বাড়িতে চাপ ছিল রেজাল্ট ভালো করার, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকার– অর্থাৎ পেতে চুল আঁচড়ে স্কুলে যাওয়া, প্রত্যেকটি ক্লাস মনোযোগ দিয়ে শোনা, শুধুমাত্র ডানদিকে বা বাঁদিকে বসা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা এবং কখনও পিছনের দিকে ঘাড় না ঘোরানো। এইভাবে, জীবনের দশটি বছর, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত নির্বিশেষে দেওয়াল জোড়া কালো বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দিন কেটে গেছে।
১৪.
ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত টানা বসেছি ফার্স্ট বেঞ্চে। স্কুলে যে শ্রেণিবিভাগ ছিল, তার সোজাসাপ্টা নিয়ম। যারা পড়াশোনায় ভালো, তারা সেকশন ‘এ’, এবং এইভাবে সেকশন ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ ইত্যাদি। আবার একটি সেকশনের মধ্যে যারা ভালো ছেলে, অর্থাৎ যাদের রেজাল্ট ভালো এবং আচার-আচরণ, তারা ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে বসতে শুরু করবে। মাঝখানের বেঞ্চগুলোয় একটু কম নম্বর পাওয়া বা রিলেটিভ্লি দুষ্টু ছেলেরা। একেবারে পিছনে যাবতীয় গন্ডগোল পাকানো বখে যাওয়া পাবলিক, তাদের মেধা বা রেজাল্ট যাই হোক না কেন। আমার কাছে, বেঁচে থাকার মানে হয়ে দেখা দিয়েছিল ওই ফার্স্ট বেঞ্চ। বাড়িতে চাপ ছিল রেজাল্ট ভালো করার, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকার– অর্থাৎ পেতে চুল আঁচড়ে স্কুলে যাওয়া, প্রত্যেকটি ক্লাস মনোযোগ দিয়ে শোনা, শুধুমাত্র ডানদিকে বা বাঁদিকে বসা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা এবং কখনও পিছনের দিকে ঘাড় না ঘোরানো। এইভাবে, জীবনের দশটি বছর, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত নির্বিশেষে দেওয়াল জোড়া কালো বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দিন কেটে গেছে। যখন সেই বোর্ডের ওপর আঁক কষা থাকত, তখন সে রাতের আকাশ, কিন্তু অমাবস্যার। আর পরীক্ষার সময় অনন্ত ব্ল্যাক হোল, যেখান থেকে তারাদের আকুতির আওয়াজ ভেসে আসে। কিন্ত ফার্স্ট বেঞ্চ নিরুপায়। সে ভালো ছেলের সমার্থক শব্দবন্ধ। বাড়িতে গুরুজনরা জিজ্ঞেস করেন, বসার জায়গা একই আছে তো? পাড়ায় বন্ধুরা আওয়াজ দেয়, গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ। স্কুলে একটু উসখুস করলে শিক্ষকদের গম্ভীর ধমক– অমুকের ভাই হয়ে এ’রকম বাঁদর হচ্ছ তুমি? লাস্ট বেঞ্চে পাঠিয়ে দেব কিন্তু। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে।
পড়ুন ‘পাল্টি’-র আগের পর্ব: আমের সিজন ফুরিয়ে গেলে ল্যাংড়া তার আসল অর্থ খুঁজে পায়
কিন্তু নিজেকে সামলে নিই। ফার্স্ট বেঞ্চ ধরে রাখার জন্য মন দিয়ে পরীক্ষা দিই। এমনকী, নাইন বা টেন-এও, যখন অল্প উড়ছি, বাকিদের তুলনায় নিজেকে উপযুক্ত দেখাতে সক্ষম হই। হাঁটু ব্যথা হয়ে যায়, কারণ ওই অবস্থানে পা ছড়িয়ে বসা যায় না। যদি শিক্ষকদের অসম্মান হয়? ভাবি কলেজে উঠে পুষিয়ে নেব এই আক্ষেপ। কিন্তু সাহেবরা অলক্ষ্যে হাসেন। তাঁরা দেড়শ-দুশো বছর আগে যে ক্লাসরুম বানিয়ে গেছেন, তার গ্যালারি সিস্টেম, যেন লাইট হাউস বা নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলে সস্তার টিকিটে বসার বন্দোবস্ত। লাস্ট বেঞ্চ মানে টঙে চড়ে বসা। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা ক্লাসে ঢুকেই উন্নত শির। সোজা পিছনের দিকে তাকান। বুঝি, এটা সুবিধের ব্যবস্থা নয়। তার ওপর শেষের দিকে বসা ছাত্র-ছাত্রীরা মাঝে মাঝেই ক্লাস কাটে। ‘তুমি আর কষ্ট করে বসে আছ কেন, বেরিয়ে যাও।’ খামোখা এই অপমান কেন সহ্য করব, তাই মাঝের বেঞ্চে সেঁধিয়ে যাই।
পড়ুন অন্য পর্ব: টিবি হয়েছে বলে আড়ালে বন্ধুটির নাম দেওয়া হয় ‘কিশোর কবি’
অবশেষে, ইউনিভার্সিটিতে ল্যান্ড করে মন ভালো হয়। রাজাবাজারের ক্যাম্পাসে এমন একটি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই, যার মূল সংকট ভালো ক্লাসরুম। একে-তাকে ধরে ঘর জোগাড় করতে হচ্ছে। বেশিরভাগ লেকচার যেখানে হয়, সেটি স্কুল-কলেজের তুলনায় নিতান্ত দুধের শিশু। লাস্ট বেঞ্চে দু’টি ছেলের মাঝখানে গিয়ে বসি। সামনের বেঞ্চে দু’কোণায় দুই মেয়ে। তখনও পীঠস্থানে ছেলে-মেয়ের পাশাপাশি বসার রেওয়াজ নেই। অতএব, এই প্রথম ঠ্যাং ছড়াতে পারি। কিন্তু সুখের দিন তো বেশিদিন সয় না মধ্যবিত্ত কপালে। একটি মেয়ে হাজির হল অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্রান্সফার নিয়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঠিক আমার সামনের বেঞ্চে। কলেজের বন্ধুদের আবিষ্কার করে তাদের মাঝখানে এসে বসল। অর্থাৎ আমার ছড়ানো পা আবার ব্যাক গিয়ার। এই বয়সে স্বাধীনতা চায় শরীর-মন। তাই কয়েকদিন যেতে না যেতেই সাহস করে বাড়িয়ে দিই। তার গোড়ালি ছোঁয় আমার আঙুল। ঘুরে তাকায়, সামান্য বিরক্ত। ‘সরি’ বলি। তারপর মানুষের মন যেমন বদলায়, ওই গোড়ালিও! আমার পা আর পিছিয়ে আসে না, তার গোড়ালিও অভ্যেস করে নেয় ক্লাস জোড়া সুড়সুড়ি। সে হাসি চাপতে শেখে। আমি মনের কথা। পাশ করার পর কয়েকটা বছর দু’জোড়া পায়ের ছাপ দেশের দু’প্রান্তে চলে যায়, তারপর দুই মহাদেশে। আবার যখন বেঞ্চে বসার সুযোগ হয়, সেটা ফার্স্ট না লাস্ট ঠাহর হয় না। খোলা ময়দানে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে ঝগড়া করে দু’টি পা, পঁচিশ বছর।
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।