এক বন্ধু ভাঙা প্রেমের টুকরো পকেটে পুরে উধাও। আমরা খেয়ালও করিনি। ভেবেছি রাত দশটা-সাড়ে দশটায় যেমন সব পাখি ঘরে ফেরে, তেমনই। বড়জোর এগারোটা। তাও যখন পেরতে চলল, তখন খোঁজ খোঁজ। এদিকে তার বাড়ির লোক ফোনে না পেয়ে বেজায় উদ্বিগ্ন। বারোটার কাছাকাছি আমাদেরও সাহসের বারোটা বাজল। যথারীতি চেনা এবং অচেনা মিলিয়ে বহু জায়গায় খোঁজাখুঁজি। এবং হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা। একটু পরে সে নিজেই ফিরে এলে আমরা তাকে প্রথমেই যাবতীয় সুমধুর অপভাষায় সম্ভাষণ জানালাম। প্রেমে ল্যাং খেয়েছ বলে মেসের স্ল্যাং বাদ যাবে কেন!
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
৯.
বিপদসীমা পেরিয়ে সেদিন সন্ধে নামল। তখন চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ বেরুল বনে। তার তো মেঘলা দুপুরে বেরনোর কথা। তবে, প্রেমের আকাশে কখন যে মেঘ! ঘনাদা নিরুদ্দেশ, মাধবীলতা নাছোড়বান্দা। মেঘের পরে মেঘ এবং আঁধার হয়ে আসা যুগপৎ। অশনি নিশান উড়ছে পতপতিয়ে। সন্ধে হওয়ার সঙ্গে বাঘের ভয়েরই চিরকেলে গাঁটছড়া। উপরন্তু মাথার উপর রবিঠাকুর সেই কবে সতর্ক করে দিয়ে গিয়েছেন, যে, শঙ্কা যেথায় নেই সেখানেই জাহাজডুবি। এখানে তো শঙ্কা ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা। আমরাও জানি, মেসমালিকও জানেন, নচ্ছার সন্ধেটা খুব সন্দেহজনক।
অতএব দ্রুত প্ল্যান-অফ-অ্যাকশন ঠিক করে নেওয়া গেল। দু’জন বেরিয়ে যাবে ঘনাদাকে খুঁজতে। বাকিরা নাইট ওয়াচম্যান। কোনওক্রমে খানিকটা সময় সামলে দিতে পারলেই হল। তবে, খোঁজা তো আর সোজা না। প্রেমে পথ হারায় যে পথিক, তার রাস্তা বড় বঙ্কিম। দুনিয়ার এই আজব কুদরতিতে খানিকক্ষণ যে নেই হয়ে থাকতে চায়, সে তো আর ঝড়ের কাছে ঠিকানা রেখে যায় না। জীবনের এইসব অকিঞ্চিৎ ঘটনায় নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা লেখারও কেউ থাকে না। তাহলে তাকে পাওয়া যাবে কোথায়? চা-দোকান, ঝিলের পার, এইটবি, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, চার নম্বর গেটের ওপারের ঠেক, কফি হাউসের নিচের আড্ডা ইত্যাদি সম্ভাব্য যে জায়গাগুলো আমাদের প্রথম মাথায় আসে, সে জায়গাগুলো তারও নখদর্পণে। পালাতে চাইলে সেইসব চেনা ছাড়িয়েই তো যাবে।
এইখানেই অঙ্ক মেলে না। চেনার মাঝে অচিনপুরে পাখি ক্য়ামনে আসে যায়! যতবার এ-ধরনের ঘটনা ঘটেছে দেখেছি, যে, ঠিক চোখের সামনেই যা থাকে, তাকে দেখতে পাই দেরিতে। এ কি কোনও বিজ্ঞান! জানা নেই। তবে পরীক্ষায় প্রতিবার একই সত্য প্রমাণিত। আর-একদিনের কথা প্রসঙ্গক্রমে। তখন আমরা অন্য মেসে। এক বন্ধু ভাঙা প্রেমের টুকরো পকেটে পুরে উধাও। আমরা খেয়ালও করিনি। ভেবেছি রাত দশটা-সাড়ে দশটায় যেমন সব পাখি ঘরে ফেরে, তেমনই। বড়জোর এগারোটা। তাও যখন পেরতে চলল, তখন খোঁজ খোঁজ। এদিকে তার বাড়ির লোক ফোনে না পেয়ে বেজায় উদ্বিগ্ন। বারোটার কাছাকাছি আমাদেরও সাহসের বারোটা বাজল। যথারীতি চেনা এবং অচেনা মিলিয়ে বহু জায়গায় খোঁজাখুঁজি। এবং হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা। একটু পরে সে নিজেই ফিরে এলে আমরা তাকে প্রথমেই যাবতীয় সুমধুর অপভাষায় সম্ভাষণ জানালাম। প্রেমে ল্যাং খেয়েছ বলে মেসের স্ল্যাং বাদ যাবে কেন! রাগী সব মেসবাসিন্দার সামনে পড়ে প্রেমে বৈরাগী একেবারে মৌন। বোবার শত্রু নেই, বন্ধু তো আছে। নাগাড়ে কয়েক পশলা বাক্যবর্ষণের পর, খেয়াল হল, আমরা সর্বত্র যে খুঁজে এলাম, এ ঘুঘু তাহলে বাসা বেধেছিল কোথায়? উত্তর এল, কেপিসি হসপিটাল। দিস্তি দিস্তি খিস্তি দিয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়লেও সকলে চমকে গেলাম। ভাবা উচিত ছিল। কলকাতা শহরে শ্মশান আর হাসপাতাল তো রাতজাগা তারা। যাঁরা সত্তরের কলকাতা আঙুলে নিয়ে ঘুরতেন, তাঁদের মুখেও তো শুনেছি হাসপাতাল চত্বরের সেই অমোঘ ভূমিকার কথা। সেদিন আর মাথায় আসেনি। অথচ এই কেপিসির আশপাশ দিয়েই আমরা ঘুরে খুঁজে এসেছিলাম তাকে।
ঘনাদার ক্ষেত্রেও একই। প্রায় সব জায়গা ঘুরে আমরা হতোদ্যম। মিঠুনের সঙ্গে যেহেতু দোস্তি ছিল, তাকেও বলা হল। সে-ও নাচার। অগত্যা পাংশুমুখে মেসে ফিরলাম। ততক্ষণে দেখা গেল, নাইট ওয়াচম্যানরা বাঁচাতে তো পারেইনি, উলটে বোল্ড। মেসের মালিক এসে দাঁড়িয়েছেন গেটে। দু’-কথা বলে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে, ব্যাপারটা মোটেও রোজকার নয়। মাধবীলতা মেসের বাইরের হতে পারে, তবে ব্যতিক্রম তো অভিধানের বাইরের কিছু নয়। অতএব একটা দিনকে যদি সেটাই ধরে নেওয়া যায়, তাহলে পরদিন থেকে আমরাই লক্ষণরেখা টেনে দেব। হেনকালে পায়ে পায়ে ঘনাদা এসে হাজির। ঝিমিয়ে পড়া হোমের আগুনে অগত্যা আবার একটু সস্তার ঘি। ফের একদফা তর্কবিতর্ক। বহু কথা খরচ করে অন্তত এই জায়গায় পৌঁছনো গেল যে, আজকের দিনটা আলাদা। এর কোনও পূর্বসূরি নেই। উত্তরসূরিও থাকবে না। অতএব ঝামেলা গেল মিটে। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
আর মাধবীলতা?
সে গেল কোথায়! এই এত হই-হট্টগোলের ভিতর মেয়েটি যেন কপ্পুর! ঘনাদা সমেত আমরা প্রত্যেকেই বললাম, বোধহয় একফাঁকে চোখের আড়ালে সে বেরিয়ে গিয়েছে। কেননা ঘনাদার ঘরে তার ওড়নাখানি পড়ে আছে শুধু। ছিল নেই, মাত্র এই! এতে বেশি বোঝার কী আছে! আমরাও এছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও সম্ভাবনা দেখতে পেলাম না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে সমঝোতায় নারাজ। কেননা মেস থেকে বেরনোর দ্বিতীয় রাস্তাটি নেই। আর তাঁরা নির্নিমেষ। তাহলে? শুরু হল খানাতল্লাশ। এ-ঘর, সে-ঘর করে উঁকি দেওয়া শুরু করলেন। মেয়েটিকে পাওয়া যায় না। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, যে বাংলায় সুভাষ ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন, সেখানে সামান্য মেসমালিকের নজর…! কিন্তু ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই ইউরেকা। তাও যে ঘরে হাট করে খোলা দরজা, কেউ ভাবেইনি যে সেখানে কেউ থাকতে পারে। মালিকরাও চলেই যাচ্ছিলেন, নেহাতই কৌতূহলে একবার… এবং চোখে পড়ে গেল, আমারই ঘরে আমার চৌকি আর দেওয়ালের ফাঁকে একফালি ঘুপচি জায়গায় একা একা বসে আছে সে। সেখানে আমার একটা লম্বা ব্যাগে জামাকাপড় থাকত। সেটিকে চৌকির তলায় পাঠিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আপন মুক্তাঞ্চলে সে নাকি ভারি নিশ্চিন্তেই ছিল। কেননা তার বদ্ধমূল ধারণা, এই ঘরে কেউ আসবে না।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..
আকস্মিক সে আবিষ্কারে আমাদের তখন জাহাজ না হোক, অন্তত চৌকিডুবি। তবু, ফুরোয় জীবনের সব লেনদেন। সেদিনের মতো জগঝম্পও তাই মিটল। মাধবীলতার জন্য আমাদের খারাপ লাগছিল। আর আমাদের জন্য তার। সে ভেবেছিল, অনেক রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে নাকি একা একা বেরিয়ে যাবে, যাতে ঘুণাক্ষরে কেউ টের না পায়। কিন্তু তার আগে আমাদের কথা শুনলে যে গোল-ই বাধত না, মনে করেই তার দুঃখপ্রকাশ। অনেক রাতে সেদিন সত্যিই আমরা জেগে ছিলাম। উদ্বেগের রাতে জল মিশিয়ে চালান করে দিচ্ছিলাম যাতে রাতের চোখে ঘোর লেগে যায়। তখন হঠাৎ মনে পড়ল, সন্ধেভর ঘনাদা ছিল কোথায়? বলল, সুলেখা ব্রিজে। এদিকে সন্তোষপুরের মুখ থেকে ওদিকে সুলেখা মোড় অবধি সে শুয়ে আছে, পোশাকি নাম সুকান্ত সেতু। মাঝখান থেকে ভেঙে গিয়ে শাখাসেতু মিশেছে পালবাজারের মোহনায়। সন্ধে নামার মুখে ইতিউতি সেখানে প্রেমের সিল্যুয়েট। আমরা কত দেখেছি। দেখেছি কি সেখানে কোনও একাকী মানুষ? নিঃশব্দে মিশে গেছেন অন্ধকারে। প্রেমের যুগল ধারণার ভিতর একেবারে একা।
এই অল্পস্বল্প না-দেখার ভিতরই বুঝি এই শহরটার কুহক। চাইলে সে চোখের সামনেই কাউকে ফুঁসলে নিয়ে যেতে পারে। একটা সন্ধেই তখন আত্মগোপনের চিরকুট, যেমন মেস আমাদের।
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭। মেস কি কোনও নারীচরিত্রবর্জিত একাঙ্ক নাটক!
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না