সবাই ভাবে, আমি বোধহয় অনেক কিছু করেছি ওদের জন্য, কিন্তু সত্যিই তেমন কিছু করিনি। ওদের আমি মানুষ হিসাবে দেখেছিলাম শুধু, পরে তো ওরা আমার ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা একদিনে হয়নি। প্রথমদিন থেকে আমি আমার বাইরের ছেলেমেয়েদের থেকে, নিজের ছেলেমেয়ের থেকে ওদের আলাদা করিনি। আমি কারও গুরু হতে চাইনি, আমি বন্ধু হতে চেয়েছি, চাইনি কোনও দূরত্ব থাক আমাদের মধ্যে।
৪.
দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম কেউ বোঝে না। হারিয়ে ফেলার পরই বোধহয় মূল্যটা বোঝা যায়। আর আবার যদি ফিরে আসে সেই প্রাণাধিক প্রিয় জিনিসটা? তখন তার মূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। ওদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। যে সম্মান, বিশ্বাস, ভালোবাসা জলাঞ্জলি দিয়ে জেলে ঢুকেছিল, সেগুলো যেন একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছিল। ফিরে পাচ্ছিল সমাজের চোখে সম্মান। হারিয়ে ফেলা আত্মাটাকেই যেন ওরা খুঁজে পেল আবার। মানুষের চোখে ভালোবাসাটা একবার টের পেয়ে গেলে কোনও শর্তেই সেই ভালোবাসাটা আর হারিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। ওরাই হারাতে নারাজ ছিল, যা পেয়েছে, তা ধরে রাখতে চেয়েছিল।
সবাই ভাবে, আমি বোধহয় অনেক কিছু করেছি ওদের জন্য, কিন্তু সত্যিই তেমন কিছু করিনি। ওদের আমি মানুষ হিসাবে দেখেছিলাম শুধু, পরে তো ওরা আমার ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা একদিনে হয়নি। প্রথমদিন থেকে আমি আমার বাইরের ছেলেমেয়েদের থেকে, নিজের ছেলেমেয়ের থেকে ওদের আলাদা করিনি। আমি কারও গুরু হতে চাইনি, আমি বন্ধু হতে চেয়েছি, চাইনি কোনও দূরত্ব থাক আমাদের মধ্যে। শুধু ভেতরের না, বাইরের ছেলেমেয়েদের কাছেও আমি এরকমই। সে কারণে ওরা কত যে মনে কথা বলতে পেরেছে। যেগুলো অন্যদের কাছে বলতে পারে না, বা চায় না, সেগুলো আমাকে এসে বলে। জানে পেটে বোম ফেললেও আমি সেকথা কোথাও বলব না। ফলে আমার ওপর মারাত্মক একটা ইমোশনাল লোড পড়ে গেছে। এত বিশ্বাস কি রাখতে পারব আমি? কিন্তু জানি, ওদের ছেড়ে আমার কোথাও যাওয়ার নেই।
ওদের একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল আমার ওপর যে, আমি ওদের ভাল চাই। আমি ওদের পরিবর্তন করতে চাইনি। ওদের যেটা হয়েছিল, সেটা উত্তরণ। সেটা সম্ভব হয়েছিল ওদেরই কারণে। আমি শুধু হাতটা ধরেছিলাম। আমি নাচতে ভালোবাসি, নেচেছি, ওদের সঙ্গে নেচেছি। আজও একসঙ্গে নাচতে কী যে ভালো লাগে!
শুধু যে ভালোবাসি ওদের তা কিন্তু নয়, যতটা ভালোবাসা, ততটাই শাসন ওদের জন্য বরাদ্দ। উল্টোদিকে আমাকেও ওরা ভালোবাসে যতটা, ততটা ভয়ও পায়। মান্য করে। ওদের যদি কেউ গায়ে হাত তোলে, ওরা কিন্তু মেনে নেবে না। কিন্তু আমি তো মাঝে মাঝে কিল মেরে দিই ওদের। পরদিন আবার গিয়ে জিজ্ঞেস করি কাল কাকে কাকে কিল মেরেছি। যাদের মেরেছি, তারা হাত তোলে, ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদরও করে দিই। অনেকেই এত দুষ্টু, ইচ্ছে করে হাত তোলে, যাদের ওদের আদর করে দিই। আমি ওদের মুখ দেখেই বুঝে যাই যে মিথ্যে বলছে। কিন্তু এই একটু আদর পাওয়ার জন্য এমন মধুর মিথ্যে আর কী হতে পারে!
ওদের একটা কথা আমি শুরুতেই বলি যে, আমি ওদের অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। আমি জানি যে, তোমরা আমার কেন, কারওরই কোনও ক্ষতি করবে না। ওরা সবসময় এর উত্তরে এই কথাটাই বলে যে, মা তোমার মাথা আমরা কখনও নীচু হতে দেব না। মাথা নীচু অনেক দূরের, ওরা আমার মাথা উঁচু করে দিয়েছে।
একটা ঘটনা বলি। ওরা সবচেয়ে বেশি অনুষ্ঠান করেছে রবীন্দ্র সদনে। ফলে ওরা আনাচ-কানাচ জানে সদনের। ওদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি পুলিশ থাকে। বিশেষ করে এগজিট পয়েন্টগুলোতে পুলিশি প্রহরা বেশি। হয়তো কোনও নতুন অফিসার এসেছে, তারা অতটাও চেনে না সদনটাকে। ওরা নিজেরাই পুলিশকে ডেকে বলে দেয় কোথায় কোথায় দরজা আছে। এরপর আর বোঝানোর দরকার হয় না যে, আমার কীভাবে মাথা উঁচু করেছে ওরা!