আজকে, এই মুহূর্তে যেমন দেখা যাচ্ছে চিন, পৃথিবীর অন্যান্য ক্ষেত্রে আগুয়ান জাতি হিসেবে ঠিক যতখানি শক্তিমান, ততখানিই আগ্রহী সে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি বয়নে। সিসিন লিউর ফ্যানবেস থেকে এরকম ধারণা করেই নেওয়া যায়। বলাই যায়, কল্পবিজ্ঞানের আঁতুড় হিসেবে প্রাচ্যের এখন খুব ভাল সময় চলছে। জাপানি মাংগা অধিকার করেছে বিশ্বের কার্টুনের বাজার, পাশাপাশি কল্পগল্পের বাজারও।
৪.
আশ্চর্যের কথা, বিজ্ঞানভিত্তিক ফ্যান্টাসি বা কল্পগল্পের প্রথম দুই যুগন্ধর, জুল ভার্ন ( ১৮২৮-১৯০৫) ও এইচ জি ওয়েলসের ( ১৮৬৬-১৯৪৬) কোনও দিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। এঁদের প্রথম জন ফরাসি, দ্বিতীয় জন ইংরেজ। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই দুই লেখক কোন মন্ত্রবলে মোটামুটি একই সময়ে কল্পবিজ্ঞান লিখতে শুরু করলেন? কেননা, তার আগের শতকেই শিল্প বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। জেমস ওয়াট ১৭৬৫-তে স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছেন। ১৭৫০ থেকে গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়া অবধি চলমান শিল্পবিপ্লবের অবধারিত সমান্তরালে বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকথার লতিয়ে ওঠা, সাম্রাজ্য বিস্তার।
‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ’, ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’, ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’। উপরিউক্ত অভিযান সিরিজের ভার্নের লেখার কল্পনাশক্তি পাল্লা দিয়েছিল সে সময় অবধি বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সঙ্গে। ভবিষ্যৎ সময়ের সঙ্গে অভিযোজনের আশাবাদ থেকে জন্ম এসব লেখার। এইচ জি ওয়েলস-কে বলা হয় বর্তমান কল্পবিজ্ঞানের জনক। তিনিও লিখেছেন একের পর এক ক্লাসিক কাহিনি! ‘ওয়ার অফ ফ্য ওয়ার্ল্ডস’, ‘দ্য টাইম মেশিন’, ‘দ্য ইনভিসিবল ম্যান’-এর মতো লেখা।
এই প্রেক্ষিত পাল্টাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আসবে দু’টি যুযুধান দেশ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠবে নয়া ক্ষমতাবান দেশ। তাই, প্রথম যুগে যেমন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের শিল্প বিপ্লবের ভাগিদারিত্ব থেকে জন্ম নিয়েছেন কল্পবিজ্ঞানের দুই মহারথী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে তেমনই ফনফনিয়ে উঠল মার্কিন ও সোভিয়েট কল্পবিজ্ঞান লেখকের লেখাগুলি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রযুক্তির আধিপত্যের পাশাপাশি কল্পগল্পের আধিপত্যর সম্পর্কটা বুঝতে পারলেই বোঝা যায়, কেন যে কোনও ভাষার কল্পগল্পের গোটা সংখ্যার ভেতরে মেয়েদের সংখ্যাটি কম। ক্ষমতাতন্ত্রের সেই জায়গায় মেয়েদের অধিকার কতটুকুই বা ছিল বা থেকেছে যে তারা কল্পনার পাখাকে ততটা প্রসারিত করতে পারবেন? অন্যান্য নানা শাখার সাহিত্যে ( কবিতা, গল্প, সামাজিক উপন্যাস) একই ব্যাপার। মেয়েদের সংখ্যা কম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আজকে, এই মুহূর্তে যেমন দেখা যাচ্ছে চিন, পৃথিবীর অন্যান্য ক্ষেত্রে আগুয়ান জাতি হিসেবে ঠিক যতখানি শক্তিমান, ততখানিই আগ্রহী সে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি বয়নে। সিসিন লিউর ফ্যানবেস থেকে এরকম ধারণা করেই নেওয়া যায়। বলাই যায়, কল্পবিজ্ঞানের আঁতুড় হিসেবে প্রাচ্যের এখন খুব ভাল সময় চলছে। জাপানি মাংগা অধিকার করেছে বিশ্বের কার্টুনের বাজার, পাশাপাশি কল্পগল্পের বাজারও।
এই এগিয়ে থাকার, প্রযুক্তির আধিপত্যের পাশাপাশি কল্পগল্পের আধিপত্যর সম্পর্কটা বুঝতে পারলেই বোঝা যায়, কেন যে কোনও ভাষার কল্পগল্পের গোটা সংখ্যার ভেতরে মেয়েদের সংখ্যাটি কম। ক্ষমতাতন্ত্রের সেই জায়গায় মেয়েদের অধিকার কতটুকুই বা ছিল বা থেকেছে যে তারা কল্পনার পাখাকে ততটা প্রসারিত করতে পারবেন? অন্যান্য নানা শাখার সাহিত্যে ( কবিতা, গল্প, সামাজিক উপন্যাস) একই ব্যাপার। মেয়েদের সংখ্যা কম। তবু এই লেখায় আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করব একাধিক পুরোধা মেয়েদের কথা।
১৬২৩ সালে জন্ম, মার্গারেট ক্যাভেন্ডিশ, ইংল্যান্ডের ডাচেস। ‘দ্য ব্লেজিং ওয়ার্ল্ড’ নামক কল্পকাহিনি লেখেন। মেরি শেলির কথা তো প্রথমেই উল্লেখ করেছি। এর পরের উল্লেখ্য লেখকের নাম জেন লাউডন (১৮০৭-১৮৫৮)। এই নারী লিখেছিলেন ‘মমি– এ টেল অফ টোয়েন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরি’ নামের তিন খণ্ডের উপাখ্যান। গায়ে কাঁটা দেওয়া গথিক হরর, বিষয় মিশরের মমির জ্যান্ত হয়ে ওঠা, এবং স্পেকুলেটিভ ফিকশন। গল্পকে তিনি নিয়ে ফেলেছিলেন দ্বাবিংশ শতকে। ঊনবিংশ শতকের এই লেখকের সময়ে কোথায় কল্পগল্প বা সাই ফাই-এর মতো টার্মিনোলজি। অথচ তিনি কাজটি করে ফেলেছিলেন।
এর পরবর্তীতে কল্পগল্পের ক্ষেত্রে নারীর সমস্ত জয়যাত্রাই ঘটবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে। ক্লেয়ার উইংগার হ্যারিস ( ১৮৯১-১৯৬৮) কল্পবিজ্ঞান কাহিনি লিখলেন মার্কিন সস্তা পত্রিকাগুলিতে যাকে বলে ‘পাল্প ম্যাগাজিন’। এবং স্বনামে, স্বপরিচয়ে। প্রথম মহিলা লেখক তিনি এই জঁরের। ১৯৪৭ সালেই ‘অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার অ্যান্ড নাউ’ বলে সিরিজে, ১১টি কাহিনি লিখলেন তিনি। অধুনা বিশ্বখ্যাত, অ্যামেজিং স্টোরিজ পত্রিকার হুগো গার্ন্সব্যাক, যাঁর নামে আজকে কল্পবিজ্ঞানের উচ্চতম পুরস্কার ‘হুগো পুরস্কার’ দেওয়া হয়ে থাকে, তাঁর পছন্দের অন্যতম লেখক ছিলেন ক্লেয়ার হ্যারিস। মঙ্গলগ্রহীরা পৃথিবীতে জল চুরি করতে আসছে, এমন একটি কাহিনি লিখে তিনি এক প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার হাসিল করেছিলেন পর্যন্ত।
১৯৪৯ সালে প্রকাশিত মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য ম্যাগাজিন অফ ফ্যান্টাসি অ্যান্ড সায়েন্স ফিকশন’, বাউচার সম্পাদিত। সে পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন আরেক মহিলা, তাঁর নাম মিরিয়াম অ্যালেন দ্য ফোর্ড (১৮৮৮-১৯৭৫)। ‘এলসওয়্যার’, ‘এলসহাউ’, ‘এলসওয়েন’ ,‘জেনো জেনেসিস’ ইত্যাদি ছিল তাঁর বইয়ের নাম। বিষয়ভাবনায় বৈচিত্র ছিল প্রচুর। লিঙ্গ পরিবর্তন থেকে পারমাণবিক ধ্বংস ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে লেখাগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়।
‘ফ্রান্সিস স্টিভেন্স’ ছদ্মনামে আরেক নারী লিখতে থাকেন যাঁর আসল নাম গার্ট্রুড ব্যারোজ বেনেট (১৮৮৪-১৯৪৮)। ‘ক্লেইমড’, ‘দ্য সিটাডেল অফ ফিয়ার’, ‘দ্য হেডস অফ সারবেরাস’ ইত্যাদি উপন্যাসের এই লেখক প্রথম ডার্ক ফ্যান্টাসির জননী বলে ভাবা হয়। ডিসটোপিয়ার প্রথম যুগের লেখক বলে যথেষ্ট কদর পেয়েছিলেন ইনি। বলা হয়ে থাকে, লাভক্রাফটের রচনার ওপরেও প্রভাব আছে গার্ট্রুড বেনেটের।
এই পর্বের ফ্যান্টাসি লেখার আরেক অতি সফল লেখক সি এল ম্যুর। নামের আদ্যক্ষর লিখতেন যা থেকে পুরুষ না নারী, বোঝার উপায় ছিল না। পুরো নাম ক্যাথারিন লুসিল ম্যুর ( ১৯১১-১৯৮৭)। উইয়ার্ড টেলস-এ দু’টি সিরিজ লিখে অত্যন্ত নাম কিনেছিলেন ম্যুর। তরবারি ধারিণী যাদুকরী মহিলা চরিত্রকে প্রোটাগনিস্ট বা মূল চরিত্র বানিয়েছিলেন ম্যুর। ১৯৩৪ সালে লেখা উজ্জ্বল বিভ্রম ( ‘দ্য ব্রাইট ইল্যুশন’) অনুবাদ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটি ওঁর অন্যতম বিখ্যাত গল্প। স্পেকুলেটিভ ফিকশন বা ফ্যান্টাসির জঁরার কাজ , সায়েন্স ফিকশনের মাসতুতো বোন এই ভবিষ্যৎদর্শনের কল্পকাহিনিগুলি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিবরণে মুরের জুড়ি ছিল না। মনের প্রতিটি ক্রিয়ার পুঙ্ক্ষাণুপুঙ্ক্ষ বিবরণে, তিনি যেন খোদ মনস্তাত্ত্বিকের ভূমিকাও নিয়েছিলেন। সূক্ষ্ম বিচারে কাব্যময়, রঙিন, বিশ্লেষণধর্মী, এবং প্রবলভাবে ইন্দ্রিয়াতুর ( সেনসুয়াল) এই লেখাটি। শেষের দিকে প্রেমের সংজ্ঞা কী, তা নিয়েও তাঁর এক নিজস্ব দর্শন ফুটে উঠেছে। এবং আত্ম-পর ভেদ, আমরা-ওরার ভেদ, আমি ও আমার অপর-কে কীভাবে গ্রহণ করব, দুনিয়াময় হিংসা-সন্দেহ-ঘৃণার বাতাবরণে এ গল্প নতুন করে এইসব প্রশ্নের যেন ভিন্ন অর্থবহতা তুলে ধরে। হিংসার বদলে ভালোবাসার আশা জাগায়। এক গ্রহের প্রাণীর অন্য গ্রহের সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রার ও তথাকথিত অসুন্দর বীভৎস চেহারার প্রাণের প্রতি আকর্ষণে, এই বিজ্ঞপ্তিতে, যে আর কোনও মিল থাক বা না-থাক, আমাদের একটি মিল আছে তা হল আমরা দু’জনেই ‘আছি’। অস্তিত্বের মিল থেকেই শুরু হতে পারে ভালোবাসা।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই