এখন এলাকা গরম। জেলার সাংবাদিকরাই শুধু নন, কলকাতা থেকে টিমও আসছে। কুসুমডিহার মানুষ বলছে, কারখানা হোক না। কিন্তু কৃষিজমিতে কেন? ওই ওপাশের পাথুরে জমিতে যা ইচ্ছে হোক। তবে জঙ্গল কাটাও চলবে না। টিভিতে, কাগজে এখন মাঝেমধ্যেই কুসুমডিহার খবর।
৯.
তিন-চারদিনে গোলমাল, উত্তেজনা বাড়ল। এমনকী, সন্ধের দিকে শালবনের রাস্তায় বিদ্যুতের দুই পোষা গুন্ডার ওপর আক্রমণ হল। বেধড়ক মার। তবে প্রাণে মারেনি। যেন দেখানোর জন্য মারা। হুঁশিয়ারির জন্য মারা। বিদ্যুতের সম্মানে আঘাত।
মারল কারা? খেতমজুররা পাল্টা দিল? নাকি মাধাইয়ের দলবল? নাকি জঙ্গলের মুখোশধারীরা এসে পড়ল?
নিখিল কর্মকার একই দিনে দুটো নির্দেশ পেলেন। বিদ্যুৎ থানার ছোটবাবুটিকে ডেকে একটা নামের তালিকা হাতে ধরাল। তুলে নিন, ফাঁসান। গাঁজা থেকে আর্মস– যে কোনও কেস দিন। বিদ্যুৎ বলল, ‘যখন যা টাকা চেয়েছেন দিয়েছি। এখন ইজ্জত কা সওয়াল। এই শুয়োরের বাচ্চাগুলোর জন্য কোটি কোটি টাকার প্রোজেক্টটা আটকে গেল। ওটা এলে আমাদের কত টাকা লাভ হত বলুন তো? এখন ছোটলোকগুলো চোখ উঁচিয়ে ঘুরছে, কেমন, আটকে দিলাম তো! আর আমাদের সরকারটাও তেমন। কোথায় একটু আওয়াজ হয়েছে, তাতে প্রোজেক্ট বাতিল! আমি সহ্য করতে পারছি না। ওদের পালের গোদাগুলোকে তুলে আনুন, মামলায় জেরবার করে দিন।’
নিখিল ক্রীতদাস হয়ে গিয়েছেন অনেক আগেই। ‘না’ বলতে পারেননি। টাকা আর নামের তালিকা নিয়ে চলে গিয়েছেন। তবে এবার একটু ভয়ভয় করছে।
ভয়টা আরও বেড়েছে থানার বড়বাবু অসীম অধিকারীর কথায়। ডেকে বলেছেন, ‘দিনকাল ভালো নয়। সমঝে চলুন। উপরতলার নজর আছে। সিনিয়র অফিসার রাহুল মিত্র আসছেন। তাছাড়া আপনার বদনাম সবাই জানে। মাওবাদীরাও। এখন যেন বাঁশরিলাল বা বিদ্যুতদের দালালি করতে যাবেন না। আপনার জন্য এলাকা ডিসটার্বড হলে আপনাকে সরিয়ে দিতে বলব।’
নিখিল একটু সমঝে গেলেন। তবে কিছু তো করতে হবে। টাকাটা নেওয়া হয়ে গিয়েছে। অল্পস্বল্প কিছু তো করতেই হবে। মাধাই ছেলেটাও বিস্তর বাড়াবাড়ি করছে। সবথেকে ভালো হত পুলিশের কাঁধে বন্দুক না রেখে বিদ্যুৎরাই কিছু করত। রাগ মেটাত। তারপর নিখিল গিয়ে দু’তরফ থেকে জনা কয়েককে গ্রেপ্তার করে নিতেন। সব কুল রক্ষা হত।
এখন এলাকা গরম। জেলার সাংবাদিকরাই শুধু নন, কলকাতা থেকে টিমও আসছে। কুসুমডিহার মানুষ বলছে, কারখানা হোক না। কিন্তু কৃষিজমিতে কেন? ওই ওপাশের পাথুরে জমিতে যা ইচ্ছে হোক। তবে জঙ্গল কাটাও চলবে না। টিভিতে, কাগজে এখন মাঝেমধ্যেই কুসুমডিহার খবর। মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্প বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার পর তাঁর দলের নেতারা এসে সভা করেছেন। দারুণ ভিড়। সেখানে পঞ্চায়েতবাবুর বিরুদ্ধে স্লোগান হয়েছে। তাঁর পদ থাকলে হয়। দলের রাজ্য নেতা তখনই পঞ্চায়েতবাবুকে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলেছেন। মাইকে বলেছেন, ‘আমরা মানুষের দল। মানুষ যাকে চাইবে না, তাঁর সম্পর্কে দল ভেবে দেখবে। সরকার কৃষিজমিতে কৃষিকাজই করাতে বলছে।’
এর দু’দিন পর শিবনাথ সোরেনের ভাইঝির মৃতদেহ পাওয়া গেল মাঠের ধারে। তখনও ধোঁয়া উঠছে। ধর্ষণ করে খুন। সাতসকালে। শীতলা সোরেন এই কৃষিজমিরক্ষা আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন। কে বা কারা সাতসকালে তাঁকে শেষ করে দিয়ে গিয়েছে। মুহূর্তে খেপে উঠল গ্রাম। বিদ্যুৎ আর বাহিনীকে শেষ করতে হবে এখনই। কোনওরকমে ঠেকাল মাধাই। বলল, ‘ওদের কাছে গুলি বোমা আছে। এখন এসব করতে গেলে আমাদের আরও ক্ষতি। আগে পুলিশ আসুক। সবাই মিলে বসি।’
সুমিত গম্ভীর মুখে ডাকঘরে বসেছিল। খবর শুনেছে। রেশমিরা এসেছে। রেশমি বলল, ‘চলুন, যাবেন না একবার?’
সুমিত বলল, ‘কোথায়? ডেডবডি দেখতে? না। আমি নরম মনের মানুষ। ওসব দেখতে পারব না।’
রেশমির চোয়াল শক্ত হল, ‘এত বড় একটা অন্যায় হল। প্রতিবাদ করবেন না?’
–আমি গেলেই প্রতিবাদ করা হবে? আমার নীরব প্রতিবাদ রইল।
রেশমী দৃষ্টিতে বিরক্তি, আশাভঙ্গের ছাপ। তারা উঠে বেরিয়ে গেল। কুসুমডিহা উত্তেজনায় ফুটছে। বিক্ষোভ হচ্ছে। দাবি বাঁশরিলাল আর বিদ্যুৎকে গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু প্রমাণ কই? পুলিশকর্তারা তাদের তুলে নিয়ে গিয়েছেন সদরে। তাতে তো তারা মার খাওয়া থেকে বেঁচেছে। উপকারই হয়েছে। মৃতদেহের এখন হাজাররকম পরীক্ষা হবে। কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়।
সুমিত আশুতোষবাবুকে বলল, ‘কী যে সব শুরু হয়েছে। ভালো লাগছে না। আপনি সামলান। আমি চললাম সাগরটিলায়। আজ রসিকদের বাড়ি থেকে যাব। রেশমি খুঁজলে বলে দেবেন কাল একেবারে ডাকঘরে আসব। এসব অশান্তি আমি একদম নিতে পারি না।’