বেহালা চৌরাস্তার বাজারের পাশের ঝুপড়ি থেকে শুরু করে বোম্বে রোডের পাশের ধাবা– কোথাও বাদ দিইনি পেটাই পরোটা থেতে। এই পরোটা শহরের নামজাদা রেস্তরাঁতে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় বাজারের পাশে, হাইওয়ের ধারে, স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। কিন্তু এল কোথা থেকে, শুরু কোথায়– কেউ হদিশ দিতে পারেনি।
২২-২৪ বছর আগে আমি তাকে প্রথম দেখি। কলকাতা থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে পৌঁছতে বিস্তর কসরত করতে হত– ভাগ্য নিতান্ত সুপ্রসন্ন থাকলে এয়ারপোর্ট থেকে অসম রোড পৌঁছতে দুই ঘণ্টা লাগত। দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে এক সকালে জিরাট বাসস্ট্যান্ডের পাশে মিষ্টির দোকানে গিয়ে কচুরি চাইতে উত্তর এল– ‘কচুরি নেই, পরোটা আছে’। খিদের পেটে সব এক– তা-ই বললাম দিয়ে দিতে। এবার প্রশ্ন এল, ‘কত দেব?’ আমি চারটে দিতে বলতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘দুশো দেব?’ আঁতকে উঠে বললাম, ‘আরে আমি রাক্ষস নাকি!’ খানিক বসার পরে দেখি ভেতর থেকে এক বগি-থালার মাপের পরোটা এল। সাইজ দেখে আমি চমকে উঠলেও একেবারে পাত্তা না দিয়ে সেই পরোটাকে চারদিক থেকে হাত দিয়ে পেটাতে শুরু করল যতক্ষণ না সেই পরোটা তার ঔদ্ধত্য বিসর্জন দিয়ে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। সেখান থেকে এক খাবলা ছিঁড়ে ওজন করে যখন পরিবেশন করল, খেয়ে আমি হতবাক– বুঝলাম ঔদ্ধত্য বিসর্জন গেলেও কৌলীন্য হারায়নি এই পরোটা। এই স্বর্গীয় খাবার আমি আগে খাইনি কেন! আরও দিতে বলতে দোকানের মালিকের কথা কানে এল, ‘আগেই তো বললাম দুশো দিচ্ছি, শুনলেন না তো!’ আর তাঁর কথা কী শুনব, তখন শুভদৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। নামও জেনে নিয়েছি এই পরোটার। মাতৃদেবী বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিলেন পাশে বসে। তাঁকে বললাম, ‘লুচি পরোটা না করে একাদশী, ষষ্টিতে বা ঠাকুরের ভোগের জন্যে তো পেটাই পরোটা বানাতে পারো!’ বিষম খেয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকালেন। বুঝলাম বাউন্সার দিয়ে ফেলেছি– নিপাতনে সিদ্ধ স্ট্যাটাস দেওয়া যায় কি না, সেই নিয়ে দোলাচলে পড়ে গিয়েছেন। সেই আমার পেটাই পরোটার সঙ্গে আলাপ। দোকানদার সময়ের সঙ্গে মেসোমশাই হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী প্রজন্ম জিরাট নামটার চেয়ে ‘পেটাই স্টপ’ বলতে আজও বেশি স্বচ্ছন্দ।
এরপরে বিভিন্ন জায়গায় খেয়েছি– বেহালা চৌরাস্তার বাজারের পাশের ঝুপড়ি থেকে শুরু করে বোম্বে রোডের পাশের ধাবা– কোথাও বাদ দিইনি। স্বাদের তফাত উনিশ-বিশ কিন্তু পেটানোর কায়দা একইরকম। এই পরোটা শহরের নামজাদা রেস্তোরাঁতে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় বাজারের পাশে, হাইওয়ের ধারে, স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। অনেক খুঁজেছি কোন দোকান থেকে এই পরোটার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটা বের করার। খেটে খাওয়া মানুষদের প্রিয় বলে এর নাম ‘পেটাই পরোটা’ ভাবতে বেশ রোমান্টিক লাগে, কিন্তু বড্ড মেলোড্রামা এই ভাবনায়। অনেক খুঁজে দেখেছি– বাংলার এই নিজস্ব পরোটার বয়স ৫০-ও নয়, তাই সিনেমায় উত্তম-সৌমিত্র লুচি-পরোটাই খেয়ে গিয়েছেন, কখনও এই নিজস্ব পেটাই পরোটা খেতে দেখিনি। কিন্তু এল কোথা থেকে, শুরু কোথায়– কেউ হদিশ দিতে পারেনি। তাই তল্লাশি ছেড়ে দিয়ে খাওয়াতেই মনোনিবেশ করেছি।
আগের বছর মার্চ মাসে আমার ঢাকাইয়া বোন সুস্মিতা বলল, ‘দাদা, তোমাকে কাল সকালে বিক্রমপুরে নিয়ে গিয়ে নাস্তা করাব। ১০০ বছরের বেশি পুরনো ওখানকার দোকানগুলো।’ হুমায়ুন আজাদের ভক্ত সুস্মিতা বিনয়-বাদল-দীনেশ-জগদীশ বসুর বিক্রমপুরকে এখনও সাবেকি নামেই ডাকে, নতুন নাম মুন্সিগঞ্জ বলে না। সুস্মিতার গাড়ি গিয়ে থামল বিক্রমপুরের শ্রীনগর বাজারে। এগলি-সেগলি দিয়ে হেঁটে এক দোকানে গিয়ে পৌঁছে হাঁক দিল– ‘অতিথি নিয়ে এসেছি, ছেকা রুটি দাও।’ পরিবেশন করতে চক্ষু চড়কগাছ– এ তো আমাদের পেটাই পরোটা! বানানোর কায়দা, পেটানো, ছিঁড়ে ওজন করে পরিবেশন, স্বাদ সবই এক, শুধু নামটাই আলাদা। মৌজ করে খেয়ে শতাব্দী প্রাচীন দোকানগুলোর মালিক আর কারিগরদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলাম। তাঁদের কাছে শুনলাম এই ছেকা রুটির গল্প। ৪০০ বছরের পুরনো এই বাজারের পিছনের নদীটা কয়েক মাইল দূরের পদ্মা থেকে যাত্রা শুরু করে ধলেশ্বরীতে গিয়ে মিশেছে, আর ধলেশ্বরী গিয়ে মিশেছে যমুনায়। এই বাজার থেকে নৌকো বোঝাই করে নৌকো পাড়ি দিত উত্তরে আর দক্ষিণে পিছনের নদী দিয়ে। নদীতে জলখাবারের জন্যে মাঝিরা এই ছেকা রুটি নিয়ে যেত, যা অনেকক্ষণ নরম থাকবে, খেতে কষ্ট হবে না। এই বাজারের অন্য ব্যাপারীরাও এই ছেকা রুটি দিয়েই জলখাবার সেরে আসছে ১০০ বছর ধরে।
অবশেষে পেটাই পরোটার উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা কাটল। বুঝলাম ছেকা রুটি ’৪৭-এর দেশভাগেও নিজের জমি ছাড়েনি, নিজের জায়গায় মাটি আঁকড়ে পড়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ধাক্কা আর সামলাতে পারেনি– এপার বাংলায় এসে নাম বদলে নিজের জমিদারি পত্তন করেছে সাতের দশক থেকে, আর ছড়িয়ে পড়েছে সারা পশ্চিমবাংলায়। ফেরার সময় আপন মনে হাসতে দেখে সুস্মিতা জিজ্ঞেস করলে আমি ওকে মহামহিম তারাপদ রায়ের দেখা ষাঁড়ের গল্প বললাম, যার কালীঘাটে নাম ছিল ‘কানাই’ আর হাজরায় নাম ছিল ‘বলাই’।