প্রসন্নকুমার জ্ঞানদাকে গর্ভনরের পান-ভোজনের পার্টিতে একা আসতে দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কী পোশাকে এসেছে জ্ঞানদা, ঠাকুরবাড়ির গৃহবধূ! এ তো বাইজির পোশাক! প্রসন্নকুমারের ছিঃ ছিঃ ধিক্কার ছড়িয়ে পড়ল পার্টিতে উপস্থিত বা অভিজাত বাঙালির মুখে মুখে! অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি ফুটে উঠল জ্ঞানদার ঠোঁটে। যে-আগুন সে লাগাতে চেয়েছে, সেই আগুন এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে, ভাবেনি জ্ঞানদা।
৮.
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। আজ পেশোয়াজ পোশাকটির মহাপরীক্ষা। স্বয়ং বাবামশায়ের আদেশে এই পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে জ্ঞানদা। বাংলার গর্ভনর স্বয়ং লর্ড লরেন্সের নেমন্তন্ন এসেছে জ্ঞানদার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। কিন্তু তিনি তো এখনও ইংল্যান্ডে। আরও কিছুদিনের মধ্যে প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস হয়ে ফিরবেন। ভাবতেই বুকের মধ্যে শিহরণ জাগে জ্ঞানদার। সেই সঙ্গে বেদনাও। আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আই.সি.এস স্বামীকে পাশে পেতে? বাবামশায়ের একমাত্র ছেলে যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে! বাবামশায়ের পাঠানো হাত-খরচের উপর, জমিদারি থেকে আসা অর্থের উপর যাকে নির্ভর করতে হবে না।
কিন্তু আজকের সন্ধেবেলার ওই নেমন্তন্নর কথাটা ভাবতেই বুকের মধ্যে জড়ো হচ্ছে একরাশ ভীতি ও সংকোচ। বাবামশায় বলেছেন, সত্যেন বিদেশে, তার পরিবর্তে বউমা তুমি যাবে আজ গর্ভনরের পার্টিতে!
–আমি একা যাব? কাঁপা-কাঁপা অস্পষ্ট প্রশ্ন জ্ঞানদার।
–হ্যাঁ, তুমি যাবে। সঙ্গে একজন দাসী যাবে। বাড়ির ঘোড়ার গাড়ি, দারোয়ান সবই থাকবে। কিন্তু তোমাকে তোমার স্বামীর পরিবর্তে যেতে হবে একাই। এবং তোমার পরনে থাকবে পেশোয়াজ।
–পেশোয়াজ পরে যাব?
–নিশ্চয়ই। পেশোয়াজ কি ঘরবন্দি হয়ে থাকবে চিরকাল?
জ্ঞানদার ভয় করছে। কিন্তু ভালও লাগছে। মনে মনে বেশ একটা গর্ববোধ করছে সে। আয়নার সামনে দাঁড়ায় জ্ঞানদা। এবং নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। সে সুন্দর। কিন্তু এত সুন্দর! তার নিজের চোখ বিশ্বাস করতে চায় না। চিঠিতে লেখা তার স্বামীর কথাগুলি মনে পড়ে: ‘তুমি এখন না জানি কত বড় হইয়াছ। এখন তোমার শরীরে স্ফূর্তি ও লাবণ্য বৃদ্ধি হইবার সময়। তোমার যৌবন-কুসুমের কলিকাবস্থা গিয়া তাহা এখন প্রস্ফুটিত হইতে চাহিবে।’
এ তো অনেকদিন আগে পাওয়া চিঠি। তবু কথাগুলি তার স্বামীর হাতের লেখায় মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। জ্ঞানদা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নিজেকে নিরীক্ষণ করে আয়নায়। তার মনে হয়, মনে হয় কেন, সে স্পষ্ট দেখতে পায়, পেশোয়াজ পোশাকটির তলায় তার যৌবন-কুসুমের কলিকাবস্থা গত হয়ে এখন প্রস্ফুটনের প্রবাহ শুরু হয়েছে। আশ্চর্য! জ্ঞানদার মনে তেমনভাবে লজ্জার উদয় হল না। বরং জাগছে অহং মেশানো ভাল লাগার ঘোর। কত সাহেব-মেম আসবে আজকের পার্টিতে! তাদের মধ্যে আজ তার পেশোয়াজ পরে আবির্ভাব। এবং সে একা। স্বামীর সঙ্গে নয়। এ তো বিপ্লব। এবং ইতিহাস।
–তোমাকে বউতান খুব ছুন্দর দেখাচ্ছে, ঘরের মধ্যে দৌড়ে ঢুকে আদো উচ্চারণে বলল পুতুলের মতো রবি। পেশোয়াজের বুকের উপর, হিরে-পান্নার ঝলকের দিকে তাকিয়ে, মুগ্ধতার মধ্যে কথাগুলো শুনে জ্ঞানদা অবাক হয়ে তাকায় রবির দিকে।
–আগে বলো আমাকে কেন সুন্দর দেখাচ্ছে।
–তুমি ছুন্দর। তাই ছুন্দর দেখাচ্ছে।
রবির এই উত্তরে আরও অবাক হয় জ্ঞানদা। বলে, আর এই পোশাকটা কেমন বললে না তো।
–তোমার থেকে ছুন্দর নয় বউতান। এতার কী নাম?
–এটার নাম পেশোয়াজ।
পড়ু্ন পর্ব ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
রবি জ্ঞানদার পোশাকটি হাঁটুর কাছে ছুঁয়ে দেখে। তারপর বলে, খুব নলোম। তোমার মতো।
জ্ঞানদা হেসে ফেলে। কলে তুলে নেয় রবিকে। বলে, এবার আমাকে যেতে হবে রবি।
–কোথায়?
–পার্টিতে।
–পার্তিতে? সেটা কী বউতান?
–সেখানে অনেক লোকজন। অনেক ভিড়।
–আলো। গান। বাজনা। নাচ। এইসব?
–তুমি জানো?
–আমি সব জানি। আর অমনি দেখতে পাই। চোখ বুজলে দেখতে পাই। আমি যাব।
–কোথায় যাবে?
–পার্তিতে।
–সেখানে তো ছোটরা যায় না রবি।
–শুধু বড়রা যায়?
–শুধু বড়রা।
রবিকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় জ্ঞানদা। ‘পার্তিতে শুধু বড়রা, শুধু বড়রা’– বলতে-বলতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় রবি।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢোকেন সারদা। প্রায় কখনওই আসেন না তিনি। আজ এলেন। এবং জ্ঞানদাকে নিরীক্ষণ করলেন কিছুক্ষণ। কোনও কথা নেই তাঁর মুখে। অবশেষে বললেন, শুনলাম তুমি গর্ভনর সায়েবের পার্টিতে যাচ্ছ একা!
–হ্যাঁ মা। আপনাদের ছেলে যেহেতু যেতে পারছেন না, আমাকে একাই যেতে হবে।
–এবং তোমাকে তিনি নাকি পেশোয়াজ পরেই সেখানে যাবার আদেশ করেছেন।
জ্ঞানদা কিছু বলে না। সে সারদাকে প্রণাম করে। সারদা একটি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সেই প্রণাম গ্রহণ করে জ্ঞানদার মাথায় হাত রাখেন। তারপর বলেন, খুব সাবধানে থাকবে। যে দাসী তোমার সঙ্গে যাচ্ছে, তার চোখের আড়ালে যাবে না। আর বেশিক্ষণ থাকারও প্রয়োজন নেই। কোনওরকমে নিয়মরক্ষে করেই চলে এসো।
–হ্যাঁ মা, তাই করব।
–আমাদের যুগ আজ শেষ হল জ্ঞানদা, আরও এক দীর্ঘশ্বাসে বাক্যটি ভাসিয়ে দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যান সারদা। জ্ঞানদা বুঝতে পারে, শাশুড়ির এই উক্তি কী গভীর বেদনার।
চার ঘোড়ার গাড়িতে উঠেই সারদার খেদোক্তিটি মনে পড়ে জ্ঞানদার। জ্ঞানদা নিশ্চিন্ত, আজ সত্যিই একটি যুগ শেষ হল। এবং নতুন যুগের দিশারি সে! সারদা কোনও দিন এই যুগের নাগাল পাবেন না।
জ্ঞানদার মনে পড়ে তার শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশের মুহূর্তটির সে মা-বাবার জন্য কাঁদতে-কাঁদতে পালকিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছোট্ট জ্ঞানদাকে সারদা কোলে তুলে পালকি থেকে নেমে জোঁড়াসাকোর প্রাসাদের মতো বাড়িতে ঢুকলেন। শাশুড়ির কোলেই ঘুম ভাঙতে আবার ডুগরে উঠল জ্ঞানদা।
সঙ্গের দাসীটি বলল, মেয়ে সারা রাস্তা এত কেঁদেছে যে কাঁদতে-কাঁদতে বমি করেছে।
–বমি করেছে! চমকে বললেন সারদা। সেই বমি কোথায়?
–সে বমি তো পালকিতেই পড়ে আছে।
–সেই বমি পালকিতে ফেলে এসেছিস! কিছুই কি নিয়মকানুন, ধম্যকম্য জানিসনে তোরা? বাটি করে তুলে আন সেই বমি। বাগানে মাটির তলায় পুঁতে রাখ। জানিসরা তোরা, যত ওগরাবে তত শোধরাবে।
এই কথাটার মানে আজও তেমনভাবে ঠাওর করতে পারেনি জ্ঞানদা। তবে ক্রমশ বুঝেছে, সারদা এক অন্ধকার যুগের মানুষ। বাবামশায়ের সঙ্গে এতকাল থেকেও আলোর ছোঁয়া পাননি। তাই নতুন যুগের আগমন বার্তায় এমন মানুষের খেদে কোনও খাদ নেই!
গর্ভনর হাউসের বিশাল লন পেরিয়ে জ্ঞানদার চারঘোড়ার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল বিস্তীর্ণ সোপান শ্রেণির সামনে। আলোয়-বাজনায়-বর্ণময় সমাগমে তখন বাংলার গর্ভনর লর্ড লরেন্সের পার্টি থইথই করছে। জ্ঞানদার দাসী গোলাপ ঘোড়ার গাড়ি থেকে আগে নামল। তারপর হাত ধরে নামাল জ্ঞানদাকে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বধূ, তার উপর হবু আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী– স্বয়ং গর্ভনর সস্ত্রীক এগিয়ে এলেন তাকে স্বাগত জানাতে।
–সত্যেনের স্ত্রী না? চমকে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর। ইনি যে সে মানুষ নন! ঠাকুরবংশের দর্পনারায়ণ ঠাকুরের নাতি, গোপীমোহন ঠাকুরের ছোট ছেলে, সম্পর্কে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাই, যে-দ্বারকানাথের উইলের তত্ত্বাবধায়ক প্রসন্নকুমার! এবং দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে যখন পুত্র দেবেন্দ্রনাথ পিতৃঋণের সমুদ্রে ডুবতে বসেছেন, তখন তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রসন্নকুমার।
এহেন প্রসন্নকুমার জ্ঞানদাকে গর্ভনরের পান-ভোজনের পার্টিতে একা আসতে দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এবং এ কী পোশাকে এসেছে জ্ঞানদা, ঠাকুরবাড়ির গৃহবধূ! এ তো বাইজির পোশাক! প্রসন্নকুমারের ছিঃ ছিঃ ধিক্কার ছড়িয়ে পড়ল পার্টিতে উপস্থিত বা অভিজাত বাঙালির মুখে মুখে! এবং অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি ফুটে উঠল জ্ঞানদার ঠোঁটে। যে-আগুন সে লাগাতে চেয়েছে, সেই আগুন এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে, ভাবেনি জ্ঞানদা।
এক অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ বিপ্লব ও পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা, বুঝতে পারল জ্ঞানদা। এবং তার পায়ের নীচে মাটি শক্ত করতে বিলেত থেকে ফিরে আসছে তার আই.সি.এস স্বামী। জ্ঞানদাকে আটকাবে কে? হঠাৎ জ্ঞানদার মনের মধ্যে তার স্বামী সত্যেন্দ্রর মুখ ঝাপসা হয়ে যায়। দেওর জ্যোতিরিন্দ্রর অনিন্দ্যসুন্দর অবয়ব জেগে ওঠে তার মনে। ‘নতুন’– জ্ঞানদার মনে তীব্র বাসনায় কাঁপতে থাকে– আমাকে আঁকড়ে ধরো ‘নতুন’, তোমাকেই আমার প্রয়োজন। ঠাকুরবাড়ির মধ্যমঞ্চে এবার আমরা দু’জন! নতুন, তুমি আর আমি!
(চলবে)