কাটোয়া স্টেশনে হঠাৎ নজরে এল এক চায়ের দোকানে পাউরুটিতে সর দিয়ে আর তার ওপর চিনি ছড়িয়ে শিক গেঁথে উনুনের ওপরে একটা জাল দিয়ে তাতে ছড়িয়ে দিতে। এক প্লেট চাইতে দুটো পিস কাঠি গুঁজে এক করে আমার হাতে দিল। ওই স্বর্গীয় সরের স্যান্ডুইচ যে একবার পেয়েছে, হলফ করে বলতে পারি, সে কোনও দিন ভুলবে না।
১২.
স্যান্ডুইচ খাবারটা দেখলেই কেন জানি না ‘বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু’ গানটা মনে পড়ে। এতবার এই খাবারটা আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে, গুনে শেষ করতে পারব না। সিটি বাস আমাকে স্টেশনে নামাত ৮টা ১৫-তে, আর ডাউন সাউথ বিহার মেল রায়পুর স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে সকাল ৮টা ২০-তে আসত। বাস থেকে নেমে দৌড়, আর তার মধ্যেই একনম্বর প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজের পাশের দোকান থেকে একটা সেলোফেন জড়ানো স্যান্ডুইচ কিনে নেওয়া ছিল আমার ডেলিপ্যাসেঞ্জার জীবনের ডেলি রুটিন। মুম্বইয়ে অফিসের কাজে গেলে ভাইয়ের সঙ্গে সারারাত তার মাহিমের আস্তানায় আড্ডা দিয়ে সকালে মহালক্ষ্মীতে অফিস যাওয়ার সময় স্টেশনরি দোকান থেকে সেলোফেন জড়ানো স্যান্ডুইচ কিনে গাড়ি ধরাও রুটিনের মধ্যেই পড়ত। দুই ক্ষেত্রেই সেই স্যান্ডুইচ প্রাণে বাঁচাত, কারণ আমার কর্মক্ষেত্রে বিকেল চারটের আগে খাওয়ার ফুরসত পাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
পড়ুন ‘ভাজারদুয়ারি’-র অন্য একটি লেখা: সন্দেশের ব্যাপারে একটি জরুরি সন্দেশ
কলকাতার অজয়নগর আর বাইপাস মোড়ের বিরিয়ানির দোকানে বসে যখন কচ্ছের রানে এক বিলাসবহুল রিসোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ফেললাম, স্বপ্নেও ভাবিনি সেখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করে রয়েছে। রানোৎসবের জন্যে ভুজ শহর থেকে ৫০ মাইল দূরে নুনের মরুভূমিতে ধরধো গ্রামের পাশে নির্মিত রিসোর্টে যখন গিয়ে পৌঁছলাম, তখন পরিকাঠামো সবে তৈরি হচ্ছে। মোবাইল ফোনের পরিষেবা, পান-বিড়ির দোকান, চায়ের দোকান কিছুই ছিল না। যখনই হতাশ হয়ে পড়তাম আর লাইনে দাঁড়িয়ে রোজ এক খাবার খেয়ে নিজের সিদ্ধান্তকে গালি দিতাম, সহকর্মীদের এক সান্ত্বনা– ‘বাধাম থৈ যসে। ধীরজ রাখো। তুম সমায়মা তমনে মাহি সারু ভোজন মার্শে’– একটু অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরো; খুব শিগগির এখানে ভালো খাবার পাবে। সত্যিই কিছুদিনের মধ্যে জায়গাটা জমজমাট হয়ে উঠল, খাবার সমস্যাও মিটল। কিন্তু সেটা স্থানীয়দের। ধোকলা, খামান, খাকরা আর থেপলার যুগোপৎ আবির্ভাবে সহকর্মীরা আনন্দে আত্মহারা আর আমি বাক্হারা হয়ে পড়লাম– বাঙালি পেটে কি আর ওই বেসন আর ভাজার যুগলবন্দি সহ্য হয়! আমার সহকর্মীরা যেখানে হইহই করে খেয়ে বেড়াত, আমি অসহায়ের মতো ভাত আর পানসে ডাল খেয়ে দিনের পর দিন ক্ষুন্নিবৃত্তি করতাম। অবশেষে একদিন ভারত সীমান্তের শেষ তেহ্সিল খাওরা-তে এক কাজে গিয়ে কচ্ছি দাভেলির সঙ্গে মোলাকাত হল। এক চায়ের দোকানে ছবি দেখে কৌতূহল হতে অর্ডার দিলাম– আর আমার কাছে হাজির হল দুটো ছোট বানরুটির মধ্যে আলুর এক ঝাল তরকারি, সেউভাজা আর ডালিমের কিছু দানা ছড়িয়ে কাঠি দিয়ে দুটো বান আঁটা কচ্ছি দাভেলি– এ তো আমার চিরপরিচিত স্যান্ডুইচেরই আরেক রূপ! এরপর থেকে খাওরা বা ভুজ গেলে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকত আমার জন্য কচ্ছি দাভেলি নিয়ে আসার।
পড়ুন ‘ভাজায়দুয়ারি’র আগের পর্ব: নারকোলের বিদেশযাত্রা
এই বাংলাতেই একবার বিপদে পড়েছিলাম সকালের জলখাবার নিয়ে, আর সেবারও স্যান্ডুইচ আরেক অবতার বেশে বাঁচিয়েছিল। কাটোয়াতে পৌঁছে দেখলাম মুড়ির রাজত্ব– সকালে দেখতাম রাস্তার দোকানে সকালে হয় মুড়ি আর চপ জল দিয়ে মেখে সপসপ করে খাচ্ছে, নয়তো ঘুগনি-মুড়ি খাচ্ছে। মিষ্টির দোকানে লুচি-কচুরি পাওয়া যায়, কিন্তু তরকারিটা বানায় আগের দিনের বাসি শিঙাড়া ভেঙে। অন্যদিন তো সকালে ভাত খেয়ে অফিস বেড়িয়ে যাই, কিন্তু ছুটির দিনে জলখাবার কী খাব, সেই নিয়ে চিন্তায় শনিবারের রাতের ঘুমে টান পড়ল। এইসময় হঠাৎ নজরে এল স্টেশনের কাছে এক চায়ের দোকানে পাউরুটিতে সর দিয়ে আর তার ওপর চিনি ছড়িয়ে শিক গেঁথে উনুনের ওপরে একটা জাল দিয়ে তাতে ছড়িয়ে দিতে। এক প্লেট চাইতে দুটো পিস কাঠি গুঁজে এক করে আমার হাতে দিল। ওই স্বর্গীয় সরের স্যান্ডুইচ যে একবার পেয়েছে, হলফ করে বলতে পারি, সে কোনও দিন ভুলবে না।
স্যান্ডুইচ শুধু আমার নয়, সৃষ্টিলগ্নেও প্রাণ বাঁচিয়েছিল, আর সেখান থেকেই এর নামকরণ। দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের স্যান্ডুইচ শহরের আর্ল জন মন্তেগু ছিলেন এমন এক জুয়াড়ি, যিনি জুয়া খেলতে বসে খেতে অবধি উঠতেন না, পাছে কোনও দান বাদ পড়ে যায়। খাওয়াদাওয়ার পাট প্রায় তুলেই দিয়েছিলেন! ১৭৬২ সালে এমনই এক জুয়ার আড্ডায় তাঁর ভৃত্য বারবার তাঁকে অনুরোধ করছে কিছু খেয়ে নিতে আর উনি পাত্তা দিচ্ছেন না। অবশেষে নাছোড়বান্দা ভৃত্যকে আদেশ দেন দুই খণ্ড পাউরুটির মাঝে রোস্ট বিফ দিয়ে তাঁকে পরিবেশন করতে, যাতে চামচ- ছুরির ঝক্কি এড়িয়ে হাত দিয়েই খেতে পারেন আর খাওয়ার সময় জুয়া খেলতে পারেন। তাঁর খাওয়া দেখে সঙ্গী জুয়াড়িরাও অচিরেই এইভাবে খাওয়ার পদ্ধতি রপ্ত করল, কিন্তু পরিবেশনের জন্যে নির্দেশ কী দেবে? জন মন্তেগুকে পরিবেশিত খাবারের নাম তাই ‘স্যান্ডুইচ’ হয়ে গেল। কারণ এতে পরিচারকরা বুঝতে পারত মনিবরা কী খেতে চাইছে।