এখানে আমরা হিন্দু কোয়ার্টার্স তৈরি করছি– দেওয়াল ঘেরা, হামেহাল সেপাই বরকন্দাজের নজরদারিতে উৎকন্ঠ আবাসনগুলোয় মুসলমান শুনলে ফ্ল্যাট বিক্রি তো দূরস্থান, ভাড়াও দেওয়া হয় না। নাৎসি গেস্টাপোর দরকার নেই, নিজেরাই নিজেদের ঘেটোয় পুরছি– একেবারে ঝকঝকে তকতকে রবিনসনের দ্বীপ। হিন্দু বাচ্চারা বামুনের বিধবাদের মতো বড় হয়ে উঠবে। তারা গরিবের ভাষা শিখবে না, বিধর্মীর ছোঁয়া ফিরনি, আদর খাবে না, গান শুনবে না, সকলের উৎসব হঠাৎ ‘ওদের পরব’ হয়ে যাবে।
৪.
শরবাবু বিধবাকে হেঁশেলে আঁশ ঘাটিয়ে মাছের মুড়ো রাঁধানোর উপক্রম করেছিলেন। সেটি গুরু বাবাজির পাতে ওঠার আগে একরকম দৈব দুর্বিপাকেচক্রেই পিছলে যাওয়ায় খানিকটা শুচিতা রক্ষা হয়েছে। বাঙালির, বিশেষ করে বামুনের ঘরের বৈধব্যে আঁশটে গন্ধের মিশেলটি লোক খেপানোর পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী উপাদান। তবে, ‘নিজেরা না খেলেই হল’ বলে বিধবাদের ইহকাল এবং পরকালের ওপর চৌকি দিয়ে বেড়ানো মাতব্বরগণ বামনিদের হাতের রান্নায় আপত্তি তোলেননি কখনওই।
যেবার মাধ্যমিক দিলাম, সেবারই গায়ে চাদর মুড়ে ঘুমচোখে দেখেছি পাড়ার কালীপুজোয় সাদা থান জড়িয়ে ভোররাতে বলির পাঁঠা রেঁধে বাড়ি ফিরছে ব্যানার্জি কাকিমা, সঙ্গে তার বিধবা ভাইপো-বউ– মেয়েটিকে আমাদের সমবয়স্কই বলা যায়। মুখটা স্পষ্ট মনে নেই আর, বহু আদরের আদল একে অপরকে ঠেলে সরিয়ে জায়গা করে নিতে মরিয়া লড়াই চালায় আজকাল। তবু যদ্দুর মনে পড়ছে, নালন্দা স্কুলের মাঠ থেকে ফুটবল খেলে ফেরার পথে ওকে প্রায় রোজই দেখতাম বাপের ‘ইউনিক টেইলার্স’ বা ওইরকম কোনও সাইনবোর্ড লাগানো দোকানের টুলে বসে নিবিষ্ট মনে সেলাই রিফুতে মগ্ন। ক্লাস এইট অবধি পড়েছিল, তারপর ডাগর-ডোগরটি হয়ে উঠতেই বাড়ি থেকে পাত্রস্থ হল। কাকিমা মুখে পান গুঁজে বলেছিলেন, ‘‘আমি আর ক’দিন… এর পর তো ওকেই…।’’ কানে খট করে বেজেছিল কথাটা। বামুনবাড়ির গরিব খুড়শাশুড়িটি হয়তো চেয়েছিলেন যে কোনও উপায় মেয়েটির হিল্লে হোক– গলায় দড়ি দিলে, অথবা শিলিগুড়ির খালপাড়া নামক যৌনপল্লিতে ঠাঁই পেলে শেষমেশ পরকালে যে গতি হবে না, সে বিষয়ে বৃদ্ধা নিঃসংশয় ছিলেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে বাপের বাড়িতে যদি জায়গা না হয়? এসব কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্যবিধবাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করাটাও বাঙালি বাড়ির দস্তুর। সাফাই কর্মটি একটানা চলিতেছে। সে চলুক, উপস্থিত বিধবাতে ফেরা যাক। তারা বাড়িতে থাকলে নানারকম নোংরামোর গল্প বাড়ির সব বয়সি পুরুষকে ঘিরে তৈরি হতে থাকে। সিঁথিতে সিঁদুর লেবড়ে যতখানি হয়, ‘কপাল পুড়লে’ তার এক ছটাকও হয় কি না আমার সন্দেহ বটে, তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।
তারপর বহুকাল কেটে গেছে। মেয়েটি যদি সত্যিই এয়ারপোর্ট মোড় সংলগ্ন সেই বাহে-বস্তির টিনের চালওলা ঘরখানাতেই পার্মানেন্ট ডেরা বেঁধে থাকে, তাহলে তার ক্ষীণ তনুটি অ্যাদ্দিনে খুরশাশুড়ির মতোই গোলগাল হয়েছে, সন্দেহ নেই। নদী পেরিয়ে আরও অনেকটা উত্তরে ধানখেত, মাঠ, পুবে বিছিয়ে থাকা ব্যবসায়ী সংঘের এজমালি জমি পেরিয়ে পাহাড়ের কোল অবধি একটানা শালবন শুরুর মুখে বাঁকের আড়ালে নদীর পার ঘেঁষে ঢালু বালির ওপর কাঠ সাজিয়ে তার দেহখানা তুলে দিতে এখনও বিস্তর সময় বাকি। তারপরও কি সেই একই বিস্মৃতি? ক্ষীণ স্রোতের বুকে জেগে থাকা পাথরের ওপর হাজার হাজার প্রজাপতির ওড়াওড়ি মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত অবসরকে অর্থময় করে তুলবে ভেবে রাখলে বেঁচে গেল। নয়তো আল্লাই জানে কপালে কী আছে! ফের সেই ঘুপচি ঘরের ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি বাঁধলেই চিত্তির! তা, সত্যিই তো বাপু! অত বালবিধবা যদি স্বর্গে এন্ট্রি না পেয়ে পুকুরঘাট থেকে চিলেকোঠা অবধি অধিকার জমিয়ে বসে, তবে যে গোলযোগের আশঙ্কা, সেটি কোনও না কোনওভাবে সম্পত্তি সংক্রান্ত বখেরাই বটে। গোময় লেপা মাটিতে এলানো এনিমিক শরীরে সামান্য আঁশের সংস্পর্শ সেথায় নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর এবং অবান্তর বিষয় মাত্র।
অবিশ্যি আমিষাহারের ফলে বিধবাদের শরীরে মগজে কামেচ্ছা যে প্রবেশ করেই, সে বিষয়ে কোকিলকুজনমুখরিত প্রাকৃতিক পরিবেশে পাখির ডাক ব্যতীত অন্য কোনও আহ্বানেই জেগে উঠবে না– অঙ্গীকারবদ্ধ বেশুমার গ্রামীণ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা বরাবরই একশোভাগ একমত। ফের সেই শরীর অশুচি হওয়ার আতঙ্ক। ইংরেজি পড়তে না দেওয়ার যুক্তিও এক– মেলেচ্ছো রক্ত বইতে শুরু করবে ধমনি বেয়ে। ‘কামিনীর ধমনি’ গোছের নামওলা বইয়ে বাজার ছেয়ে গেলেও, বটতলার বাণিজ্যিক সাফল্য পরিবারতন্ত্রের বুনিয়াদি ভিত্তিগুলির গায়ে আঁচড়টি অবধি কাটতে পারবে না মশাই!
পাঁচশো স্কোয়ার ফুটের ‘অল সাইড সাউথ ফেসিং’ অবিশ্যি খানিকটা বদল ঘটিয়েছে। বুড়ো বাপ-মায়েদের মাঝেমধ্যেই রাতের অন্ধকারে নিঝুম রাস্তায় ফেলে রেখে পগার পার হচ্ছেন ছেলেপিলেরা। একেও সাফাই অভিযানই বলতে হবে। ‘শশিবাবুর সংসার’ থেকে ‘শুভবিবাহ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রের ছবি বিশ্বাস টাইপ বাপেরা একটি সন্তানকে সাকসেসফুল বানাতে গিয়ে সত্যিই পথে বসবে, তা হয়তো বাঙালি ভেবে উঠতে পারেনি। নিয়ন্ত্রণ কখন, কোন আর্থসামাজিক পটভূমিতে খসে পড়েছিল, তার শব ব্যবচ্ছেদ তাত্ত্বিকরা করুন, তবে বাঙালি ঘরদুয়ার সাফসুতরো করার দিকে বেশ কয়েক কদম এগোলেও তার ভয় কিছুমাত্র কমেছে বলা যাবে কি?
সাফাইকর্মী বললেই ‘ব্যাটল ফর অ্যালজিয়ার্স’-এর ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার্সের সেই বুড়োর কথা মনে পড়ে, যে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিল চারপাশে হিংস্র মানুষদের দলবদ্ধ ঘৃণার জান্তব প্রকাশ দেখে। এখানে আমরা হিন্দু কোয়ার্টার্স তৈরি করছি– দেওয়াল ঘেরা, হামেহাল সেপাই বরকন্দাজের নজরদারিতে উৎকন্ঠ আবাসনগুলোয় মুসলমান শুনলে ফ্ল্যাট বিক্রি তো দূরস্থান, ভাড়াও দেওয়া হয় না। নাৎসি গেস্টাপোর দরকার নেই, নিজেরাই নিজেদের ঘেটোয় পুরছি– একেবারে ঝকঝকে তকতকে রবিনসনের দ্বীপ। হিন্দু বাচ্চারা বামুনের বিধবাদের মতো বড় হয়ে উঠবে। তারা গরিবের ভাষা শিখবে না, বিধর্মীর ছোঁয়া ফিরনি, আদর খাবে না, গান শুনবে না, সকলের উৎসব হঠাৎ ‘ওদের পরব’ হয়ে যাবে। হয়ে গেছেও বোধহয়। বাঙালি এবার ক্লিনচিট নিয়ে জাতীয় আঙিনায় প্রবেশ করবে। স্যানিটাইজ্ড এবং একটু হাবামতো।