নৌ-সেনাপতি সুপারগ ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নাবিককে নীচু গলায় বললেন, ‘এর আর এক নাম হীরক সমুদ্র, জলে দড়ি নামিয়ে দ্রুত কিছু হীরে তুলে রাখো।’ সত্যি দুর্মূল্য কিছু হীরক খণ্ড পাওয়া গেল সেই উত্তাল সমুদ্রের তলদেশ থেকে। কিন্তু অবাক আনন্দ প্রকাশের আগেই সুপারগ সাবধান করলেন সেই নাবিকদের, খবরদার, জাহাজের অন্যেরা যেন জানতে না পারে।
বন্দরের নাম ভৃগুকচ্ছ। তাকে কেন্দ্র করে এক ছোট রাজ্য ভৃগুরাষ্ট্র। সেখানের স্বপ্ন দেখা কয়েকজন তরুণ ব্যবসায়ী এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিযানে যাবে স্থির করল। অনেক বিবেচনার পর প্রবীণ সুপারগকে তারা তাদের নৌ-সেনাপতি হওয়ার অনুরোধ জানাল।
সুপারগ বললেন, ‘সে কী করে সম্ভব? আমার বয়স হয়েছে।’
‘তাতে কী? আমরা বাল্য থেকে আপনার সাহসী নানা অভিযানের কথা শুনে বড় হয়েছি। তাছাড়া জলযানের নিয়ামক হওয়া আপনার রক্তে, আপনার পিতা ছিলেন এই এলাকায় সমুদ্র-অভিযানের সেরা বিশেষজ্ঞ।’
সুপারগ গলার স্বর নরম করে বললেন, ‘সমুদ্রের লোনা জলের আঘাতে দীর্ঘদিন যাবৎ আমার দৃষ্টি ক্ষীণ। তোমাদের এত বড় পোতের দায়িত্ব নেওয়া আমার ঠিক হবে না।’
‘আপনার অভিজ্ঞতা আপনাকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। স্বয়ং ভৃগুরাজ আর তাঁর সভাসদরা তার সাক্ষী।’
সুপারগের পোড় খাওয়া মুখমণ্ডলে তৃপ্তির হাসি ঝিলিক মারল, ‘তোমরা সে-কথা জানো?’
‘ভৃগুকচ্ছে সেকথা তো জনশ্রুতির মতো’, তরুণের দল বিনীতভাবে বলল।
কথাটা সত্যি। চোখে আঘাত পাওয়ার পর নৌ-যাত্রার কাজে ক্ষান্তি দিয়ে সুপারগ রাজার শরণাপন্ন হন। রাজা তাঁকে অর্ঘকারকের দায়িত্ব দিলেন। তার মানে রাজকোষ থেকে যা কিছু কেনা হবে, তার গুণমান বিচার এবং মূল্য নির্ধারণ করবেন সুপারগ।
কিছুদিনের মধ্যে কয়েকজন এলেন এক হাতি বিক্রি করতে। বিশাল বপু, কিন্তু শান্ত প্রকৃতির সেই হাতিকে দেখে সবাই একবাক্যে স্বীকার করল, এটি রাজার নিজস্ব মঙ্গলহস্তী হওয়ার যোগ্য। কিন্তু সুপারগ ভুরু কুঁচকে হাতির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘাড় নাড়লেন, জন্মানোর পর এর মা একে সাদরে কোলে নেয়নি।
‘কী আশ্চয্যি কথা! কী করে বুঝলেন?’
সুপারগ তাঁর ঘোলাটে চোখজোড়া তুলে বললেন, এর পিছনের পা দু’টি সামান্য ছোট। জন্মের সময় মাটিতে পড়ে যাওয়াতেই এই বিপত্তি। যারা বেচতে এসেছিল, তারা মাথা নীচু করে স্বীকার করল, সুপারগের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তে ভুল নেই কোনও।
রাজার সম্ভাব্য মঙ্গল-অশ্বকেও তিনি পাশ করালেন না, মায়ের দুধ থেকে যে পুষ্টি, তা নাকি এই ঘোড়ার অবয়বে অনুপস্থিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঘোড়াটির জন্ম দিতে গিয়ে তার মায়ের মৃত্যু ঘটেছিল। একে অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া আর কী বলা যাবে? সুতরাং চোখের দোহাই দিয়ে তরুণের দলকে এড়ানো গেল না। ৭০০ যাত্রীর সেই বিশাল জলযানের হাল ধরলেন সুপারগ।
প্রথম এক সপ্তাহ নির্বিঘ্নে কাটল। তারপর ভয়ানক এক সমুদ্র-ঝড়ে দিকভ্রষ্ট জাহাজ এসে পড়ল এক আতঙ্কের সমুদ্রে। সেখানে কিলবিল করছে মানুষ-সমান মাছের ঝাঁক, তাদের নাক ধারালো ক্ষুরের মতো। সুপারগ আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন, এর নাম ক্ষুরশাল সাগর; কীভাবে এই বিপদসংকুল জলরাশি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে নির্দেশ দিলেন তারও। তারপর তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নাবিককে নীচু গলায় বললেন, ‘এর আর এক নাম হীরক সমুদ্র, জলে দড়ি নামিয়ে দ্রুত কিছু হীরে তুলে রাখো।’ সত্যি দুর্মূল্য কিছু হীরক খণ্ড পাওয়া গেল সেই উত্তাল সমুদ্রের তলদেশ থেকে। কিন্তু অবাক আনন্দ প্রকাশের আগেই সুপারগ সাবধান করলেন সেই নাবিকদের, খবরদার, জাহাজের অন্যেরা যেন জানতে না পারে।
সুপারগের মতো মানুষের কি এমন লোভ মানায়? সেই ঘনিষ্ঠ কয়েকজন তরুণ নাবিকের অবিমিশ্র শ্রদ্ধা একটু আহত হল। তাতে খাদ আরও মিশল, যখন সুপারগ মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো উজ্জ্বল অগ্নিমাল সাগর পেরতে গিয়ে সোনা, ক্ষীররঙা দধিমাল সাগর পেরতে গিয়ে রূপো, নীলাভ কুশমাল সাগর পেরতে গিয়ে মণি সংগ্রহ করলেন। ঘনিষ্ঠ যে কয়েকজনের সাহায্য নিলেন, তারা ছাড়া জানতে পারল না কেউ।
বিপদসংকুল দীর্ঘ যাত্রা শেষে দেশে ফিরে পোতের ৭০০ যাত্রী যখন সুপারগকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, তিনি তখন মৃদু হেসে সামনে নিয়ে এলেন তাঁর সংগৃহীত সম্পদ। বললেন, ‘আমি গোপনে এগুলি তোমাদের জন্য সংগ্রহ করেছি। তখন তোমাদের জানালে তোমরা লোভে আর উত্তেজনায় এত হিরে-জহরত তুলতে যে জাহাজ ভাসিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে যেত। এ যথেষ্ট পাওয়া গেছে, নাও তোমরা সমান ভাগে ভাগ করে নাও। জানবে, সুযোগ বা সৌভাগ্যকেও সংযত মনে গ্রহণ করতে হয়, নাহলে সমূহ বিপদ।’
যাত্রীরা আবিষ্টের মতো সুপারগের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে, যেন তাদের দেবদর্শন হচ্ছে। সেই সন্দিহান কয়েকজন লুটিয়ে পড়ে তাঁর পায়ে, ক্ষমা করো হে ঠাকুর। সুপারগ দেখেন, তাঁর চোখদুটো যেন আরও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved