যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি, বারে বারে শুধু মনে হয়েছে– যে গ্রাম, যে কচুরিপানা, যে নোনা ফল, যে দুর্গাকে আমি নিজের মধ্যে ধারণ করেছি, তার সঙ্গে এ পথের এ পাঁচালির বিস্তর ফারাক।
আমি অভিনয় করি প্রায় ১৫-১৬ বছর হয়ে গেল। অভিনয় করার সুবাদে যখনই কোনও অনুষ্ঠানে গেছি, সাধারণত কিছু প্রশ্ন কমন পড়ে। যেমন আপনি কীভাবে অভিনয়ে এলেন, কতদিন ধরে অভিনয় করছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই প্রশ্নের একই উত্তর বিভিন্ন রকমভাবে দিয়ে থাকি। উত্তর দিই ঠিকই, কিন্তু সত্যিই কীভাবে, কবে, কখন অভিনয় করব স্থির করে ফেললাম– তার সঠিক উত্তর নিজেও ঠিক খুঁজে পাই না। বীজরোপণ হল কবে, মানুষের প্রতি আগ্রহ আর ভালবাসা থেকে, নাকি বই পড়া থেকে, না সিনেমা দেখা থেকে, না জীবনের প্রতি অমোঘ ভালবাসা থেকে– কোনটা? কিছু কিছু ছবি, কিছু কিছু চরিত্র এখনও যেন চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাই। শুনতে পাই কত কিছু। শুনতে পাই রেডিওয় ‘শনিবারের বারবেলা’, বুধবারে ‘চিত্রহার’, রবিবারে ‘চন্দ্রকান্তা’, গরমের ছুটি এবং পুজোর ছুটিতে ‘ছুটি ছুটি’ অনুষ্ঠান, আরও কত কী!
একবার পুজোর সময়, তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি, পুজোর প্যান্ডেলের বাইরে বইয়ের স্টল থেকে একটা পাতলা চটিবই কিনে দিয়েছিল মা। লতা বলে একটি গ্রাম্য সাধারণ মেয়ের জীবন কাহিনি, যে পড়াশোনায় ভাল, বিয়ের পর পরিবার সামলায় নিপুণ হাতে, নার্সের চাকরি করে, মেয়েদের পড়াশোনা করায়, পরবর্তীকালে নিজের মায়ের দেখাশোনা করে এবং পরিবারের বিরুদ্ধে ভাই থাকা সত্ত্বেও মায়ের মুখাগ্নি করে সে নিজেই। এমন একটি সাধারণ মেয়ের জীবন কাহিনি। রঙিন সুন্দর ছবি সমেত ‘জীবন খুব সুন্দর’ এমন একটা চটিবই। এই বইটি আমার শিশুমনে বেশ গভীর প্রভাব ফেলল। বেশ কিছুদিন আমার যাবতীয় নাম ভুলে গিয়ে আমি নিজেকে ছোট্ট লতা ভেবে ফেললাম। লতা ভাবার ফসল এই যে, পড়াশোনায় সাময়িক মনোযোগ বেড়ে গেল খুব আর এত বছর পরেও ভাল থাকতেই হবে তার চেষ্টাতেও কোনও কমতি দেখা গেল না, হয়তো লতার মতোই।
এরপর ক্লাস ফাইভ, আমাদের বাড়ির লম্বা লাল মেঝের বারান্দায় উপুড় হয়ে শুয়ে আমি বই পড়ছি, দরজায় মায়ের শাড়ি কেটে বানানো হলদেটে পর্দা। আমার পড়া প্রথম কয়েকশো পাতার বড় গল্পের বই, আমার মনের ভিতর বানানো প্রথম ছবি, যার ডিরেক্টর, সিনেমাটোগ্রাফার এবং একমাত্র দর্শকও আমি। আমার বাস করা প্রথম গ্রাম– নিশ্চিন্তিপুর। পরবর্তীকালে যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি, বারে বারে শুধু মনে হয়েছে– যে গ্রাম, যে কচুরিপানা, যে নোনা ফল, যে দুর্গাকে আমি নিজের মধ্যে ধারণ করেছি, তার সঙ্গে এ পথের এ পাঁচালির বিস্তর ফারাক। তাই এ গল্প শুধু আমার আর বিভূতিভূষণের। আমিই তো ‘পথের পাঁচালী’র অপু। গাছের ডাল দিয়ে ধনুক বানাই, ঝাঁটার কাঠি দিয়ে তীর, পিকনিক নয়, বন্ধুদের সঙ্গে লুকিয়ে চড়ুইভাতি করার ইচ্ছে জাগে। মায়ের ভাঁড়ার থেকে আলু, সরষের তেল, চাল লুকিয়ে জঙ্গলে গিয়ে চড়ুইভাতি করব। সে জঙ্গল থাকুক বা না-ই থাকুক। বারাকপুর থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল– সব ট্রেনকেই দেখি অপুর চোখ দিয়ে। মা ঘুমিয়ে পড়লে, ছাদের ঘরে ছবি আঁকতে আঁকতে দুর্গার কথা ভেবে মনকেমন করে। ক্লাসরুমে বসে আনমনা হওয়া অভ্যাস করি। অপু বঙ্গবাসীতে পড়ে, তাই ক্লাস ফাইভেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমারও বঙ্গবাসীতে পড়া চাই। আর এত কিছু হতে চাওয়ার মধ্যেই ট্রেনের ইঞ্জিনের কয়লার গুঁড়ো এসে যেন আমার চোখে পড়ে।
বঙ্গবাসীতে পড়া আমার হয়নি ঠিকই, কিন্তু আমার যাপনের মধ্যে প্রকৃতি মিশে গেছে, অপুর হাত ধরেই। জীবনে যখন প্রথমবার একা একা বিটি রোড পার হলাম, সেই চাপা উত্তেজনা, সেই স্বাধীনতার আনন্দ আমাকে একা থাকার সঙ্গে পরম বন্ধুত্ব দিয়েছিল। আর প্রথমবার নিজের টাকায় মাকে ট্যাক্সি চড়ানোর আনন্দও দিয়েছিল।
জীবনের এই প্রান্তে এসে ঘষে যাওয়া স্মৃতির হাত ধরে টের পাই, অপু কিংবা লতা আমার অভিনয় করার ইচ্ছেকেও প্রথম উসকেছিল।
ঘরের মধ্যে ছবি আঁকা শেখানো যত, তার চেয়েও বেশি ছবি নিয়ে কথাবার্তা হত। আসলে ছবি আঁকার চেয়ে বড় কথা, এমনই একটা পরিবেশের মধ্যে উনি রাজনীতির বাইরে থাকতে চাইতেন। কবিতা লিখতেন। ফোটোগ্রাফি করতেন খুব ভালো। ওঁর উর্দু কবিতার বইও এখান থেকেই ছাপা হয়েছিল, যার প্রচ্ছদ আমার।
প্রথমবার মহিষাসুরমর্দিনী প্রযোজনা করেন জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় ও মালতী বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনে করেছেন– কল্যাণ ঘোষ, প্রদ্যোৎ, বিভাস পাল এবং বহুবার পঙ্কজদা, শর্মিষ্ঠাদি। প্রদ্যোৎ যেবার প্রযোজনা করেছিল সেবার দুর্গার চরিত্রে রূপদান করেছিলেন হেমা মালিনী।