জাভেদ আখতারের বাবা, জান নিসারও, একরোখা কমিউনিস্ট; চূড়ান্ত রাগ তাঁর, সিস্টেমের বিরুদ্ধে। গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরোল তাঁর নামে। লখনউতে, স্ত্রী সফিয়ার জিম্মায় ছোটো দুই ছেলেকে রেখে, গা-ঢাকা দিলেন বম্বেতে। সফিয়ার ক্যানসার ধরা পড়ল। নিরুদ্দেশ স্বামীর উদ্দেশে, চিঠির পর চিঠি লিখলেন তিনি, উত্তর আসবে না জেনেও। মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে সফিয়া মারা যাওয়ার পরেও, দুই ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারেননি জান নিসার। কারণ, ইন্ডাস্ট্রিতে তখন লেখকদের যা পারিশ্রমিক, তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না।
থইথই প্রেম আর থরথর রাগ– বোধহয়, একই কয়েনের দুটো পিঠ। মনস্তাত্ত্বিকরা কী বলবেন, জানি না; তবে, কবি আর গীতিকারদের কথা ভাবলে, এরকমই মনে হয়। ধরুন, নজরুল ইসলাম। পাঠ্যপুস্তকে পইপই পড়ানো হল, তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’। এদিকে, ভাঁড়ার দেখুন। কী লিখলেন? ‘দেহেরও দেউড়িতে বেড়াতে আসিয়া/ অউর নেহি ওহ ওয়াপস গয়ি/ আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন/ দিল ওহি মেরা ফাঁস গয়ি…’ বা, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণিবায়/ জল-তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায়…’ বলুন, প্রেম কোথাও কম?
এরকমই একপেশে তকমা জুটল মখদুম মহিউদ্দিনের। মানুষটা, আসলে, ৬১ বছরের আয়ুষ্কালে এতগুলো জীবন বেঁচেছেন– তাঁকে একটা তকমা দেওয়া, মূর্খতাই। অনাথ শৈশবে, হায়াদ্রাবাদে, ঝাঁট দিতেন একটা মসজিদে। এম.এ. পাশ করে, শুরু করলেন উর্দু সাহিত্যের অধ্যাপনা। কিন্তু, ওই, কোনও এক বোধ কাজ করে…! লেখালেখির পাশাপাশি, চারের দশকে, হয়ে উঠলেন অন্ধ্রপ্রদেশ কমিউনিস্ট পার্টির উজ্জ্বলতম নেতা। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্টে, তাঁর ভক্ত নয়, এমন কেউ তখন ছিল না।
তেলেঙ্গানা সশস্ত্র বিদ্রোহে, কলম ফেলে, সত্যি-সত্যি বন্দুক তুলে নিলেন মখদুম। নিষিদ্ধ ‘ইনকিলাব’ আহ্বানের অপরাধে, জেল হল দু’বার। অতিষ্ঠ নিজাম (তখনও হায়াদ্রাবাদ স্বাধীন রাজ্য) তাঁর মাথার পুরস্কার ঘোষণা করলেন। বাধ্য হয়ে, কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড হলেন তিনি। ফিরে এসেও, আবার আন্দোলন। আবার জেল। সাহিত্য ও সংগ্রামের এমন সাংঘাতিক সহাবস্থান সারা দুনিয়াতেই বিরল।
সিনেমায় কখনও সরাসরি গান লেখেননি মখদুম। কিন্তু, তাঁর কবিতা এত জনপ্রিয়, দশকের পর দশক, ফিল্মমেকাররা সেগুলোকে নিয়ে, বানালেন অমর সব গান। যেমন, ‘ফির ছিড়ি রাত, বাত ফুলোঁ কি…’ বা, ‘রাত ভর দিদা-এ-নমনাক মেঁ লেহেরাতে রহে/ সাঁস কি তরাহ সে আপ আতে রহে যাতে রহে…’। এক যুগল খুন হল তাঁর সামনে; কারণ, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ। লিখলেন, ‘এক চামেলি কে মন্ডবে তলে/ দো বদন প্যার কি আগ মে জ্বল গয়ে…’। একাধিক সিনেমায় এটাই, রোম্যান্টিক গান। জাস্ট একবার ভাবুন, বন্দুক-হাতে একজন, যিনি জানেন যখন-তখন যেকোনও দিক থেকে আক্রান্ত হতে পারেন, তিনি লিখছেন, ‘খুদা ভি মুস্কুরাতা থা জব হম প্যার করতে থে…’!
লতা মঙ্গেশকরের নিজের গাওয়া সব গানের মধ্যে দু’খানি তাঁর চির-প্রিয়– ‘আপ ইয়ুঁ ফাসলোঁ সে গুজরতে রহে…’ আর, ‘অ্যায় দিল-এ-নাদান…’। ঘটনাচক্রে, দুটো গানেরই সুরকার, খৈয়াম; গীতিকার, জান নিসার আখতার। আশ্চর্যের বিষয়, খৈয়াম আর জান নিসারের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন– একই। লতা আফসোস করতেন, লিরিসিস্ট হিসেবে কখনও যথেষ্ট মর্যাদা পাননি জান নিসার।
জাভেদ আখতারের বাবা, জান নিসারও, একরোখা কমিউনিস্ট; চূড়ান্ত রাগ তাঁর, সিস্টেমের বিরুদ্ধে। গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরোল তাঁর নামে। লখনউতে, স্ত্রী সফিয়ার জিম্মায় ছোটো দুই ছেলেকে রেখে, গা-ঢাকা দিলেন বম্বেতে। সফিয়ার ক্যানসার ধরা পড়ল। নিরুদ্দেশ স্বামীর উদ্দেশে, চিঠির পর চিঠি লিখলেন তিনি, উত্তর আসবে না জেনেও। মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে সফিয়া মারা যাওয়ার পরেও, দুই ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারেননি জান নিসার। কারণ, ইন্ডাস্ট্রিতে তখন লেখকদের যা পারিশ্রমিক, তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না।
ভাবুন, এমন একজন হতভাগ্য, সারাজীবন চেষ্টা করে গেলেন, রেওয়াজি সাহিত্যের বদলে, সহজ-সরল শব্দে গান বেঁধে, মানুষের কাছে পৌঁছনোর। যেমন, ‘আঁখোঁ হি আঁখোঁ মেঁ ইশারা হো গয়া…’, ‘পিয়া পিয়া পিয়া মোরা জিয়া পুকারে…’ বা, ‘আজা রে ও মেরে দিলবর আজা…’।
একবার, চোখ বন্ধ করে, আটের দশকের রেখাকে মনে করুন। বুকে হাত দিয়ে বলুন, কী মনে পড়ছে! হ্যাঁ, ‘দিল চিজ ক্যা হ্যায় আপ মেরি জান লিজিয়ে…’। গীতিকার, শাহরিয়ার। তাঁর শব্দচয়নের মাধুর্যে, কেঁপে উঠলেন যশ চোপড়া। অফার দিলেন, যশ রাজ ফিল্মসের আগামী তিনটে সিনেমায় গান লিখুন শাহরিয়ায়। কিন্তু, ওই… প্রেম আর রাগ! রাগ আর প্রেম! সাফ বলে দিলেন কবি, ‘আমি গানের দোকান খুলতে আসিনি!’ এর পর, তিনি লিখলেন, ‘তুঝ সে হোতি ভি তো ক্যা / হোতি শিকায়ৎ মুঝ কো…’।
কলকাতায় পড়াশোনা করতে এলেন ভারত ব্যাস। ছাত্র-জীবনে, নিজের খরচ নিজেকেই জোগাড় করতে হল তাঁকে। লেখাপড়ার ফাঁকে, বাচ্চাদের পড়ানো; আর, রাত্তিরে একটা কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি। একদিন, ফাঁকা অন্ধকার নিঝুম বিল্ডিংয়ে বসে থাকতে থাকতে, একাকিত্বের তীব্রতায় চমকে উঠলেন হঠাৎ। লিখলেন, ‘নির্বল সে লড়াই বলবান কি/ ইয়ে কহানি হ্যায় দিয়ে কি অউর তুফান কি…’। অনেক বছর পর, এই কবিতা শুধু গানই হয়ে উঠল না; ফিল্মের নামও রাখা হল ‘তুফান অউর দিয়া’।
মাথা-গরম করে, বাড়ি ছেড়ে চলে গেল তাঁর ছেলে। এদিক-ওদিক খোঁজখবর করে, কিছুই সন্ধান পেলেন না ছেলের। বাড়ি ফিরে লিখলেন, ‘জরা সামনে তো আও ছলিয়ে/ ছুপ ছুপ ছলনে মে ক্যা রাজ হ্যায়…’। মনমোহন দেশাইয়ের বড় ভাই, সুভাষ দেশাই তখন একটা সিনেমা করছেন; গান দরকার। ভারতের কাছে এসে, দেখলেন মনমরা কবি কিছুই লিখতে চাইছেন না। অনেক পীড়াপীড়িতে, সদ্য-লেখা ওই কবিতাটাই ধরিয়ে দিলেন সুভাষকে। প্রযোজক মশাই পড়ে দেখলেন, এ তো বাবা-ছেলের রাগারাগি! তাঁর দরকার প্রেমের গান। তিতিবিরক্ত ভারত কাগজটা ছিঁড়ে, ছুড়ে দিলেন সুভাষের মুখে। টুকরো কাগজগুলো কুড়িয়ে তুলে, সুরকার এস. এন. ত্রিপাঠীর হাতে দিলেন প্রযোজক। সে বছর গীতমালা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ছিল ওই গান।
এস. এন. ত্রিপাঠীর সঙ্গে ভারত ব্যাসের সম্পর্ক অনেক দিনের। একবার, সামান্য কারণে, ঝগড়া হয়ে গেল দু’জনের। কথা বন্ধ, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ইন্ডাস্ট্রিতে সকলে অবাক, একটু চিন্তিতও– ‘আধা হ্যায় চন্দ্রমা রাত আধি…’-র মতো গান আর কে লিখবেন! বেশ কিছুদিন পর, মাঝরাতে, ফোন বাজল ত্রিপাঠীর বাড়িতে। ঘুম-চোখে, রিসিভার তুলে, সুরকার বুঝলেন ও’প্রান্তে কবি। বলছেন, ‘নতুন একটা কবিতা লিখেছি…’। সকাল হতেই, ত্রিপাঠী পৌঁছলেন তাঁর বাড়ি, কবিতাটা শুনতে। আর, সেই দিনই সুর বেঁধে, রেকর্ডিং হল সেই কবিতা, ‘আ লউট কে আজা মেরে মিত, তুঝে মেরে গীত বুলাতে হ্যাঁয়…’।
হ্যাঁ, ‘বিদ্রোহী’ যদি বলতেই হয়, মায়া গোবিন্দকে বলুন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে, আমন্ত্রণ পেলেন মুশায়েরাতে। হেঁজিপেঁজি মুশায়েরা নয়– পাঠ-সভার মুখ্য দায়িত্বে, হিন্দি সাহিত্যের নক্ষত্র, রামধারি সিং দিনকর। সেইসময়ে, রীতি ছিল, মহিলারা মঞ্চে উঠবেন মাথায় ঘোমটা বা ওড়না টেনে। মায়া, ওই বয়েসেই, রীতির তোয়াক্কা করলেন না; ঘোমটা তো দূর, চুলই বাঁধলেন না। বরং, লিখলেন, ‘ঘুংটা জ্বালা দুঙ্গি ম্যায়…’।
নয়ের দশকে, পরপর কয়েকটা গানের কথায় নজর পড়েছিল সেন্সর ও আমজনতার। যেমন, ‘চোলি কে পিছে ক্যা হ্যায়…’, ‘সেক্সি সেক্সি সেক্সি মুঝে লোগ বোলে…’, ‘মেরি প্যান্ট ভি সেক্সি, মেরি শার্ট ভি সেক্সি…’, আরও অনেক। ক্লোজ আপ সংগীত মুকাবলার সঞ্চালক, সিরাজ সইদ বললেন, ‘…ল্যান্ড অফ কামসূত্র হ্যাজ রিচড এ ডেড এন্ড।’ ওই সময়েই, বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে, মায়া লিখলেন, ‘চড় গয়া উপর রে/ আটরিয়া পে সোনা কবুতর রে…’। অশ্লীলতার দায় এসে পড়ল তাঁর ওপর। দৃঢ় গলায় জবাব দিলেন তিনি, ‘আমার লেখা শব্দে বিন্দুমাত্র অশ্লীলতা নেই…।’ এ দেশের গাঁ-ঘরে, বিশেষত উত্তর ভারতে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা বিয়ের গান, লোকগীতি, পল্লীগীতি– এসবের সঙ্গে যাঁরা অল্প-বিস্তর পরিচিত, তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, মায়া খুব ভুল কথা বলেননি।