স্রেফ হাত পা ছড়িয়ে কাটাতে এসেছি সবাই, ফলে ধীরেসুস্থে স্কেচ করে বেড়ালাম বালিয়াড়ির ওপর ঘুরে ঘুরে। প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে চেয়ার পাতা, কিছু দোকান ইতিউতি ছড়িয়ে আছে, যার একটা চালায় বাপ-ছেলে রবি আর সুশান্ত নায়ক। দিনের বেলা ডাব আর সন্ধে হলে কাঁকড়া আর নানারকম সমুদ্রের মাছ সাজিয়ে বসে, চাইলেই মশলা মাখিয়ে গরম গরম ভেজে দেবে। দু’জনের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে ওদের ছাউনিটাকে আমাদের আড্ডাখানা বানিয়ে ফেললাম।
প্রায় দেড় যুগ বাদে পুরি যাওয়ার ইচ্ছেটাকে আবার উসকে দিল আমার এক দাদা, বৌদি। ওঁদের সঙ্গে এবার গিয়ে উঠলাম পান্থনিবাস ছাড়িয়ে চক্রতীর্থের দিকে এক হোটেলে। সামনেই বিচ, যার নাম ‘ফরেনার বিচ’, লোকজনের ভিড় কম, মেঘলা আকাশ, ঝোড়ো হাওয়া– সব মিলিয়ে শুরু থেকেই মন ভালো হয়ে গেল। মাত্র ক’দিন আগেই উল্টোরথ গেছে। খবর পেলাম, জগন্নাথদেব তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে এখনও রথে বসে আছেন, মন্দিরে ঢুকবেন আগামী কাল। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না, অটো নিয়ে সবাই মিলে তড়িঘড়ি ছুটলাম গ্র্যান্ড রোড। চওড়া রাস্তাটার শেষ মাথায় মন্দির চত্বরের সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে মানুষের ভিড়, চারদিকে মেলা বসে গিয়েছে, গিজগিজ করছে পুলিশ আর তিনটে রথেই হইহই করে পুজোআচ্ছা চলছে। আমরা ওরই মধ্যে ঠেলেঠুলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেবদেবীদের ভক্তিভরে প্রণাম জানিয়ে এলাম। গিন্নি আবার মোবাইলে জগন্নাথ দেবের ক্লোজ আপ তুলবেন বলে একটা বাঁশের বেড়ার ওপর উঠে পড়লেন ব্যালেন্সের খেলা দেখিয়ে। একধারে দেখলাম সারি সারি বিশাল ডেকচিতে নোড়া রসগোল্লা নিয়ে বসেছে, লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কেনার জন্য। শোনা গেল, রথযাত্রা ফেরত এই রসগোল্লার ভোগে মা লক্ষ্মীকে তুষ্ট করে তবেই আবার মন্দিরে ঢোকার গেট পাস মেলে জগন্নাথদেবের। এরা দিনটাকে তাই ‘রসগোল্লা দিবস’ হিসাবে পালন করে।
স্রেফ হাত পা ছড়িয়ে কাটাতে এসেছি সবাই, ফলে ধীরেসুস্থে স্কেচ করে বেড়ালাম বালিয়াড়ির ওপর ঘুরে ঘুরে। প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে চেয়ার পাতা, কিছু দোকান ইতিউতি ছড়িয়ে আছে, যার একটা চালায় বাপ-ছেলে রবি আর সুশান্ত নায়ক। দিনের বেলা ডাব আর সন্ধে হলে কাঁকড়া আর নানারকম সমুদ্রের মাছ সাজিয়ে বসে, চাইলেই মশলা মাখিয়ে গরম গরম ভেজে দেবে। এর জন্য ছোট কাঠের একটা কুঠুরিও রয়েছে লাগোয়া। দু’জনের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে ওদের ছাউনিটাকে আমাদের আড্ডাখানা বানিয়ে ফেললাম। সুশান্ত ছেলেটি এমনিতে খুব নরম স্বভাবের হলেও ওপরচালাক আর তেরিয়া মেজাজের খদ্দেরকে কীভাবে ম্যানেজ করতে হয়, সেটা দেখলাম ভালোই জানে।
জিয়াগঞ্জের বিকাশ মণ্ডল লেবু চায়ের কেটলি নিয়ে বালির ওপর ছুটে বেড়ায় সারা সকাল, হাত নেড়ে ডাকলেই বোঁ করে এসে হাজির হয়ে যায়। বাড়িতে বুড়ো বাপ আর দুই ছেলেকে রেখে ছ’বছর ধরে লড়ে যাচ্ছে এখানে। সমুদ্রের পাড়ে এসে উটের পিঠে চড়ে ঘোরার রেওয়াজ আছে, এখানেও ঝলমলে জামাকাপড় দিয়ে সাজানো খান দুই উট মজুত। রাজস্থানি পাগড়ি মাথায় একজন সহিস তার উট সোমুকে নিয়ে অনেকক্ষণ হাপিত্যেশ করেও ঘোড়ার খদ্দের পাচ্ছিল না। যারা আসছে, স্রেফ পিঠে চড়ে কায়দা মেরে ছবি তুলিয়ে নেমে যাচ্ছে। মনের দুঃখে শেষ পর্যন্ত সোমু বাবাজি বালির ওপর সটান কেতরে শুয়ে পড়ল।
সমুদ্রে নেমে চান করা পাবলিক আজকাল নুলিয়াদের বিশেষ সাহায্য নেয় না, তবে সরকার এদের রেখেছে লাইফগার্ড হিসাবে, সমুদ্রের ধারে থাকার ঝুপড়িও বানিয়ে দিয়েছে। এরকম একটা ঝুপড়ির সামনে কটকটে হলুদ রঙের গেঞ্জি পরে বসেছিল বছর ষাটের পোকালা আরিয়া। কানে শুনে নামটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না, শেষে পেটানো চেহারার লোকটা ছড়ি দিয়ে বালির ওপর আঁচড় কেটে ইংরেজিতে লিখে বুঝিয়ে দিল। দারুণ আলাপি স্বভাব আরিয়ার, চেয়ার টেনে বসলাম গল্প করতে। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসে তিন পুরুষ ধরে এই কাজ করছে ওরা, এযাবৎ প্রায় দেড়শো জনকে জল থেকে বাঁচিয়েছে আরিয়া। একটা গোবদা ডায়েরিতে সেইসব নবজন্মপ্রাপ্ত অনেকেই কৃতজ্ঞচিত্তে লিখে রেখে গেছে যাবতীয় কথা। আমি এবার এগলাম, দেখি ও তখনও হাসি হাসি মুখে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে।