সেই সময় কোনও কলেজ স্টুডেন্ট গলায় তুলসীর মালা পরত বলে আমার জানা ছিল না। এবং আমার একটা-দুটো বোতাম খোলা থেকে যেত, চুল কোনও দিন আঁচড়াতাম না। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষকের রিপালশন হবে। এবং তিনি ধরতেও পেরেছিলেন এই ছেলেটা রেগুলার নয়। এখানে এসেই উনি ধরার পর আমি একটা চুরি করেছিলাম। এই চুরিটা কী?
খেলব এটাই চেয়েছিলাম, খেলতে চাইতাম, এখনও খেলতে চাই। কিন্তু সেরকম খেলার সঙ্গী পাই না, সুযোগ পাই না, তাই খেলা হয় না। আর এই পৃথিবীর কোনও খেলায় একা একা খেলা যায় না, পেশেন্স ছাড়া। সুতরাং সঙ্গীহীন হয়ে একটু খেলা থেকে দূরেই চলে গেছি। আমার এখন খেলার জায়গাটা হচ্ছে মঞ্চ। কিন্তু খেলাই আমার জীবনের প্রায়োরিটি ছিল। ইচ্ছে ছিল এরকম একটা দৃশ্য দেখব ইডেন গার্ডেন্সে– আমি ফার্স্ট স্লিপে সানি গাভাসকারের পাশে দাঁড়িয়ে, সেকেন্ড স্লিপে আমি ফিল্ড করছি, কপিল বল করল, দারুণ একটা ক্যাচ নিল সানি। আমি সানির কাছাকাছি গিয়ে হাতে হাত মারলাম। হয়তো পরের ওভারটায় আমি বল করতে যাব। এসব স্বপ্ন দেখতাম, জেগে জেগেই দেখতাম। আমি জানি যে, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার চান্স, প্রবাবিলিটি অনেক বেশি থাকে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই স্বপ্নটা জেগে দেখা সত্ত্বেও হয়ে ওঠেনি।
খেলব বলেই অনেক কিছু করেছি। খেলব বলে চুরি করিনি কখনও। কিন্তু খেলব বলে ইলেভেন-টুয়েলভের পর, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর কী পড়ব, কী পড়া উচিত– এটা ভাবতে গিয়ে যেভাবেই হোক সায়েন্স পড়তে হবে ভেবেছিলাম। কারণ, আমাদের ক্রিকেট টিমটা সায়েন্সেই জমত। আর্টসের ক্লাসে বেশিরভাগ মেয়ে। ছেলেদের বোধহয় কোনও টিমই হত না। এবার আমি যদি দুম করে আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করি, তাহলে আমার তো ক্রিকেট খেলাই হবে না কলেজে। ঠিক সেইটা ভেবেই আমি সায়েন্স নিয়েছি এবং বায়ো পাস। বায়ো পাস ছাড়া কিছু জোটেনি, তার কারণ আমাকে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানে আমি ফেল করেছিলাম, প্র্যাক্টিকালে। তাও আবার ইন্টারনাল পরীক্ষক যিনি ছিলেন, তিনি আমাকে ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফেল করিয়েছিলেন। আমি ফেলু ছিলাম বলেই ফেল করেছিলেন। আমি উইদাউট প্র্যাক্টিক্যাল খাতা ওঁর কাছে গিয়ে যখন দেখা করেছিলাম এবং পরীক্ষা দিতে ঢুকেছিলাম, তখন উনি আমার বেশভূষা দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। প্রথমত সেই সময় কোনও কলেজ স্টুডেন্ট গলায় তুলসীর মালা পরত বলে আমার জানা ছিল না। এবং আমার একটা-দুটো বোতাম খোলা থেকে যেত, চুল কোনও দিন আঁচড়াতাম না। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষকের রিপালশন হবে। এবং তিনি ধরতেও পেরেছিলেন এই ছেলেটা রেগুলার নয়। এখানে এসেই উনি ধরার পর আমি একটা চুরি করেছিলাম। এই চুরিটা কী? রিফ্লেকশনের ল প্রুফ করার জন্য প্র্যাক্টিক্যালে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। তাতে আয়না দেখে একটা পিন ফুটিয়ে অনেক কিছু আঁকিবুঁকি করে অনেক কিছু প্রমাণ করতে হত। যা আমার হিসাবের বাইরে ছিল। কারণ আমি পড়াশোনা করিনি। আমাকে রাতের বেলা প্রফেসর কোচিং থেকে বের করে দিয়েছিলেন, আমি ঝিমোচ্ছিলাম বলে। আমার ফিজিক্স পড়তে অত্যন্ত বিরক্ত লাগত। তবুও বাবার ইচ্ছেতে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়র হতে হবে বলে আমাকে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হতে হয়েছিল পিওর সায়েন্স নিয়ে।
যাক গে, চুরি যেটা করেছিলাম সেটা হচ্ছে ওই আঁকাটা এঁকে ফেলেছিলাম পাশের একজনকে দেখে। সেও দেখছিলাম আঁকছে, আমিও এঁকে ফেলেছিলাম। কিন্তু অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং নিজ দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা প্রফেসর দেখেছিলেন যে, কাজটা করার সময় যে পিনটা কাগজে ফোটাতে হয় সেই পিনের কোনও দাগই ছিল না। ফলে উনি ধরে ফেললেন আমি কাজটা এঁকে করেছি। কারণ পিনের ফুটোগুলো উনি দেখতে পেলেন না। এবং ফাটাক করে ধরে উনি আমাকে এমন চেপে ধরলেন, দু’-তিনটে প্রশ্ন করলেন, যাতে আমার অবস্থা কেলেঙ্কারি! এবং সেই কেলেঙ্কারি অবস্থা নিয়ে আমার মনে আছে এক্সটার্নাল ভদ্রলোক একটু ফর্সা ছিলেন, মাথায় টাক ছিল, কিন্তু ওঁর মনে করুণাও ছিল। উনি চেয়েছিলেন এই ছেলেটা যাই করুক, বুকের দুটো বোতাম খোলাই থাক, আর তুলসীর মালা পরুক, আর একটু উসকোখুসকো চুল নিয়ে আসুক। ছেলেটা যদি পাশ করে যায়, তাহলে কী আর ক্ষতি হয়! কিন্তু ইন্টার্নাল যিনি ছিলেন, যদি মনে করতে পারি খুব সম্ভবত ওঁর নাম ছিল সি. কে. জি। উনি একদম আপসহীনভাবে আমাকে ফেলটা করিয়েছিলেন। নম্বর দেননি। একদম ঠিকই করেছিলেন। এবং তাতে যে ঘটনাটা ঘটেছিল আমার কপালে, পরবর্তী কালে সায়েন্স পড়তে গেলে একটাই অপশন ছিল– বায়ো পাস। আমার সেই বায়ো পাস নিয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম দিনেই প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে একটা ব্যাঙ কাটা দেখে এত নার্ভাসনেস হয়েছিল, এত খারাপ লাগা হয়েছিল, একটা ব্যাঙকে অজ্ঞান করে তার ভেতর থেকে কাটা-কুটি, ছেঁড়া– এখনও ভাবি কেন আমি ইঞ্জেকশনটা চুরি করেছিলাম। আমি ওই ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা সত্যিই কেন চুরি করেছিলাম আজ পর্যন্ত বুঝিনি। কিন্তু আমার মনে আছে সেই অপমান। এবং সেই অপমান মনে থাকার পরে এবং আমাকে না বুঝতে পারার এই যে আমার কনফিউশন, তার থেকে আমি চোরের জন্য বাজেট রাখি। আমি আমার সমস্ত কাজে, আমার জীবনে, আমি চোরের জন্য বাজেট রাখি। আমি জানি কিছু কিছু মানুষ কখনও সখনও হঠাৎ কোনও কারণে হোক বা অকারণে চুরি করে ফেলতে পারে।