২.
–ঠাকুরপো, তুমি আমাকে বললে, আমাকে বুঝতে হবে আমি কার বউ। সে কি আমি বুঝিনি ভেবেছ? অমন ঘটা করে বিয়ে হল, বাবামশায় (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) আমাকে কী সুন্দর সুন্দর খেলনা দিলেন, আর আমি বুঝিনি আমি কার বউ! অত বোকা আমি নই ঠাকুরপো– আমি তো তোমার মেজদাদার বউ।
ঠাকুরপো হেমেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে সাত বছরের জ্ঞানদা কথাগুলো বলল এক নিশ্বাসে। ছয় বছরের বড় হেমেন্দ্র। ভারিক্কি চালে বলল, কিন্তু আমার মেজদাদাটি কে, তা তো তোমাকে জানতে হবে।
–সে কি আমি জানি না! তোমার মেজদাদাটি হল গিয়ে আমার বর।
–ওটা তো তার আসল পরিচয় নয়। হেমেন্দ্রর মুখে ঝিলিক দেয় হাসি।
–তাহলে আমার বরের আসল পরিচয়টা কী?
–আমার মেজদাদা মিস্টার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র, ভারতবর্ষের প্রথম ভারতীয় আই. সি. এস। এটা একটা ঐতিহাসিক পরিচয়। মেজবউঠাকরুণ, তোমাকে তাঁর উপযুক্ত বউ হতে হবে। আর তোমাকে তার উপযুক্ত করে গড়েপিটে তোলার দায়িত্ব মেজদাদা ইংল্যান্ড থেকে চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়েছেন। ক্লিয়ার?
–‘ক্লিয়ার’ মানে কী, বুঝতে পেরেছ তো?
হেমেন্দ্র অবাক হয়ে তাকায় জ্ঞানদার দিকে। জ্ঞানদা যে বুদ্ধিমতী– তার চোখ দেখলেই বোঝা যায়। হেমেন্দ্র সেই জ্বলজ্বলে চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে বলে, মেজবউঠান, ‘ক্লিয়ার’ শব্দটার মানে তুমি ঠিক জানো না। কিন্তু বুদ্ধি খরচ করে তুমি মানেটা ঠিক ঠাওরেছ। আমি কিন্তু তারিফ করছি বউঠান তোমার চালাকির।
–ক্লিয়ার মানে কী গো?
–ক্লিয়ার মানে পরিষ্কার। আমি যদি প্রশ্ন করি, ‘ক্লিয়ার?’, তাহলে বুঝবে, আমি জানতে চাইছি, ব্যাপারটা তোমার কাছে পরিষ্কার তো?
–একদম ক্লিয়ার, হেসে বলে সাত বছরের জ্ঞানদা। তারপর মাথার ঘোমটা টানে। তারপর বলে, আই. সি. এস. মানে?
–ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস। বা, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্টও হতে পারে।
–‘সার্ভেন্ট’ মানে তো চাকর, ঠাকুরপো। ওটা জানি। আমার বর কি তাহলে…?
–না না, তোমর বর বিলেতে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেবেন, বুঝেছ? ওর থেকে বড় চাকরি ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে নেই। এতদিন ওই চাকরি শুধু সাহেবরাই করেছেন। আমার মেজদাদা প্রথম ইন্ডিয়ান, যিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন!
–ওরে বাবা! তার মানে কী, ঠাকুরপো?
–তার মানে তোমাকে মেমসাহেব হতে হবে মেজবউঠান। আর তোমাকে মেমসাহেব বানানোর দায়িত্ব মেজদাদা আমাকেই দিয়েছেন। সুতরাং, আমার ঘরে এসো। তোমার মেমসাহেব হওয়ার প্রথম পাঠ আজকেই শুরু হবে।
–তোমার ঘরে?
–হ্যাঁ গো। কিন্তু তার আগে ঘোমটা সরাও। তোমাকে পইপই করে বলেছি মেজবউঠান, আমার ঘরে ঘোমটা মাথায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। এনট্রি প্রহিবিটেড।
–মানে?
–ওটা ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ’-র ইংরেজি। ইংরেজিতে আমার ঘোষণাটাকে আরও জোরদার করলুম। এই আজ্ঞা এখন তুমি মানতে বাধ্য।
–তোমার সামনে আমার মোটেও ঘোমটা দিতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ঘোমটা না দিলে পিঠটা যে খোলা থাকে। কেউ যদি দেখে ফেলে।
–ফেলুগ্গে। তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে, তুমি দেখাবে না বউঠান? তাছাড়া, তুমি যখন ইংল্যান্ড যাবে, শেক্সপিয়র, মিল্টন, বায়রনের দেশে যাবে, তখন একগলা ঘোমটা দেবে না কি?
–ইংল্যান্ড কোথায়, তা-ই আমি জানি না, আর আমি যাব ইংল্যান্ড?
–আমার ঘরে এসো বউঠান। ইংল্যান্ড কোথায় কতদূরে সব জানবে!
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন। সমীর সেনগুপ্ত। সাহিত্য সংসদ