মহাকাশযান বাদেও যে কল্পবিজ্ঞান লেখা সম্ভব, তা তিনি দেখিয়েছেন। ভিনগ্রহে ময়লা বা বর্জ্য পদার্থ ফেলে আসছে পৃথিবীর মানুষ আর তারই দখলদারি নিয়ে হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ, এমন ভাবনাও তৃষ্ণা ভেবেছেন। মানুষ স্থানাভাবে বাড়িকে জামার মতো পরিধান করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেভাবে শামুক চলে তার খোল নিয়ে… এও এক নতুন ভাবনা তৃষ্ণার কলমে।
২০.
সমসময়ের যে লেখকেরা কল্পবিজ্ঞান নিয়ে নতুন নিরীক্ষা করছেন, তাঁদের অন্যতম তৃষ্ণা বসাক। তিনি তাঁর ‘আত্মারামের নতুন খাঁচা’ গ্রন্থে অনেকগুলি গল্প সংযোজিত করেছেন, যেগুলি কল্পনার পাখায় উড়ান দিয়ে ভবিষ্য-পৃথিবীর কল্পনাকে উজ্জীবিত করেছে। ফিউচারিস্টিক ও অতি রসালো কাহিনি বুনেছে। মহাকাশযান বাদেও যে কল্পবিজ্ঞান লেখা সম্ভব, তা তিনি দেখিয়েছেন। ভিনগ্রহে ময়লা বা বর্জ্য পদার্থ ফেলে আসছে পৃথিবীর মানুষ আর তারই দখলদারি নিয়ে হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ, এমন ভাবনাও তৃষ্ণা ভেবেছেন। মানুষ স্থানাভাবে বাড়িকে জামার মতো পরিধান করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেভাবে শামুক চলে তার খোল নিয়ে… এও এক নতুন ভাবনা তৃষ্ণার কলমে।
‘ও শুনতে পায়নি কিছু। ওর ফুল লাইফ কিট ইনস্টল হবার পর বারো ঘণ্টা চার্জিং-এর সময় ল্যাবের অফিসার দুটি কী কথা বলেছে বা কী দেখেছে তা ও শুনতে বা দেখতে পায়নি। তেমন হবার কথাও নয়। কিন্তু ওর একটা আবছা আবছা, ছায়া ছায়া অনুভূতি হচ্ছিল। কারা যেন ঘরে আছে, নড়ছে চড়ছে, কথা বলছে, তাদের কথা ছাড়াও ঘরে একটা অন্যরকম শব্দ, কীসের তা ও বুঝতে পারছিল না, কিন্তু ওর মনে পড়ছিল, এমন শব্দ ও আগে শুনেছে। কবে? ওর পূর্বজন্মে? পূর্বজন্মের আরো কিছু শব্দ, ছবি, একটি বিশেষ মুখ মৃদু কিন্তু, পরিত্রাণহীন ব্যথার মতো ওর অর্ধজাগ্রত চেতনাকে ঘিরে ফেলছিল। সেই কষ্টে ওর চোখে জল এসে গেল। ওর চোখের জল ল্যাবের অফিসার দুটি লক্ষ করেনি। করার কথা যদিও। কারণ এটা আর পাঁচটা মুনাফা লোটা লাইফ রিনিউয়াল সেন্টার নয়, এটা একটা উচ্চমানের গবেষণা কেন্দ্র, যেখানে প্রতিটি পুনর্নবীকৃত জীবনের ওপর খুঁটিয়ে নজর রাখার কথা। কিট ইনস্টল হবার পর, চার্জিং-এর সময় বড়ির প্রতিটি নড়াচড়া বা প্রতিক্রিয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ নোটস রাখার কথা। তাই তার চোখে জল কেন সেটা এদের দেখা উচিত ছিল এবং এটা নোট করাও দরকার ছিল। কিন্তু সেসব কিছুই এরা করেনি, চার্জিং যখন শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, তখন হঠাৎ তার কানে জল ঢালার শব্দ এল। এবার আর আবছা আবছা নয়, স্পষ্ট আওয়াজ এবং ওর খুব চেনা আওয়াজ। এতটাই চেনা যে তা ওকে চমকে দিল। ওর ভেতরে একটা অভাবনীয় ছটফটানি কাজ করল। এক্ষুনি উঠে ওই শব্দের উৎসটি খুঁজে না বার করলে ওর জীবন থেকে যেন কী একটা চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে, এই নতুন করে পাওয়া জীবন বিফলেই যাবে ওর। এই ভাবনা একটা বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো ওর শরীরে ছড়িয়ে গেল। ও তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল। এবং দেখল তার ঠিক সামনের দেওয়ালে স্ট্রিমার চলছে আর তাতে এই মুহূর্তে উপপৃথিবীর উন্নয়নমূলক কাজকর্মের একটি ডকুফিল্ম দেখানো হচ্ছে, তাতেই ওর জল খাওয়ার দৃশ্যটি যা সারা জীবনের মতো ওর পিপাসা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ওর আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। পৃথিবী জলের তলা থেকে বেরিয়ে আসার পর ওরা উপপৃথিবী থেকে ফিরে এসেছিল, আর ফিরে এসে তন্ন করে মেয়েটিকে খুঁজেছে ও, কোথাও পায়নি। খুঁজতে খুঁজতে ওর মনেই ছিল না ওর লাইফ স্প্যান এক্সপায়ারির মুখে, রিমাইন্ডার মেসেজ নিশ্চয় এসেছিল, কিন্তু ও খেয়াল করেনি। একদিন অফিসে কাজ করতে করতে ও আচমকা সামনের রাস্তায় সেই মেয়েটিকে দেখতে পেল। ছুটে তার কাছে যেতে যাবে, অমনি মাটিতে পড়ে গেল, তার চার্জ শেষ। কী অদ্ভুত তাই না? জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে যাকে দেখেছে, নতুন জীবন পর্বে সদ্যজাগ্রত চেতনায় তাকেই দেখতে পেল সে। যদি সে জৈব মানুষ হত, তবে ভাবতে পারত এ সমস্তই ঈশ্বরের লীলা, পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু হায় রে, ল্যাবজন্মাদের যে কোন ঈশ্বর নেই, কোন ধর্ম নেই।’
জীবনের নানা সমস্যার কথা এসে পড়েছে নারীর কলমে কল্পবিজ্ঞানের আওতায়। যার উদাহরণ অনেক, মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় থেকে আইভি চট্টোপাধ্যায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোনদিন হয়ে উঠবে মানুষের একমাত্র সঙ্গী, মহুয়ার গল্প ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’, তারই কাল্পনিক বিস্তার। আইভি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন সম্পর্কের নতুনত্বের গল্প তাঁর ‘কলাবতী’ আখ্যানে।
‘ক্লোন, একজন মানুষের কপি-করা আরেকজন মানুষ। পৃথিবীর প্রথম মানব-ক্লোন একটি মেয়ে। তার নাম ইভ। রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছিল এই মানবশিশুর।
মানব ক্লোনি। মম, বাবার ভালোবাসার সুহানা। পাগল প্রেমিক নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রেমে পাগল লোকটা একজন প্রতিভাধর জেনেটিক্স বিজ্ঞানীও বটে।
ক্লোন প্রাণী কি জন্ম থেকেই বুড়ো? তাদের বয়স কি অন্যদের মতো স্বাভাবিকভাবে বাড়ে না? এই প্রশ্নগুলো বিজ্ঞানীদের ধাঁধায় ফেলেছে। ছয়-সাড়ে ছয় বছরের মাথায় ডলি এক ধরনের ফুসফুসের রোগে মারা যায়। আরও জানা যায় যে ডলির অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস হয়েছিল, যে রোগ ছয়-সাত বছরের ভেড়াদের হওয়ার কথা নয়। হয়তো ডলি যে ডিএনএ থেকে তৈরি, সেই ভেড়াটির এই অসুখ ছিল। তার মানে, কিছু কিছু বয়সঘটিত স্মৃতি কোশের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারে।
ঠিক যেমন হয়েছে এই মম, ক্লোনি-মম সুহানার। সেই ছোট্টবেলার টিয়ার মম। কে জানে, এই মমের বয়স বাড়বে কি না। বয়স বাড়লে বাবার পছন্দ না হলেও চিন্তা নেই। আবার একটা সুহানা তৈরি করে নেবে বাবা।
মমের ডিএনএ কেমন করে নিল বাবা? তাহলে কি টিয়ার অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে এসেছিল বাবা? এ বাড়ির চাবি দেবার সময় কিংবা বাড়ির সেল-ডিড দেবার সময় কিংবা এমনিই? তখন হয়তো বা কাছাকাছি এসেছিল দুজনে। হয়তো মায়ের একটা হেল্থ চেক-আপ করাতে নিয়ে গিয়েছিল বাবার চেনা ল্যাবে। ডাবলিনে টিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসে যেমন টিয়াকে হেল্থ চেক-আপে নিয়ে গিয়েছিল বাবা, খুব কাশি হচ্ছিল সে দিন যখন।
হঠাৎ ভেতর থেকে শিউরে উঠল টিয়া। কে জানে ওপরের ঘরে, ছোট্ট টিয়ার ঘরে আরেকটা ছোট্ট টিয়া বার্বি ডল নিয়ে খেলা করছে কি না। সব-হারানো বিজ্ঞানী নিজের ভালোবাসার সংসার গড়ে নিয়েছে এইভাবেই। প্রেয়সীর কাঁধে হাত রেখে এদিকেই চেয়ে আছে বাবা। হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে হারিয়ে-যাওয়া মম।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ ভরে জল এল টিয়ার। পা দুটো ভারী হয়ে আছে, এক-পা ফেলে এগোবার ক্ষমতা নেই যেন।
দরজা ধরে দাঁড়িয়েই রইল টিয়া। একলা একলা।’
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৯। আলো-অন্ধকারে হেঁটে যে কল্পবিজ্ঞান বলতে চেয়েছে দলিত কাহিনি
পর্ব ১৮। পৃথিবীর শেষ লড়াই পানীয় জলের দখলের জন্য
পর্ব ১৭। একটি সন্তান অজৈবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীতে
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই