের কাছ থেকে কোম্পানি পেয়ে গিয়েছে। লাগোয়া জমির জন্য চাপ দিচ্ছে বিদ্যুতের বাহিনী। তারা শালগাছ কেটেও কিছু জমি ফাঁকা করছে।
সমস্যা এখন, জমির মালিকরা এমন বিপদ ভাবেনি। তাদের মধ্যে যারা একটু মধ্যবিত্ত ঘরানা বা দূরে থাকে, তারা তো দাম পেয়ে ঝামেলা চুকিয়েছে। কিন্তু গরিব খেতমজুররা যাবে কোথায়? ওই জমিই তাদের জীবন। এই নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। কোম্পানি এদের দায় নেবে না। বংশীলাল আর পঞ্চায়েতবাবু বলছেন, কিছু টাকা রেখে দে, অন্য খেতে কাজ কর। এখানে অন্য খেত জোগাড় করা কঠিন। জঙ্গলে পাতা কুড়োনোরও যা প্রতিযোগিতা, তাতে নতুন কাজের জায়গা জোগাড় করা কঠিন। কোম্পানি বলেছে দু’-চারজনকে মালবাহকের কাজে লাগানো যেতে পারে। এটা নিয়েও বিভ্রান্তি। খেতের কাজ আর বস্তা বহন করা এক হল? তারপর ওজন বইতে না পারলে যদি তাড়িয়ে দেয়?
পশ্চিমগড় ইতিমধ্যেই মৃতদেহ দেখে ফেলেছে। খবরের কাগজে, জেলার সংস্করণে ছোট করে খবর হচ্ছে। কলকাতা সংস্করণে বোধহয় ছাপার মতো বলে এখনও নম্বর পায়নি।
মাধাই বাজারের সভা থেকে ঘোষণা করে দিল, এরপর সভা হবে পশ্চিমগড় মাঠে। খেতমজুরদের জমায়েত। উপযুক্ত পুনর্বাসন ছাড়া কৃষিজমিতে অন্য কাজ করা যাবে না।
কুসুমডিহার বাজার গরম। যেটা চলছিল চুপচাপ, সেটা এবার, বলা যায় আবার, প্রকাশ্যে। বাঁশরিলাল, বিদ্যুৎ, দেবেশ্বর আলোচনা করছেন, বাড়াবাড়ির আগে থামাতে হবে। থানার নিখিল কর্মকার প্যাকেট নিচ্ছেন, ওপরে রিপোর্ট দিতে হবে, লোকাল তোলাবাজির ব্ল্যাকমেলিং। শিল্পায়নে বাধা। সব ঠিক হ্যায়। এলাকাতে ফিসফাস, আবার কি সেই সব দিন ফিরছে? চাপা আতঙ্কে প্রভাবিত জনজীবন।
পোস্ট অফিসে বসেই কিছু কাজ সারছিল সুমিত। আজ তার নিজের চিঠি এসেছে। মা। ফোনে কথা হয়, তবু শান্তি নেই। লম্বা চিঠি। জ্ঞাতিগুষ্টি সকলের খবর-সহ। আশুতোষ বললেন, ‘স্যর, হাতে কি অনেক কাজ?’
‘না, ঠিক তেমন কিছু নয়। আপনার হয়ে গেলে আপনি বেরিয়ে পড়ুন। আমি একটু পরে বেরচ্ছি।’
আরও বেশ কিছুক্ষণ পর, অন্ধকার জাঁকিয়ে বসছে, পল্টু রানার ফিরল পাহাড় থেকে। কিছু শোনার কৌতূহলেই বসেছিল সুমিত। পল্টু যখন বলছে, সুমিতের কপালে ভাঁজ গভীর হতে থাকল।
(এরপর আগামী সপ্তাহে)