বিশ্বদরবারে মিমি মণ্ডল এখন অতি পরিচিত নাম। গেম-এর কাহিনি রচনার কাজে পেশাগতভাবে যুক্ত আছেন মিমি, এবং গেমিং-এর জগতের এই রচনাগুলিও নিয়ে আসছে অন্য কিছু পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি। ‘ইন দ্য মিস্টস অফ মণিবর্ষা’ নামের গেমিং-এর জন্য লিখিত মিমির কাহিনি, ‘জার্নিস থ্রু দ্য র্যাডিয়েন্ট সিটাডেল’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত। এ-লেখার সূত্রে, বেস্ট গেম রাইটিং-এর ক্যাটিগরিতে নেবুলা অ্যাওয়ার্ডের জন্য পুনরায় নমিনেশন পেয়েছেন মিমি ২০২৩ সালে।
১৯.
বাবা পশ্চিমবঙ্গের সিভিল সার্ভেন্ট, মা ব্যাঙ্ক কর্মী। মিমি মণিদীপা মণ্ডল নব নালন্দা স্কুল আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ইংরেজি স্পেকুলেটিভ ফিকশন ও ফ্যান্টাসির জগতে এখন আন্তর্জাতিক নাম মিমি।
২০১৫ সালে মিমি সিয়াটলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লারিওন ওয়েস্ট রাইটার্স ওয়ার্কশপে যোগদান করেন। অক্টাভিয়া ই. বাটলার মেমোরিয়াল স্কলার মিমি ২০১৭ সালে, তিনি রাজারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৃজনশীল লেখায় ডিগ্রি নেন, ইতিমধ্যেই সম্পাদনা করেছেন অক্টেভিয়া বাটলারের বিষয়ে একটি বই। বইটি ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক লোকাস পুরস্কার জিতেছে শুধু নয়, হুগোর জন্যও মনোনীত হয়েছিল। ২০১৯ সালে ‘হিজ ফুটস্টেপস, থ্রু ডার্কনেস অ্যান্ড লাইট’ বইটির জন্যও নেবুলা পুরস্কারের নমিনেশন পেয়েছিলেন তিনি।
এর মধ্যে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়াতে সম্পাদক হিসাবে এবং আনক্যানি ম্যাগাজিনের কবিতা এবং পুনর্মুদ্রণ সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছিলেন। Tor.com, Uncanny Magazine, Fireside Magazine, The মতো জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে মিমির লেখা। বুক স্মাগলার, ডেইলি সায়েন্স ফিকশন, কিন্ডল ম্যাগাজিন, মিউজ ইন্ডিয়া, পডক্যাসল এবং স্ক্রোল ইত্যাদিতে প্রকাশিত মিমির লেখা। দক্ষিণ এশিয়ার স্পেকুলেটিভ ফিকশন নিয়ে কাজ করেছেন মিমি। এ-ক্ষেত্রে তাঁর কাজটি লিপিবদ্ধকরণের, ঐতিহাসিকের। একইসঙ্গে সৃজনমূলক লেখা আর অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রের চারণা করে চলেছেন এই বাঙালিনী।
বিশ্বদরবারে মিমি মণ্ডল এখন অতি পরিচিত নাম। গেম-এর কাহিনি রচনার কাজে পেশাগতভাবে যুক্ত আছেন মিমি, এবং গেমিং-এর জগতের এই রচনাগুলিও নিয়ে আসছে অন্য কিছু পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি। ‘ইন দ্য মিস্টস অফ মণিবর্ষা’ নামের গেমিং-এর জন্য লিখিত মিমির কাহিনি, ‘জার্নিস থ্রু দ্য র্যাডিয়েন্ট সিটাডেল’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত। এ-লেখার সূত্রে, বেস্ট গেম রাইটিং-এর ক্যাটিগরিতে নেবুলা অ্যাওয়ার্ডের জন্য পুনরায় নমিনেশন পেয়েছেন মিমি ২০২৩ সালে। প্রবল প্রতাপান্বিত গেমিং রাজ্যে, প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে নতুন ভাবনার স্বাক্ষর রাখা মিমির নানা সাক্ষাৎকার ছড়িয়ে আছে ইন্টারনেট দুনিয়ায়।
‘আমার মনে হয় আমরা অনেকেই যে গল্পগুলি দেখতে চাই তা লিখছি! আমি সত্যিই দেখতে চাই আঞ্চলিক পৌরাণিক কাহিনী, ভারতের লোককাহিনী গল্পগুলিতে ব্যবহৃত হচ্ছে… আমি আরও ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা চরিত্র দেখতে চাই, এবং আসলে সেন্সরবিহীন ঐতিহাসিক গবেষণা গল্পে প্রতিফলিত হয়, কারণ আমরা জানি ভারতীয় ইতিহাসের অনেকটাই ব্রিটিশ-পরবর্তী জাতীয়তাবাদের ধারণার সন্তান।’
টর ডট কমে প্রকাশিত মিমির প্রখ্যাত গল্পে, বিনু নামে এক বাঙালি মাস্টার ট্র্যাপিজ আর্টিস্ট ভ্রাম্যমাণ ম্যাজেস্টিক ওরিয়েন্টার সার্কাসে কাজ করে। সে শেহজাদ মারিদ নামের এক জিনের মালিক, সার্কাসের মঞ্চেও সে পাতলুন আর টুপি পরে আলাদিন সেজে প্রদীপের জিনকে দেখিয়ে, নানা খেলা দেখায়। অর্থাৎ, এই কল্পকাহিনিতে, কোনও এক অর্থে, বাস্তব আর কল্পনার সীমা পেরিয়ে যান লেখক। শুধু তাই না, বন্ধুত্ব আর মালিক-ভৃত্যের সম্পর্ক নিয়ে কথা তোলেন।
এরপর গল্পে প্রবেশ করে আরও এক বিশেষ বিষয়, ভারতে যা আজও নারী ও দলিতদের ক্ষেত্রে জ্বলন্ত সমস্যা। দেবদাসী প্রথা। কাহিনিতে, তিরুপুর নামে এক রাজার রাজ্যে যায় এই সার্কাস-পার্টি এবং সেখানেই এক দেবদাসী এসে বিনুর সাহায্য চায়, সার্কাস-পার্টির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। নারীর দাসত্ব, দাসীর নিজের বলতে কিছুই না থাকা, এবং পালানোর জন্য সার্কাস পার্টির মতো একটি মেল্টিং পট-কে বেছে নেওয়া, এই থিমগুলো গুরুত্ব পায়। কারণ, ভ্রাম্যমাণ সার্কাস পার্টি বস্তুত একটা জাতকুলমানহীন, প্রান্তিক অস্তিত্বের প্রতিভূ, যেখানে আসলে নেই কোনও সামাজিকতার বর্ণাশ্রমের এবং নারীপুরুষ ভেদের বন্ধন। বিনু মেয়েটিকে সাহায্য করতে গিয়ে কুলদেবীর কোপে পড়ে, বস্তুত গোটা সার্কাস-পার্টিই কোপে পড়ে। কাহিনির এই জায়গায় কুলদেবী বিনুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চান জিনকে। জিন বলে, কেউ কখনও স্বাধীন হয় না, শুধু মালিক পাল্টে পাল্টে যায়। আমার মালিক তোমার চেয়ে বেশি অত্যাচারী হতেই পারে। আবার এই দেবদাসীও আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন হলেও ওর মালিক থাকবেই।
কাহিনির শুরুর দিকে বিনু জানায়, ‘প্রদীপের দৈত্য’ ব্যাপারটি ভাবলেই আমাদের মনে হয় অত্যন্ত বদ্ধ একটা জায়গায় হাত-পা মুড়ে বসে থাকার চিত্রকল্প, বন্দিদশা। কিন্তু মানুষমাত্রেই কি তার শরীরের হাড়মাংসের ভেতরে বন্দি নয়?
‘হিজ ফুটস্টেপ্স থ্রু ডার্কনেস অ্যান্ড লাইট’ আসলে শেষ অবধি দলিত আইডেন্টিটির গল্পও হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কদর্যতা, খোলাখুলি ব্যক্ত করা, পুরোহিতদের নৈতিক অধঃপাত ও নারীনিগ্রহ ইত্যাদি, সব মিলিয়ে এ এক রাজনৈতিক কাহিনিও বটে!
এটি মিমির আরও এক কাহিনি ‘দ্য ট্রিজ অফ মাই ইউথ গ্রিউ টল’-এর সঙ্গে যুক্ত। সে কাহিনিটিও ‘স্ট্রেঞ্জ হরাইজনস’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
কবিতা লেখেন রাকা দাশগুপ্ত। অন্যদিকে, তিনি পদার্থবিদ্যার কৃতী ছাত্রী ও আপাতত শিক্ষকতাও করেন। এই যে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে কবিতাকে মেলানো, এতে আশ্চর্য হব কি আমরা? নাকি এটা জানি বলেই মেনে নেব যে, এই দুই ক্ষেত্রেই কল্পনাশক্তির অত্যন্ত জরুরি অবদান আছে। আর এই কবিতায় যেন সেই দু’দিক এসে মিলে যায় এক কল্পবিজ্ঞান বা সাই-ফাই কাহিনিতে। কবিতায় কল্পবিজ্ঞানধর্মী হয়ে উঠেছে বাংলাভাষায়।
সমস্ত সাজানো রইল। টবে রাখা উজ্জ্বল স্টিলের গাছ,
জাদুপাখি, মায়াফল, ছোট-ছোট সৌরকাচ
কৃত্রিম সবুজ কোষে নিরন্তর সালোকসংশ্লেষ…
জল তো দেওয়ার কোনও দায় নেই, যদি ইচ্ছে হয়, বেশ
মাঝে-মধ্যে ঝেড়ে মুছে রেখো বালি-ধুলো।
তুমি এত ভুলো…
সপ্তাহান্তে দূরে-টুরে যেতে হলে রকেটে-জ্বালানি
ঠিকমতো নিও কিন্তু। ভয় করে, তোমাকে তো জানি।
ড্রয়ারে চাবিটা রাখছি। মিলির রিমোট।
রোবটমানবী ভেবে অগ্রাহ্য কোরো না। ওর চোখ নাক ঠোঁট
আমারই আদলে তৈরি, মনে রেখো। রোজ চার্জ দিও।
আমার অবর্তমানে ও-ই দেখেশুনে নেবে
ঘরদোর, গৃহস্থালি, লৌকিকতা, প্রেম-ট্রেম…যা যা করণীয়।
আপাতত চলি।
সুদূর কৈশোর থেকে কোনও এক অনুজ্জ্বল স্কুলবাস, মফস্সল গলি–
রাস্তা ভুলে, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে, শুধুমাত্র আমাকেই নিতে
এসে গেছে। তোমাদের দৃপ্ত পৃথিবীতে
আমার ফুরলো দিন। থাকার উপায় নেই আর।
অন্য কোনও দেশ-কালে দেখা হবে কখনও, আবার।
(চলে আসার আগে। রাকা দাশগুপ্ত)
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..
এভাবেই বাংলা ভাষার লেখকেরা বারেবারেই করে চলেন কল্পবিজ্ঞানের চর্চা, বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগা ফ্যান্টাসি বা কল্পকাহিনির সঙ্গে মেলান ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ। কখনও ইউটোপিয়া বা কখনও ডিসটোপিয়া নির্মাণ করতেই থাকেন নানা কাহিনিতে।
(চলবে)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৮। পৃথিবীর শেষ লড়াই পানীয় জলের দখলের জন্য
পর্ব ১৭। একটি সন্তান অজৈবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীতে
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই