সন্ধের দিকে দরজায় টোকা, খুলতেই কাগজে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া প্লাস্টিকের বোতলটা হাতে গুঁজে দিল অর্জুন, যেমন করে আমাদের সশস্ত্র বিপ্লবীরা সেকালে আগ্নেয়াস্ত্র পাচার করত, হুবহু সেইভাবে। জিনিসটা এতই সরেস ছিল যে পরেরবার গিয়েই অর্জুনের খোঁজ করেছিলাম, দেখলাম মক্কেল আপাতত গায়েব!
প্রথমবার যদিও গড়পঞ্চকোট গিয়েছিলাম বড়দিনের ছুটিতে। তবে পুরুলিয়ার এই অঞ্চলে বেড়াতে আসার সেরা সময় পলাশের মরশুম, অর্থাৎ দোলের আশপাশে। থাকার জন্য পাঞ্চেত পাহাড়ের কোলে গাছপালা ঘেরা বনদপ্তরের পর্যটন কেন্দ্র আমাদের পছন্দের। ভোরের ট্রেনে চেপে আসানসোল পেরিয়ে কুমারডুবি স্টেশনে নেমে অটোতে মোটে আধ ঘণ্টার মামলা। পথে তিন কিলোমিটার লম্বা পাঞ্চেত বাঁধ পেরনোর সময় তেমন চৌকস অটোওলা হলে নিজেই গাড়ি থামিয়ে বলবে নেমে পটাপট ছবি তুলে নিতে।
চারদিকে পাহাড় ঘেরা বিশাল লেকের দৃশ্য সত্যিই চমৎকার! এখানকার পর্যটন কেন্দ্রটি বিশাল এলাকা জুড়ে, নিচ থেকে পাহাড় অবধি রাস্তা উঠে গিয়েছে আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দোতলা সব কটেজ। মাঝখানে পুরোটা কাচের জানলা বসানো সবুজ চালওলা বড় গোল খাবার ঘর,অদ্ভুত বাহারি দেখতে! পৌঁছে দুপুরে কী খাব বলে দিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ি হেঁটে এদিক-ওদিক করতে। এইসব জায়গা আদিবাসীপ্রধান, মূল যে সড়কটা গেছে সেখান থেকে ছোট ছোট রাস্তা ঢুকে গিয়েছে এদের সব গ্রাম অবধি। সময় বুঝেই যাই যখন পলাশের ঘোর ঘনঘটা, চতুর্দিকে ছড়ানো পলাশের জঙ্গল সূর্যের আলো পড়ে একেবারে আগুনে লাল হয়ে থাকে।
খেলার মাঠের ধার ঘেঁষে বেশ কিছু বেঁটে গাছ রয়েছে। অনেকটা কমলালেবুর কোয়ার মতো ফুলগুলো হাওয়ায় দোল খেতে খেতে হাতের নাগালে চলে আসে। ঝরা ফুল ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে গাছগুলোর নিচে দেখলে মনে হবে লাল গালচে বিছানো রয়েছে। গিন্নি মুঠো করে তুলে নিয়ে গিয়ে লজের টেবিলের ওপর বিছিয়ে রাখে। মাঠ পেরলেই বাঁহাতে পুকুরের ধারে আমাদের চেনা প্রকাণ্ড বটগাছটার সামনে গিয়ে পড়ি, যার কাছেই ছিল টালির চালের বড় বড় ঘরওলা সুন্দর সাজানো মাটির বাড়ি পলাশ বীথি। এককালে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের কথা ভেবে এখানে জমিয়ে ইকো ট্যুরিজম চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মাহাতো। দারুণ করিতকর্মা ছেলেটি হঠাৎই পথ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় ওর ভাই অর্জুন বেচারা ব্যবসা গুটিয়ে এখন লজেই কাজ নিয়েছে। সেবার চুপি চুপি ওকে ডেকে বলেছিলাম, খাঁটি মহুয়া জোগাড় করার কথা, ঘাড় নেড়ে ‘হয়ে যাবে স্যর’ বলে চলে গেল।
সন্ধের দিকে দরজায় টোকা, খুলতেই কাগজে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া প্লাস্টিকের বোতলটা হাতে গুঁজে দিল অর্জুন যেমন করে আমাদের সশস্ত্র বিপ্লবীরা সেকালে আগ্নেয়াস্ত্র পাচার করত হুবহু সেইভাবে। জিনিসটা এতই সরেস ছিল যে পরেরবার গিয়েই অর্জুনের খোঁজ করেছিলাম, দেখলাম মক্কেল আপাতত গায়েব।
এই অঞ্চলের বড় আকর্ষণ হচ্ছে প্রাচীন আমলের পঞ্চকোট রাজত্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ। আমরাও প্রতিবার এসে দেখতে যাই। খান দুই মন্দির আর একটা দরবার মহলের কিছুটা ছাড়া বাকি সব ইঁট আর মাটির এমন স্তূপ হয়ে আছে যে, আমার ছেলে তড়বড় করে একটার মাথায় ওঠে তো অন্যটার সুড়ঙ্গ বেয়ে পাতালঘরে নেমে চোর-পুলিশ খেলতে থাকে। এগুলোকে ঠিকমতো সারিয়ে সুরিয়ে তোলার কোনও উদ্যোগ বহুদিন অবধি চোখে পড়েনি।পর্যটন কেন্দ্রের চৌহদ্দি পেরিয়ে বড় রাস্তার উল্টোদিকে রয়েছে আদিবাসী গ্রাম বাঘমারা। প্রতিবার গিয়ে ছবি আঁকতে বসি আর ভাবি এই নামের উৎপত্তি কী থেকে? আমাদের লজের কিচেন সুপারভাইজার সূর্য মাহাতোর বাড়ি এই গ্রামেই, কিন্তু এসব অঞ্চলে কোনও দিন বাঘ-ভাল্লুকের বাস ছিল কি না, জানতে গিয়ে নাদুসনুদুস এই বয়স্ক লোকটিকে বেশ ধন্দে ফেললাম। যদিও সেদিন দুপুরে রীতিমতো পেল্লাই সাইজের পোস্তর বড়া ভেজে খাওয়াতে বিন্দুমাত্র কসুর করেননি সূর্যবাবু।