মেয়েদের অঙ্ক হয় না, মেয়েদের ভ্রমণকাহিনি হয় না, মেয়েদের বিজ্ঞান হয় না, এমন কত স্টিরিওটাইপ ঘোরেফেরে চারিপাশে। মহিলাদের বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য খোদ মার্কিন-মুলুকে স্টেম-নামক স্ট্রিমে (সায়েন্স টেকনলজি ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিসিন) আলাদা গ্রান্ট দিয়ে, অনুদান-উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে ছয়ের দশকের পর থেকে। মেয়েরা যেখানে বিজ্ঞানই পড়েন না, সেখানে তাঁরা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লিখবেন, এই আশাও করা খানিকটা আকাশকুসুমের মতো।
৫.
সি এল ম্যুরের উজ্জ্বল বিভ্রম কাহিনিটি থেকে খানিকটা পড়াই যেতে পারে। শুধু এইটুকু বোঝার জন্য যে, নিজের পুরুষালি নামকরণ (আদ্যক্ষরের কোনও জেন্ডার থাকে কি?) দিয়ে নিজের লিঙ্গকে আড়াল শুধু করেননি ক্যাথারিন লুসিল ম্যুর, তিনি আড়াল করেছিলেন নিজের লেখা থেকেও নারীজগতের চিহ্ন। অর্থাৎ তিনি লিখতে চাইলেন তথাকথিত ‘পুরুষালি কলম’-এর একটি লেখা। বিমূর্ত, চেতনাবান, দার্শনিক, ঠিক যা যা এলিমেন্টকে আমরা পুরুষালি মানি, সেই সব দিয়েই তিনি তৈরি করলেন তাঁর এই ছদ্ম-জগৎ, এবং বাজার-সফল হলেন। এই কৃতিত্ব লক্ষ করলে বুঝি, নারীদের কত কঠিন প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে নিজেদের সাফল্য নিয়ে আসতে হয় এই পুরুষবিশ্বে, এই পুরুষ-পৃথিবীতে। এ কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্রও পুরুষ। তার নাম ডিক্সন। গল্পের শেষটায় যে প্রেম ঘটে সেখানেও নির্লিঙ্গ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত আছে কেন-না অন্য গ্রহের প্রাণীর লিঙ্গ অবর্ণনীয়।
“এই যে চিন্তার ঢেউগুলো, এদের পেছনে কোথাও যেন ‘আমি’ বলে কিছু নেই। প্রায় ঐশ্বরিকভাবে শান্ত, ঐশ্বরিকভাবে বিমূর্ত, এটা শুধু এর কেন্দ্রে ঝুলন্ত মানুষটার মস্তিষ্কের ভেতর দিয়ে জ্ঞানকে প্রবাহিত হতে দিচ্ছিল। আর খুব মাপা অনুপাতে যেন সেই জ্ঞানটা ডিক্সনের মনের মধ্যে গড়ে উঠল।
ওকে নির্বাচন করা হয়েছে। অনেক দিন ধরে এই অস্তিত্বটি অপেক্ষা করছিল, কাছাকাছি যারাই আসছিল তাদের ফাঁদ পেতে ধরছিল, তারপর বন্যার মতো আলোর ঢেউ তাদের মনের মধ্যে পাঠাচ্ছিল, তাদের চিন্তাকে আলোকিত করে তাদের জ্ঞান আহরণের ক্ষমতাকে দেখছিল, তাদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করছিল। ঐ যারা পড়ে আছে বাইরে, তাদের মধ্যে কিছু একটার অভাব নিশ্চয় ছিল। তাই তাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে এই অস্তিত্বটি। আর অপেক্ষা করেছে শান্ত নিষ্ক্রিয়তায়, সঠিক মানুষটি আসার জন্য।
এইটুকু তার মগজের মধ্যে খেলে গেল। তারপর একটা ফাঁক তৈরি হল। কিছুক্ষণের বিরতি। তার মধ্যে সেই জ্ঞানটুকুকে আত্তীকরণ করার, বুঝে নেওয়ার সময় পেল সে। কিছুক্ষণ পরে ছোট ঢেউগুলি আবার তার মধ্যে দিয়ে মাপা ধীর প্রক্ষেপে বইতে লাগল। ও সচেতন হয়ে বুঝল, বিপুল, অন্ধকার ফাঁকা জায়গায়গুলো, দেশকালের বা আরও কোনও বহুবিধ মাত্রার শূন্য অংশগুলোকে। ও বুঝল এগুলোর মাধ্যমেই, দীর্ঘ সময়খণ্ড পেরিয়ে গেলেও, যে সময়খণ্ডের সঙ্গে তার নিজের সময়ধারণার কোনও যোগই নেই, এই বিশাল আলোর বুদবুদটা অকল্পনীয় কোন দূরত্ব থেকে ভ্রমণ করে এসেছে একটা কিছুর খোঁজে।
সে উপলব্ধি করল, জিনিসটা ধূসর, আকৃতিবিহীন শূন্যতা থেকে শেষ অব্দি বেরিয়ে এসেছে তার ব্রহ্মাণ্ডের এই আন্তঃনাক্ষত্রিক দেশকালে। ডিক্সন বুঝে উঠতে পারবে না এমন কোন বিশাল উদ্দেশ্য নিয়ে জিনিসটা তাড়িত হয়ে এ ব্রহ্মাণ্ডে পৌঁছেছে এবং এই মরুভূমির বালিতে এসে বিরাম নিয়েছে, শুধু অপেক্ষায় থাকবে বলে।”
নারী কল্পবিজ্ঞান লেখকদের বারেবারেই পড়তে হয়েছে এই চক্করে। ঠিক যেরকম, মহিলা দার্শনিক দেখা যায় কম, কারণ মেয়েরা নাকি বিমূর্ত ভাবনা ভাবতেই পারে না, তেমনই গ্রহ, উপগ্রহ, মহাকাশযান, আন্তঃগ্রহ যুদ্ধ, লড়াকু সুপারম্যান, লড়াকু রোবট, এইসব থিম বা ‘ট্রোপ’ এর চক্করে পড়ে, মহিলাদের কল্পবিজ্ঞানও পড়তে হয়ে ওঠে পুরুষের কল্পবিজ্ঞানেরই মতো।
মেয়েদের অঙ্ক হয় না, মেয়েদের ভ্রমণকাহিনি হয় না, মেয়েদের বিজ্ঞান হয় না, এমন কত স্টিরিওটাইপ ঘোরেফেরে চারিপাশে। মহিলাদের বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য খোদ মার্কিন-মুলুকে স্টেম-নামক স্ট্রিমে (সায়েন্স টেকনলজি ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিসিন) আলাদা গ্রান্ট দিয়ে, অনুদান-উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে ছয়ের দশকের পর থেকে। মেয়েরা যেখানে বিজ্ঞানই পড়েন না, সেখানে তাঁরা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লিখবেন, এই আশাও করা খানিকটা আকাশকুসুমের মতো। যাঁরা লেখেন, তাঁরা তাই প্রখর চেতনাবান এক পৃথিবীর কথাই লেখেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নারী কল্পবিজ্ঞান লেখকদের বারেবারেই পড়তে হয়েছে এই চক্করে। ঠিক যেরকম, মহিলা দার্শনিক দেখা যায় কম, কারণ মেয়েরা নাকি বিমূর্ত ভাবনা ভাবতেই পারে না, তেমনই গ্রহ, উপগ্রহ, মহাকাশযান, আন্তঃগ্রহ যুদ্ধ, লড়াকু সুপারম্যান, লড়াকু রোবট, এইসব থিম বা ‘ট্রোপ’ এর চক্করে পড়ে, মহিলাদের কল্পবিজ্ঞানও পড়তে হয়ে ওঠে পুরুষের কল্পবিজ্ঞানেরই মতো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এর উল্টোদিকে, ছয়ের দশকের একটি ‘বেস্ট সাই-ফাই’ সংকলনেই পাই, আরেক লেখকের লেখা একটি ‘সফট’ কল্পবিজ্ঞান, যা আমাদের অবাক করে। জেনা হেন্ডারসনের লেখা গল্প– ‘ফুড টু অল ফ্লেশ’।
“ছাগলটার মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেলেন পাদ্রি। আবার এক টুকরো মাংস খুবলে নিয়ে মুখ দিয়ে উগরে দিল প্রাণীটা। হাত তুলে কাছে গেলেন পাদ্রি, শান্ত করতে চাইলেন প্রাণীটাকে এক পাত্র জল দিয়ে।
চোঁ চোঁ করে জলটুকু খেয়ে নিল প্রাণীটা। পুরো উলজড়ানো টিনের ক্যান্টিনটাই কেড়ে নিয়ে শেষ বিন্দু অবধি জল টেনে নিল তৃষ্ণার্ত ভাবে। ধকল তো আর কম যাচ্ছে না?
তারপর নিজের মহাকাশযানের কাছে চলে গেল অন্য গ্রহের লোকটা। ফিরে এল ফুটোর ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা কী যেন ছোট্টমতো নিয়ে।
কী এটা? নিচে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন পাদ্রি।
এ তো হুবহু এই প্রাণীর একটা ছোট্ট সংস্করণ।
এ তো তবে লোক নয়, এ তো এক মহিলা! এর সন্তান ওটি।
গুটি গুটি এভাবেই আরও দুটো প্রাণীকে বের করে আনল সে।
আর প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন পাদ্রি , ওর আঙুলের মধ্যে যে ছোট ছোট গোল নাটবল্টুর মতো জিনিস কাল দেখেছেন, সেগুলো উধাও।
তার মানে সেগুলোই ছিল এই সব শিশু প্রাণীর জন্মের গর্ভ!
ক’টা বাচ্চা আছে এই মহিলা ভিনগ্রহীর?
গুড়গুড় করে হামাগুড়ি দিচ্ছে এখন ঘাসের ওপর ওই নতুন প্রাণীরা। শিশু ভিনগ্রহী।
ততক্ষণে ওই মহিলা একে একে পাদ্রির হাতের ঝুড়ি থেকে একের পর এক জিনিস টেস্ট করছে আর থু থু করে ফেলে দিচ্ছে। কিছুই কি নেই এই পৃথিবীতে যা তার পেটে সয়?
পাদ্রি লোভ সামলাতে না পেরে ভাল করে দেখবেন বলে একটি শিশুকে কোলে তুলে নিলেন। হাতের তেলোয় এঁটে যায় মিষ্টি আর ছোট্ট প্রাণীটি।
উফফফফ। আচমকাই চিৎকার করে উঠলেন পাদ্রি! চমকে গেল মা-প্রাণী। তাকাল তাঁর দিকে।
ততক্ষণে পাদ্রি তুলে ধরেছেন রক্তঝরা আঙুল। ছোট্ট প্রাণীটা তাঁর আঙুলে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। দরদর করে রক্ত ঝরছে।
পাদ্রি নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠলেন, উ হু হু, তোমার বাচ্চা যে আমার আঙুল থেকে এক্কেবারে এক খাবলা মাংস তুলে নিল!
তারপরই থমকে যান পাদ্রি। নিজের আলখাল্লার পকেট থেকে রুমাল বের করে নিয়ে বাঁধতে যাবেন, একটা অদ্ভুত নীরবতা টের পান।
তাকিয়ে দেখলেন, মা প্রাণীর হাতে ধরা ছোট্ট প্রাণী চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে পাদ্রির হাতের আঙুল থেকে কামড়ে নেওয়া টুকরো। আর না, কয়েক সেকেন্ড কেটে যাওয়া সত্ত্বেও, সে উগরে দেয়নি তা!
মা প্রাণীর স্লাইডিং দরজার মতো পলকফেলা চোখে এখন এক অদ্ভুত দৃষ্টি। স্থির ভাবে সে তাকিয়ে আছে নিজের সন্তানের দিকে।
পাদ্রির সমস্ত রক্ত হিম হয়ে জমাট বেঁধে গেল এক মুহূর্তে।
মানুষের মাংস! একমাত্র মানুষের মাংসই এদের সহ্য হয়। এরা খেতে পারে । এই দুনিয়ায় আর কিচ্ছু নেই যা খিদে মেটাতে পারে এদের।
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন পাদ্রি , হাতে ব্যান্ডেজের মতো করে ধরা রুমাল।
প্রাণীটা ধীরে ধীরে এক-পা এক-পা করে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে।
খুব কাছে এসে গেছে প্রাণীটা। তার চকচকে দাঁতগুলো এখন প্রায় চোখের কাছে। আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না।
হঠাৎ সটান পেছন ফিরে দৌড় দিল প্রাণীটা। হতবাক হয়ে পাদ্রি দেখলেন, প্রাণীটা কুড়িয়ে নিল তার সন্তানদের ঘাসের ওপর থেকে। সবক’টাকে কাছিয়ে তুলে, ছোট্ট গর্ত দিয়ে নিজের মহাকাশযানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। শেষ দেখা গেল তার রুপোলি কালো ডোরা কাটা হাত।
এতক্ষণের ধরে থাকা শ্বাস একটু ছাড়লেন, আর অবাক চোখে পাদ্রি দেখলেন, চোখের পলকে ছিদ্র গেল বন্ধ হয়ে, আর চুপসোনো বেলুন ফুলে উঠল। তারপরই খুব দ্রুত সাঁ করে আকাশে উড়াল দিল বেলুনটা। লালচে কিসমিস রঙের বেলুন।
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললেন পাদ্রি। উঠে ঝুড়ি নিলেন, খালি ক্যান্টিন তুলে নিলেন। ঝেড়ে নিলেন আলখাল্লা।
আস্তে আস্তে ফিরতে লাগলেন গির্জের দিকে।”
মাতৃত্বের সঙ্গে যত্ন আর সম্প্রীতি, মায়ামমতার সম্পর্কটুকু এঁকেছেন সযত্নে জেনা এখানে। যেকোনও ভিনগ্রহী প্রাণীকে পুরুষ ধরে নিয়ে এগুনোর প্রকল্পকেও নস্যাৎ করে এই ভিনগ্রহীকে করেছেন নারী। আর মা বলেই সে অচেনা গ্রহের সাহায্যকারী দয়ালু পাদ্রিসাহেবকে খেয়ে ফেলতে চায় না, সে তাঁর সহায়তার প্রতিদানে সে গ্রহ থেকে ফিরে চলে যায়। একদিক দিয়ে জেনার লেখাটি তাই ছক ভাঙা।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই