হয়তো কয়েকজনের কাজ আমি জোগাড় করে দিয়েছি, এর ফলে একটাই উপকার হয়েছে। বাইরে বেরিয়ে কাজ পাওয়া যায়– এই ধারণাটা জন্মেছে ওদের মধ্যে। ফলে বাইরে বেরলে যে নতুন একটা জীবন পাওয়া সম্ভব, সেটা ওদের ইন্সপায়ার করে জেলের সময়টা সুস্থভাবে কাটিয়ে দেওয়ার। অনেকে আবার জেলের ভেতরে থেকেই ভাবতে থাকে বাইরে যখন বেরবে, কীভাবে জীবনটা সাজাবে, কীভাবে কাজ করবে। পুরুলিয়ার একটি ছেলে যেমন জেল থেকে বেরিয়ে ছৌয়ের নাচের দল গড়েছে।
৯.
জেলে নাচ শেখানোর কাজটা কতদিন আমি পারব জানি না। বয়স হচ্ছে আমার। চাইছি নতুন কেউ এসে দায়িত্ব নিক। কিন্তু আমি ওদের ছেড়ে যাচ্ছি না। এবার ভাবছি অন্যভাবে ওদের সঙ্গে থাকব। ওদের পুনর্বাসনের দিকে নজর দেব। আগেও এই কাজটা করেছি, এবার চাইছি এই কাজটাই মন দিয়ে করতে। যাতে জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর ওদের একটা কাজের সুযোগ করে দেওয়া যায়। চট করে তো কেউ আর ওদের চাকরিতে রাখবে না। ওদের নিজের কাজই জোটাতে হবে। যারা চাকরি করছে আজ, ওদের সবার ‘গ্যারান্টার’ আমি। কিন্তু প্রত্যেকের ক্ষেত্রে তো এটা করা যায় না, সব জায়গাতে আমি পৌঁছতেও পারব না। আমি ১০০ কিলো চা চারজনকে দিই। ওরা চায়ের দোকান চালায়। আমার ছেলেমেয়েরা খুব সাধারণ ঘরের। গরিব। একদম যারা গ্রামে থাকে, তাদের বরং হাতে জমি-জমা আছে, কিন্তু যারা শহরের আশপাশেই থাকে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা একদম ভালো নয়। আমার অনুষ্ঠানগুলোতে যে ছেলেটি জামাকাপড় বানাত, যে আমার মাস্টার টেলার ছিল, তাকে আমার এক বন্ধু দোকান করে দিয়েছে। হাওড়াতে সেই দোকান।
আবার আরেকজন ফ্রুটজুসের দোকান করেছিল। মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারিকে আমি রিকোয়েস্ট করেছিলাম ওরা যদি আমার ছেলেটাকে জুস সাপ্লাই করে। দোকানটা দাঁড়িয়ে গেলে ও নিজেই তারপর পুরোটা করে নেবে। কিন্তু শুরুতে ওরা যদি সাহায্য করে। ওরা করেওছিল সাহায্য, একবাক্যে। আরেকজন খুব ভাল রান্না করত। তাকে আমার এক বন্ধু তাঁর রেস্তরাঁয় কাজ দিয়েছিল, রান্নার কাজ, শেফের কাজ। কিন্তু আমার তো এর থেকে বেশি সামর্থ্য নেই। আমার পরিচিত লোকদেরই বলি তারা যদি সাহায্যে এগিয়ে আসে। তারা এগিয়ে আসে বলেই কিছু কিছু জেল থেকে বেরনো মানুষ আবারও বাঁচার আশা দেখে। আবার জীবনের স্বাদ উপভোগ করে।
পড়ুন ‘শাপমোচন’-এর আগের পর্বটি: নিজেকে অপরাধ মুক্ত করি জেলের ছেলেমেয়েদের নাচ শিখিয়েই
হয়তো কয়েকজনের কাজ আমি জোগাড় করে দিয়েছি, এর ফলে একটাই উপকার হয়েছে। বাইরে বেরিয়ে কাজ পাওয়া যায়– এই ধারণাটা জন্মেছে ওদের মধ্যে। ফলে বাইরে বেরলে যে নতুন একটা জীবন পাওয়া সম্ভব, সেটা ওদের ইন্সপায়ার করে জেলের সময়টা সুস্থভাবে কাটিয়ে দেওয়ার। অনেকে আবার জেলের ভেতরে থেকেই ভাবতে থাকে বাইরে যখন বেরবে, কীভাবে জীবনটা সাজাবে, কীভাবে কাজ করবে। পুরুলিয়ার একটি ছেলে যেমন জেল থেকে বেরিয়ে ছৌয়ের নাচের দল গড়েছে। ও ছিল আমার ছৌ-এর নৃত্যশিল্পী, অপূর্ব নাচত ছেলেটি।
একটা মজার গল্প বলি এই ছেলেটির। একদিন এসে আমাকে বলল, মা, তোমার তিনটে ছবি আমাকে দেবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, তিনটে ছবি দিয়ে কী করবি? বলে, একটা আমার কাছে রাখব। একটা আমার শ্বশুরবাড়িতে দেব, আর একটা আমার ঠাকুরের আসনে রাখব। আমি বলি, ওরে আমি মরে গেছি নাকি?
আরও পড়ুন: ভিতরে যারা বন্দি, তারা আর যাই হোক, মুখোশ পরে থাকে না
কেউ কাঠের কাজ জোগাড় করেছে, কেউ ফলস সিলিংয়ের কাজ শিখে দিব্যি এই কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। কেউ ট্রাক চালানো শুরু করেছে। এই ছেলেটির গল্প দিয়েই এই এপিসোডটি শেষ করা যাক। জেল থেকে বেরিয়ে তো ছেলেটি বিহারে, গ্রামে গেছে। কিছুদিন পর বিয়ে করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাকে জানিয়েছিল বটে। কিন্তু একদিন দেখি আমাকে ট্রেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি অনেক আদর করে বোঝালাম যে এই বয়সে এতদূর যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দা, বলে স্টেশনে লোক রেখে দেব। ও তোমাকে নিয়ে আসবে, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার বলে, গ্রামের জমিদারের বাড়িতে নাকি আমার জন্য ঘরও ঠিক করে রেখেছে। যদিও আমার যাওয়া হয়নি। কিন্তু ট্রাক চালানোর কাজ পাওয়ার পর আমি ওকে বলে রেখেছিলাম, মাসে যেন আমাকে একবার ফোন করে। এই কাজটা নিয়ে আমার চিন্তা ছিল। এত দূর দূর যায়, দুশ্চিন্তা হয়। সে মাসে একবার ফোন করত, নিজের সব খবর দিত। একবার ফোন করে বলল, মা খুশ খবরি আছে। আমার এইমাত্র ছেলে হয়েছে। এইমাত্র! খবরটা নিজে পেয়েই ও আমাকে দিয়েছে। এটা ভেবে চোখে জল চলে আসে যে, খুশির সময় ওদের আমার কথা মনে পড়ে।
তো এরকম একটা সময় এল, দেখি অনেকদিন ওর ফোন নেই। আমার অন্যান্য ছেলেদের বললাম ওর খোঁজ নিতে। খুব চিন্তায় পড়ে গেছি আমি এদিকে। আমিও ফোনে পাচ্ছি না। প্রায় একবছরের ওপর সময় হয়ে গেছে। আমার দুঃশ্চিন্তার কথা যেদিন বলেছি আমি আমার অন্য ছেলেদের, তার দু’-তিন দিন পরেই একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এল। আমি চিনতে পারিনি প্রথমে। খুব আহত হয়ে ও বলল, মা আপ মুঝে ভুল গ্যায়ে।
আরও পড়ুন: মায়ের কথা ভাবলে এখন তোমার মুখটা দেখতে পাই
সেদিন ও আমাকে জানাল যে আজকাল ও আর অন্যের ট্রাক চালায় না। নিজে দুটো ট্রাক কিনেছে। ভাল রোজগার করছে। সংসারে আনন্দ এসেছে।