জঙ্গলমহলের কুসুমডিহাতে এসেছেন নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত। এলাকায় নানা সমীকরণ, টানাপোড়েন। স্থানীয় মেয়েদের স্কুলের বড়দির মেয়ে রেশমির মনেও যেন জায়গা করে নিয়েছেন সুদর্শন এই যুবক। ওদিকে ব্যবসায়ীর ছেলের নজরও যে রেশমির দিকে। হঠাৎ খবর এল কী এক ঝামেলায় আক্রমণ নেমে এসেছে রেশমির উপর। দ্রুত খবর গেল সুমিতের কাছে। কী করবে সুমিত? এবার কি সরাসরি সংঘাত?
২.
–আপনি তো পোস্টমাস্টার। পোস্ট অফিসে কাজ। এখানে উস্কানি দিতে এসেছিলেন কেন?
প্রশ্নকর্তা পুলিশ অফিসার। থানার ছোটবাবু। নিখিল কর্মকার। বাজারে গোলমালের পরের অংশ চলছে। রেশমিকে নিয়ে থানায় গিয়েছে সুমিত। রেশমি যেতে চায়নি। বলেছে, ‘গিয়ে কিছু হবে না।’ তবু, সুমিত বলেছে, গিয়ে দেখা যাক। সেই দেখার নমুনা চলছে।
–আমি উস্কানি দিতে গিয়েছি? পাগল নাকি? ওই বিদ্যুৎ বলে লোকটার গুন্ডারা তোলাবাজি করতে গিয়ে রহিমকে মারল। বাধা দেওয়ায় রেশমির গায়ে হাত দিল। আমি খবর পেয়ে গিয়েছি। রেশমির সঙ্গে এসেছি কমপ্লেন লেখাতে। সুমিত বলল প্রায় এক নিঃশ্বাসে।
নিখিল পোড় খাওয়া অফিসার। কেটে কেটে বললেন, ‘তা রেশমিদেবী কমপ্লেন করবেন বলে পোস্ট অফিস তুলে দিয়ে পোস্ট মাস্টারকে ছুটে আসতে হল? ভাল, ভাল। তা এই যে আপনি দুম করে বিদ্যুৎবাবুর নাম নিলেন, ওঁকে দেখেছেন ওখানে? তাছাড়া আমাদের লোক যখন ওখানে গেছিল, রহিম বলেছে তেমন কিছু হয়নি, কেনাকাটা নিয়ে ওই একটু তর্কাতর্কি। আপনারা গল্প ফাঁদছেন কেন?’
রেশমি বলল, ‘আশ্চর্য! আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল লালু বলে ছেলেটা, কমপ্লেন নেবেন না?’
নিখিল চোখ বড় করে অবাক ভানে বললেন, ‘চূড়াপাড়ার লালু তো? তাকে তো সকাল থেকে লক আপে রেখেছি। যান দেখে আসুন। কী দেখতে কী দেখেছেন! কোনও প্রমাণ আছে? ফোনে বা ভিডিওতে? অবশ্য সেসব আর এখানে কে করবে? আপনি বোধহয় শাড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছিলেন। সাবধানে হাঁটবেন।’
সুমিত বলল, ‘ওরা রহিমকে বলে গেছে আবার পরের মাসের এক তারিখে আসবে।’
নিখিল বললেন, ‘মশাই, ক্রেতা দোকানে আসবে না? যত আসে তত মঙ্গল। এবার যান তো, পোস্ট অফিসে এতক্ষণে লাইন পড়ে গেল।’
আরও পড়ুন: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!
সুমিত, রেশমি বেরিয়ে দেখল থানার সামনে দাঁড়িয়ে দলটা অসভ্যের মতো হাসাহাসি করছে। তাদের দেখে আরও নানা বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করল। রেশমির রাগ বোঝা যাচ্ছিল মুখ দেখে। সুমিত তুলনায় স্বাভাবিক। অন্তত রাগটা হজম করে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা। বলল, ‘চলুন, আমার ওখানে এক কাপ চা খেয়ে যান।’
হাঁটার পথে আর কথা নয়। দু’-চারজন শুধু বলল, ‘নমস্কার মাস্টারমশাই’, বা ‘নমস্কার দিদিমণি’।
একেবারে পোস্টমাস্টারের ঘরে বসে চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে রেশমি বলল, ‘আজ মনে হয় যারা বন্দুক হাতে নিয়েছিল, তারা পুরোটা ভুল ছিল না।’
সুমিতও প্রথম চুমুকটা দিয়ে বলল, ‘হঠাৎ এই কথা?’
রেশমি বলল, ‘একটা সময়ে তো এসব জায়গায় শান্তিই ছিল। পরে বুঝেছি, শ্মশানের শান্তি, শোষণের শান্তি। সিস্টেম যদি গরিব মানুষকে ন্যায়বিচার না দেয়, একদিন যা হওয়ার তাই হয়েছে। ইতিহাসের চূয়াড় বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ, সিপাই বিদ্রোহ, এগুলো একেকটা সেক্টরে। পরে মাওবাদী, নকশাল নিয়ে গোটা জঙ্গলমহলে বিদ্রোহ। খুনের রাজনীতি। হ্যাঁ, পরিবর্তন হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে। এখন মেয়েরা কন্যাশ্রী কাপ খেলে। কিন্তু সিস্টেমের কী দোষ জানেন, সিস্টেম যুগে যুগে ক্ষুব্ধ তৈরি করতেই থাকে; তাই একটা সীমার পর তার কাউন্টার রিঅ্যাকশনও শুরু হয়ে যায়। কুসুমডিহাতে যা শুরু হয়েছে সুমিতবাবু, এসব হল অমঙ্গলের পদধ্বনি। সব রোগ ফিরে আসছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও মাঝের দালালগুলো আবার আগের মতো নখদাঁত বের করছে। আমার ভয় লাগছে।’
সুমিত বলল, ‘আপনি সমাজ নিয়ে এতটা ভাবেন দেখে ভাল লাগল। কিন্তু আমরা টুকটাক প্রতিবাদ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি? আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষমতা কতটুকু?’
রেশমি বলল, ‘গত মাস তিনেক আগে পশ্চিমগড়ের মাঠে যে দু’জন খেত মজুরকে খুন করল বাঁশরীলালের লোকেরা, আমার মন বলছে এর জল বহুদূর গড়াবে। ওদের কোনও দোষ ছিল না। ওরা ন্যায্য মজুরির দাবিতে বাকিদের সংগঠিত করছিল। ওদের খুন করল। তারপর পুলিশকে দিয়ে ডাকাতির উদ্দেশে জমায়েতের মিথ্যে মামলা দিল। লোকে কিন্তু ফুঁসছে। আর ওই মাধাইয়ের সঙ্গে নির্ঘাৎ মাওবাদীদের যোগাযোগ আছে। ওরা সব খবর রাখছে। এই যে সরকারি স্কিমগুলোর সুবিধে সবটা গরিব মানুষগুলো পর্যন্ত পৌঁছয় না, এই যে পঞ্চায়েতবাবুকে টাকা না দিলে কাজ হয় না, এই যে বাঁশরীলালের নামে-বেনামে থাকা কোম্পানিগুলোই সরকারি সব কাজ পায়, এই যে গরিবের ভাঙা বাড়ি ভাঙাই থাকে…’
সুমিত হেসে থামিয়েছে রেশমিকে, ‘আরে, আপনি সরাসরি মঞ্চেই ভাষণ দিন না এবার। নেত্রী হিসেবে ভালই মানাবে।’
রেশমি চোখের ভাষায় কপট রাগ দেখিয়ে অভিমানী সুরে বলেছে, ‘যান, আর কথাই বলব না।’
রেশমি চলে যাওয়ার পর জমে থাকা কিছু কাজকর্ম করল সুমিত।
তার সহকারী লোকটি দিব্যি। আশুতোষ মাহাতো। এখানকার পুরনো লোক। নানা খবর দেন। রেশমি যা বলে গেল, অনেকটা সেরকমই বলেন। তাঁর দুঃখ, একদিন পোস্ট অফিসটাই উঠে যাবে। আশুবাবু বলেন, ‘স্যর, তার উঠে গেল। টরেটক্কা চলে গেল। চিঠি কমে গেল। ইনল্যান্ড, পোস্ট কার্ড কমে গেল। সব গিলে নিল ওই মুঠোফোন। তাই আমি আজও ওই অভিশাপটা ব্যবহার করি না। কিনিনি। কিনব না। যা হবে, ওই ল্যান্ড ফোনে।’ আশুবাবুর বাসায় একদিন চা খেতে ডেকেছিলেন সুমিতকে। চাপা গলায় বলেছিলেন, ‘গন্ধ ভাল নয়। রোগ ফিরছে। তাহলে ওষুধও ফিরবে। মাঝখান থেকে প্রাণ যাবে কিছু।’
সুমিতের বাসার পিছনে তিনঘর আদিবাসী থাকেন। খেতে কাজ। কেউ কেউ বাড়ির কাজ করে দেন। এঁদের বাস ছিল সেই লালগড় মোড়ের কাছে। শালবনী থেকে কর্মসূচি সেরে ফিরছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী। হঠাৎ বিস্ফোরণ। পুলিশ চারপাশের গ্রাম থেকে সব মহিলাদের ধরে নিয়ে যায়। কী আতঙ্কের দিন সব! তারপর যে যার মতো অন্যত্র ঘরবাঁধা। তিনঘর এইখানে। সেসব দিন ভাবলে বুক কাঁপে। কুসুমডিহাতে শান্তি ফিরেছিল। কিন্তু আবার যেন বাতাসে কীসের গন্ধ, রাতবিরেতে বুককাঁপানো অজানা পাখির ডাক। ডাকিনী যোগিনীরা মানুষের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে আবার।
সুমিত পাশের টেবিলে দেখল গুটি তিনেক চিঠি। ওগুলো পল্টু রানারের হাত দিয়ে সাগরটিলা পাহাড়ের গ্রামগুলোতে যাবে। পাহাড়, ছোট পাহাড়। কিন্তু পাহাড়ের নাম সাগর কেন, কেউ বলতে পারে না আজ। আগে নাকি একটা ঝরনা ছিল। এখন বর্ষার ক’টা দিন ছাড়া তেমন বোঝা যায় না। সুমিতের ভারি ইচ্ছে আছে ওপরের গ্রামগুলোতে যাওয়ার। হয়ে ওঠেনি। চিঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে সুমিত ঠিক করল, এবার একদিন পল্টুর সঙ্গে সাগরটিলার ওপরে যাবেই।
(চলবে)
স্কুল গড়ার কাজে উমাদির সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু ছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্কুল নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হত খুব। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতেন স্কুল নিয়ে কতখানি প্যাশন ছিল দু’জনের মধ্যে সেসব তর্কে। স্কুলের কাজে চিনুদা প্রত্যক্ষভাবে জড়াননি, কিন্তু তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল।