জ্ঞানদা আর্শির সামনে দাঁড়িয়েই চিঠিটি পড়ছে। পড়ে পালঙ্কে শুয়ে আরও একবার পড়বে। তারপর রাত্রে মশারির মধ্যে সেজের আলোয় আরও কতবার, কে জানে! চিঠির শেষ লাইনটা দু’বার পড়ে সে আয়নায় নিজেকে তার বরের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে। তার মুখে মৃদু হাসি। সে বাকি চিঠি পড়তে থাকে।
৬.
জ্ঞানদা যেন এক ছোট্ট পাখি। আর পেশোয়াজ পোশাকটা তার ডানা। কত দূরে তার বর। কত সমুদ্র, পাহাড়, দেশ পেরিয়ে ইংল্যান্ড। কী করে সে জানাবে তার বরকে, পেশোয়াজ তাকে দিয়েছে একটা মস্ত বড় নতুন আকাশ, যে আকাশ মুক্তির। শাড়ি তাকে বেঁধে রেখেছিল শুধুমাত্র মেয়েদের অন্দরমহলে। যেখানে যখন খুশি যেমন খুশি ওড়ার আকাশ নেই। জ্ঞানদার মনে হয়, পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল। ঘরে-বাইরে এক হল। পুরুষদের সামনে শাড়ি সামলানোর দায় আর নেই। কী মুক্ত, স্বাধীন, খুশি মনে হচ্ছে নিজেকে! কিন্তু জ্ঞানদার মনে একটা কষ্টের কথা সে কাউকে বলতে পারছে না। তার বর তাকে অনেক দিন চিঠি লেখেনি!
পেশোয়াজ পরে বিকেলের আলোয় সে আরও একবার দাঁড়াল তার শোওয়ার ঘরের বেলজিয়াম আর্শির সামনে। আর তখুনি পাশেই শ্বেতপাথরের গোলটেবিলের ওপর রুপোর ট্রে-তে জ্ঞানদা দেখতে পেল ইংল্যান্ড থেকে আসা তার বরের চিঠির খাম! ট্রে-র একপাশে রাখা হাতির দাঁতের খাম-খোলার ছুরি।
‘ভাই বর্জিনী,
তুমি মনে করিয়াছ, আমি তোমাকে ভুলিয়া গিয়াছি। কিন্তু এতদিন পত্র লিখি নাই বলিয়া যে তোমাকে ভুলিয়া গিয়াছি, তা নয়। তোমাকে আমি সর্বদাই মনে করি। তুমি শুনিয়াছ, আমি আমার, প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছি। আগামী জুলাই মাসে আর এক পরীক্ষা আছে। তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারিলে বোম্বাই প্লেসিডেন্সিতে গমন করিব। আমি বোম্বাই গেলে তুমি অবশ্য আমার সঙ্গে যাইবে।’
পড়ুন গত পর্ব: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
রুদ্ধশ্বাস একটানে এতটা পড়ে এইখানে থামতে বাধ্য হয় জ্ঞানদা! ‘আমি বোম্বাই গেলে তুমি অবশ্য আমার সঙ্গে যাইবে’, লাইনটা আবার পড়ে জ্ঞানদা। সে নিজেকে দেখতে পায় পেশোয়াজ পরে তার বরের হাত ধরে বোম্বাইয়ের ট্রেনে উঠছে। কিন্তু জ্ঞানদার বুকের ভেতর হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে ওঠে ভয়। বাবামশায়ের অনুমতি চাই তো! বাবামশায় যদি নিষেধ করেন। বাকি চিঠিটা পড়তে শুরু করে জ্ঞানদা:
‘তুমি এখন না জানি কত বড় হইয়াছ। এখন তোমার শরীরের স্ফূর্তি ও লাবণ্য বৃদ্ধি হইবার সময়।
তোমার যৌবন-কুসুমের কলিকাবস্থা গিয়া তাহা এখন প্রস্ফুটিত হইতে চলিবে।’
জ্ঞানদা আর্শির সামনে দাঁড়িয়েই চিঠিটি পড়ছে। পড়ে পালঙ্কে শুয়ে আরও একবার পড়বে। তারপর রাত্রে মশারির মধ্যে সেজের আলোয় আরও কতবার, কে জানে! চিঠির শেষ লাইনটা দু’বার পড়ে সে আয়নায় নিজেকে তার বরের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে। তার মুখে মৃদু হাসি। সে বাকি চিঠি পড়তে থাকে:
‘তুমি এখন আপনিই আপনার রক্ষিত্রী– এবং তোমার আপনার মনের বলের উপর তোমার সুখ-দুঃখ নির্ভর।
তুমি যাঁহার উপর অবলম্বন করিবার আশা কর, তিনি তোমা হইতে দূরে, তোমার আর কিছুদিন এখনও প্রতীক্ষা করিতে হইবে।’
কিছুতেই দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারে না জ্ঞানদা। তার মনের ভেতরটা হু হু করে। চিঠির শেষে যে-প্রশ্নটি, সেখানে স্থির হয় তার ছলছলে চোখ:
‘রবি কত বড় হইয়াছে?’
ঠিক সময়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি মারে দু’-বছরের রবি! যেন মোমের পুতুল! এই ছেলেকে কি না জ্ঞানদার শাশুড়ি সারদাদেবী বলেন, কালো ছেলে! জ্ঞানদা দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় তার আদরের দেওরকে। আর দু’-গালে চুমু না দিয়ে পারে না।
জ্ঞানদাকে লেখা সত্যেন্দ্রর চিঠি কিন্তু এখানেই শেষ নয়। শেষে আরও একটি প্রশ্ন। সত্যেন্দ্র জানতে চেয়েছেন স্ত্রী জ্ঞানদার কাছে। রবিকে কোলে নিয়ে চিঠির শেষ লাইনটি পড়ে জ্ঞানদা:
‘রবির পরে আমাদের আর এক ভ্রাতা হইয়াছে শুনিয়াছিলাম। তাহার নাম কী হইয়াছে?’
সে কী! তার বর এখনও এই খবর পায়নি! তার নাম তো রাখা হয়েছিল বুধেন্দ্রনাথ। শাশুড়ি তো বুধেন্দ্রর গায়ের রং দেখেও দুঃখ পেয়েছিলেন, ভাবে জ্ঞানদা। তবে গায়ের রঙের কারণে বুধেন্দ্রকে গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি। নামকরণের কিছুদিন পরেই সে মারা গেল। তার বর কেন এই খবর পায়নি? জ্ঞানদা তার বরকে চিঠি লিখে সব কথা এবার বলে দেব, কিচ্ছু ঢেকে রাখবে না। এই যে গায়ের রং একটু চাপা হলেই মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয় ছেলেমেয়েরা, নাতি-নাতনিরা, সেকথাও তার বরকে বলে দেবে জ্ঞানদা, মনে মনে সে এই সিদ্ধান্তে সে স্থির। সে লিখবে, তোমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বউয়ের ‘ছেলে’ না হলে আদর হয় না। আর বাঁজা বউকে তো ঘেন্নাই করা হয়। আমি তো নিজের চোখে দেখি, শাশুড়িঠাকরুণ বিকেলে মুখহাত ধুয়ে তক্তপোশের বিছানায় বসে দাসীদের বলেন, অমুকের ছেলে কি মেয়েকে নিয়ে আয়। তারা কোলে করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি চেয়ে চেয়ে দেখেন। নিজে বড় একটা কোলে নেন না। যারা সুন্দর তাদেরই ডাকেন। অন্যদের নয়। শাশুড়িঠাকরুণ মনে করেন, বাবামশায়ের মতো রাঙা গায়ের রং না হলে সুন্দর হয় না। আবার এ-ও বলেন, ওই গায়ের রং নাকি ব্রহ্মজ্ঞান আর ব্রহ্মচর্য থেকে হয়েছে। তাহলে বাবামশায়ের বছর-বছর ছেলেপিলে হচ্ছে কেন? এ-প্রশ্ন জ্ঞানদা তার বরকে করবেই!
(চলবে)
তথ্যসূত্র: পুরাতনী। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী