আলো পড়লে অভিনয়ের যে প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেটা এবার সেজে উঠবে। এতদিনের সব রিহার্সাল, সব প্রস্তুতিতে যেন একেবারে ভাঙচুর করে দিয়ে যায় এক আলোর থিয়েটারীয় রেখা। প্রথমে যখনই ফ্ল্যাট লাইটের মধ্যে মহড়া চলে, সেটা দিনের আলোও হতে পারে, আমি বহুকাল ফুটপাথে অভিনয় করেছি, মহড়া করেছি, আর রাতে হলে হয়তো একটা বাল্ব শুধু, সেটার চরিত্র আলাদা। যখন আলাদা করে আলো সংযোজন করা হয়, তখনই এতদিনের গোছানো, তালিমপ্রাপ্ত, নির্দেশিত চরিত্রটা, যে চরিত্রটাকে আমি হাঁটতে শিখিয়েছি, তার মধ্যে কোথাও একটা কম্পন শুরু হয়ে যায়। মনে হয়, এবার যেন সব ছন্নছাড়া হয়ে যাবে।
৬.
‘আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে’– এই লাইনটির মতো থিয়েটারে আলো ফিরে ফিরে আসে। আর আলোয় গেলে অন্ধকারে যেতেই হবে– এটাও থিয়েটারেরই দর্শন। জীবনেরই মতো। ছোটবেলা থেকেই এই আলো-অন্ধকারের খেলাটি শিখতে শিখতে বড় হয়েছি। আমি এর আগে এই ধারাবাহিকে রূপসজ্জা, মঞ্চসজ্জা ও রং নিয়ে লিখেছি। এই সব আয়োজন ভেস্তে যায়, যখন আলো এসে পড়ে। আলো পড়লে অভিনয়ের যে প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেটা এবার নতুন হয়ে উঠবে। এতদিনের সব রিহার্সাল, সব প্রস্তুতিতে যেন একেবারে ভাঙচুর করে দিয়ে যায় আলোর থিয়েটারীয় রেখা। যখন ফ্ল্যাট লাইটের মধ্যে মহড়া চলে, সেটা দিনের আলোও হতে পারে, আমি বহুকাল ফুটপাথে অভিনয় করেছি, মহড়া করেছি, আর রাতে হলে হয়তো একটা বাল্ব শুধু, সেটার চরিত্র ভিন্ন। যখন আলাদা করে আলো সংযোজন করা হয়, তখনই এতদিনের গোছানো, তালিমপ্রাপ্ত, নির্দেশিত চরিত্রটা, যে চরিত্রটাকে আমি হাঁটতে শিখিয়েছি, তার মধ্যে কোথাও একটা কম্পন শুরু হয়ে যায়। মনে হয়, এবার যেন সব ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। আমি জানি না অন্যদের কী মনে।
অভিনয় করতে এসে প্রথম যেদিন মঞ্চের আলো গায়ে মাখলাম, সেটা কিন্তু দর্শকের সামনে অভিনয় নয়, মনে হল, আলো একটা চরিত্র হয়ে এসে আমাকে বলছে– আমার জন্য নতুন করে তোমাকে আবার সাজতে হবে। যা তুমি করেছ, করেছ। সামনে আরও বিস্তর কাজ তোমার। এই নির্দেশটা নীরবে আসে আলোর ভেতর দিয়ে। অনেকেই বলেন, এই নাটকে আলো যেন কথা বলে উঠল। আমার মনে হয়, সব নাটকেই, প্রতিদিনকার চলনে, যাপনে, আলো কথা বলে। অন্ধকারও বলে। কখনও দীর্ঘ, কখনও হ্রস্ব, কখনও অস্ফূট। একচিলতে আলো, একটুকরো আলো, ফটফটে আলো, কখনও ছোট অঞ্চলের আলো, কখনও কারও গায়ের ছিটকে আসা আলো, কখনও কারও গায়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আলো– এই যে আলোর বিচিত্র খেলা, এটা একটা মৌতাতের মতো। এটার সঙ্গে বোঝাপড়া করা, এবং এর সঙ্গে সংলাপে যাওয়া– যে সংলাপ আমি বলছি, যে সংলাপ নাট্যকার লিখেছেন, সেই সংলাপের বাইরেও এমন অনেক সংলাপ তৈরি হতে লাগল, যার হদিশ মেলে আলো সংযোজনের পরই। দর্শকহীন থিয়েটারে যখন আলোয় মহড়া দিচ্ছি, আলো-নির্দেশকের কথা শুনছি, সেই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বদলে যায়, যখন বুঝতে পারি ওই অন্ধকার থেকে দর্শকের নিঃশ্বাস টের পাওয়া যায়। মঞ্চের ওপর যে আলো পড়ল, সে একটুকরো আলোই হোক না কেন, সেই আলো ছিটকে, গড়িয়ে, অভিমানী হয়ে বা ক্রুব্ধ হয়ে আলো ঠিক পৌঁছে গেল দর্শকের গায়ে। এবং ওই অন্ধকারেই দর্শকের একটা অবয়ব তৈরি করে দিয়ে গেল। এতদিন যে আলো-অন্ধকারে আমার চরিত্রটাকে গড়ে তুললাম, এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেলেন ওই আবছা আলোয় ধরা দেওয়া দর্শকের অবয়বও। যাত্রাপালা দেখার সময় যখন আমি আলোর কারিগরকে দেখতাম ডিমার দিয়ে আলো-ছায়া তৈরি করতে, সে-ই আলোকেই আমি সঙ্গে নিয়ে চলেছি। এখন আরও নিবিড়ভাবে বুঝতে পারি– সব আয়োজন আলো ছাড়া বৃথা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আলোয় অনেক সময় রং ব্যবহার করা হয়। যেরকম রং আমি গায়ে মেখেছি, সেরকম রংই অনেক সময় গায়ে না মেখে, আলো দিয়ে মাখি। হয়তো সূর্যাস্তের আলো এল, আমি বুঝতে পারি এই আলোটা আমার সংলাপকে প্রভাবিত করছে। সংলাপটিও আলোকে প্রভাবিত করছে। তখন কিন্তু শুধুমাত্র আমার বলা কথার মধ্যে যে স্বরলিপি, তার সঙ্গে আলোটা মিশে গিয়ে আমার প্রকাশকে অধিকতর অর্থবহ করছে। এইটা যে কী দারুণ একটা প্রকাশ, তা অভিনেতা-মাত্রই জানেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আলোর কথা বলছি যখন, তখন আসলে অন্ধকারের কথাও বলছি। প্রোসেনিয়ামের নাটক যাঁরা লেখেন, তাঁরা দৃশ্য়ান্তরে যাওয়ার সময় লিখতেন– আলো নিভে আসে, অন্ধকার হয়। আলো এলে তবেই পরের দৃশ্য দেখা যাবে। অর্থাৎ, একটা দৃশ্যান্তরের জন্য, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য, এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনায় পৌঁছনোর জন্য আমাদের অন্ধকার দরকার হয়। এই অন্ধকারকে কেউ স্বীকার করেন, কেউ করেন না। টেক্স্টে লেখা থাকে ‘অন্ধকার হয়’, কিন্তু নির্দেশক ও আলো-নির্দেশক দুটো আলোকে একবিন্দুতে এনে মাঝের জায়গাটাকে অন্ধকার করে দেন। আলোর উপস্থিতি কিন্তু থাকে। আবার অনেক সময়ই অন্ধকার করে দেন পুরোটা। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিকতর যে নাটক, সবেতেই অন্ধকারকে খোঁজা হয়েছে।
‘আধখানা মুখ আলোয় থাকুক, আধখানা মুখ অন্ধকারে, দূর থেকে যেন সবাই তোমায় দেখতে পারে’– এটা খুব জরুরি। লোকে বলে, মানুষের সবটা জানলে নাকি আকর্ষণ চলে যায়। তবুও সবটাই জানতে চাই আমরা। তেমনই অনেক অনেক দূর থেকে দেখার জন্যও আলো-আঁধারির দরকার। তাই আমাদের স্টেজেও আধখানা মুখ দেখতে পাওয়া ও আধখানা মুখ না দেখতে পাওয়ার খেলা চলে।
আমরা দেখি, আলোয় অনেক সময় রং ব্যবহার করা হয়। যেরকম রং আমি গায়ে মেখেছি, সেরকম রংই অনেক সময় গায়ে না মেখে, আলো দিয়ে মাখি। হয়তো সূর্যাস্তের আলো এল, আমি বুঝতে পারি এই আলোটা আমার সংলাপকে প্রভাবিত করছে। সংলাপটিও আলোকে প্রভাবিত করছে। তখন কিন্তু শুধুমাত্র আমার বলা কথার মধ্যে যে স্বরলিপি, তার সঙ্গে আলোটা মিশে গিয়ে আমার প্রকাশকে অধিকতর অর্থবহ করছে। এইটা যে কী দারুণ একটা প্রকাশ, তা অভিনেতা-মাত্রই জানেন। আলো কথা বলে, আলো কথা শোনে, আলো কথার পিঠে চড়ে, অন্য কথাকে দাবিয়ে দিয়ে নিজে কথা বলাও শুরু করে। তারপর রং বদলাতে থাকে। এই যে আলোর নানারকম রং, এগুলো কিন্তু সবক’টারই নাটকে খুব প্রয়োজন। আলো তো আমাদেরই সঙ্গী। ওটা আমাদের চাই। আর চাই অন্ধকারকে।
অভিনেতা হিসাবে সবসময় মনে হয়েছে, মানুষ যখন মানুষ ছেড়ে চলে যায়, তার বেদনার সঙ্গে আলো ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। স্টেজ থেকে আলো যখন ছেড়ে যায়, শুধু আমার গালের বাঁদিকে একটু আলো লেগে থাকে, যখন চোখটাও আর দেখা যায় না, তখন মনে হয় ওই নাছোরবান্দা আলোটাকে আঁকড়ে ধরি। আমি জানি সেটুকুও চলে যাবে। তখন আমি সম্পূর্ণ একা। এখন আমার বন্ধুত্ব হবে অন্ধকারের সঙ্গে। আমি অবধারিতভাবে জানি ডানদিক দিয়ে গেলেই হয়তো উইংস পেয়ে যাব, তারপরই সাজঘর। সেখানে আমি আলো জ্বালালেই জ্বলবে। কিন্তু এ তো সে আলো নয়। এত আলো আমাকে ছেড়ে গেল কোথায়? সে কি আবার ফিরে আসবে? আলো যে আমার ভীষণ দরকার। অন্ধকারকেও চাই!
আলো-অন্ধকারে যাই আমরা অভিনেতারা, স্বপ্নের জন্য নয়, বোধের জন্য।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved