আমি যখন কল্পনা মাসিকে দেখেছি, কল্পনা মাসির তখন বছর চল্লিশেক বয়স। সারাজীবন না কি রান্না করে স্কুলে গিয়েছে। কোনও দিন প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। পড়াশোনা শেষ করে স্কুলের চাকরি পেল। চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই নার্ভের অসুখে পড়ে। অনেক জায়গাতেই গিয়েছে, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি কিছুই বাদ দেয়নি। মাঝে মাঝে ব্যথায় কুঁকড়ে মানুষটা ছোট্ট হয়ে যেত। কিন্তু পড়ানো বন্ধ হত না কোনও দিনও।
জীবন যেন কোনও থ্রিলার মুভির থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর। এই জীবন আমার, অথচ এই পথে কী ঘটবে বা ঘটবে না, তা ঘুণাক্ষরেও আমি জানি না। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তাও দশটার মধ্যে তিনটে প্রশ্ন কমন পড়ে। অন্তত সম্ভাবনা থাকে কমন পড়ার। এই পরীক্ষা কোন বিষয়ের ওপর, তা-ই জানি না। সুতরাং পড়াশোনা করেও লাভ হয় না কিছুই। তাও ভালো থাকার কত আপ্রাণ চেষ্টা আমাদের। ভালো থাকার জন্য কত মানুষ বয়ে যায়, লড়ে যায়, মরেও যায়। আর কিছু মানুষ খারাপের পরিধি কমিয়ে ভালোবাসা দেয় নিজেকে, আর সবাইকে।
কল্পনা মাসি আমার মাসিমণির বন্ধু। দু’জনে একসঙ্গে স্কুলে পড়াশোনা করত। আমার মা কল্পনা মাসির খুবই গুণমুগ্ধ একজন ভক্ত। প্রচণ্ড ন্যাওটা। কল্পনা মাসির নানারকম গল্প ছোটবেলা থেকেই শুনতাম। কিন্তু বড় হয়ে যতবার গিয়েছি মানুষটার সামনে, দেখেছি মানুষটাকে, মনে হয়েছে যা শুনেছি তা তো এর থেকে অনেক বেশি, অনেক দৃঢ়, অনেক পেলব। কল্পনা মাসির বাড়িতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধে পড়ার মুখে আমরা যেতাম। বিকেলের খেলাটা হত না বলে একটু মনখারাপ হত ঠিকই, কিন্তু ওই বাড়িতে যাওয়ার পর খেলার দুঃখ মনে থাকত না আর। কল্পনা মাসির বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় আধঘণ্টা দূরে হাঁটা পথে। বাড়ির পাশে মস্ত বড় একটা পুকুর আর প্রচুর গাছপালা। একটা স্যাঁতসেতে ঘরে থাকত কল্পনা মাসি। সন্ধেবেলা গেলেই দেখতাম গোটা দশেক বাচ্চা ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছে। আমার গিয়েই কাজ ছিল একটা মশার ধূপ জ্বালিয়ে মশা মারা। আর মা গিয়ে ঘর গুছিয়ে দিত, কল্পনা মাসির চুল বেঁধে দিত। মাসি ভালোবেসে মাকে ‘বুনু’ বলে ডাকত। অন্যদিন চুল বাঁধা, ঘর গুছিয়ে দেওয়া, শাড়ি পরিয়ে দেওয়া, খাইয়ে দেওয়া, আশপাশের ছাত্রছাত্রীদের মা, নয়তো একটু বয়সে বড় ছাত্রীরা করে দিত। কল্পনা মাসি হাঁটতে পারে না, সারা শরীর প্যারালাইজ্ড। কোনওরকম কলম ধরে লেখে। নিজে নিজে বাথরুমে যাওয়ার ক্ষমতাও নেই। একটা মশা বসলেও মারতে পারে না। পারে শুধু সারাক্ষণ হাসিমুখে থাকতে। কোনও অভিযোগ না করে সবার কথা শুনতে। অবাক লাগে আমার। কী করে পারে মানুষটা বা কীভাবে পারত?
আমি যখন কল্পনা মাসিকে দেখেছি, কল্পনা মাসির তখন বছর চল্লিশেক বয়স। মা ছোটবেলায় মারা গিয়েছিল। বাবা-কাকার কাছেই মানুষ। সারাজীবন না কি রান্না করে স্কুলে গিয়েছে। কোনও দিন প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। পড়াশোনা শেষ করে স্কুলের চাকরি পেল। যতদূর মনে পড়ে টিটাগড় তালপুকুরের দিকে কোনও একটা স্কুলে পড়াত। চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই নার্ভের অসুখে পড়ে। অনেক জায়গাতেই গিয়েছে, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি কিছুই বাদ দেয়নি। সব করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ব্যথায় কুঁকড়ে মানুষটা ছোট্ট হয়ে যেত। কিন্তু পড়ানো বন্ধ হত না কোনও দিনও।
কল্পনা মাসির এক বিহারি রিকশাওয়ালা ছিল– রামধনু। সবাই ডাকত ‘বাসন্তীর বাবা’ বলে। সারাজীবন মাসিমণি বাসন্তীর বাবার রিকশাতেই যাতায়াত করত। রিকশার সামনে নাগরদোলনায় যেমন খিলের মতো আটকে দেয়, রিকশাতেও ওরকম থাকত, যাতে পড়ে না যায়। স্কুলে একটা চেয়ারে বসে থাকত। আর ছাত্ররা প্রতি পিরিওডে ক্লাস চেঞ্জ করত। বাসন্তীর বাবা মাসিকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে চেয়ারে বসাত। কল্পনা মাসি নিশ্চয়ই ওকে খুব বিশ্বাস করত। বিশ্বাস না থাকলে নিজের শরীরের সম্পূর্ণ ভার কোনও মানুষের হাতে তুলে দেওয়া যায় না বোধহয়। শুধু আমাদের বাড়িতে এলে বাবা কোলে করে এনে মাসিমণিকে খাটে শুইয়ে দিত। বাড়িতে এলেই বাবা, মা, আমি সবাই বেশি বেশি যত্ন করতাম। মা শুধু বলত, ‘দিদি তুমি ঠিক আছ, কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো’। এখন বুঝি কল্পনারা ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতার মতো। অসুবিধার কথা বলতে শেখেনি। আর বেশি বেশি যত্ন পেতে কি কল্পনামাসি কুণ্ঠাবোধ করত। ভাবি কিন্তু উত্তর পাই না। কল্পনা মাসির আরও এক বিশ্বাসের মানুষ ছিল অসীম মামা। ছোটবেলার পাড়ার বন্ধু। ভালোবাসার মানুষ। অসীম মামার একটা চায়ের দোকান ছিল। পাড়ার সবাই সন্ধেবেলা থেকে তাস, ক্যারাম খেলত ওই দোকানে। রাজনীতি, খেলা নিয়ে কথা বলত। একটা সাদা-কালো টিভি চলত সারাক্ষণ। মা বলেছিল অসীম মামা নাকি নকশাল করত এক সময়। ফলে সরকারি চাকরির প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছে বারবার। মা একপ্রকার জোর করেই দু’জনকে রাজি করিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে বিয়ে দিল। আমাদের বাড়িতে হল সেই সাদামাঠা অনুষ্ঠান। সই করে, মালা বদল করে ওরা দু’জনে এক হল। আর আমরা সবাই মাংস, ভাত, দই, রসগোল্লা খেলাম। সেদিন মাসিমণি খুব কেঁদেছিল মায়ের কাছে। কান্নার ভাষাটা সেদিন বুঝিনি, আজও না। মাসিমণির প্রায় যাবতীয় কাজ অসীম মামা করে দিত। স্নান করানো, স্কুলের জন্য রেডি করে দেওয়া মানে শাড়ি পরিয়ে দেওয়া। পিরিয়ডস হলে প্যাড পাল্টে দেওয়া। আসলে মাসিমণিকে ভালোবাসত সবাই। মাঝে মাঝে মা-কে হা-হুতাশ করে বলতে শুনেছি, কী কপাল মানুষটার। সারাজীবন এত পরিশ্রম করে যখন চাকরি পেল, দুটো সুখের মুখ দেখবে, তা নয়। কপালে এমন দুর্ভোগ লেখা আছে, কে জানে? আজ কল্পনা মাসি কিছু বছর হল মারা গিয়েছে। একটা কবিতার বই লিখেছিল। ‘ঝরাপাতা’। কল্পনা ভৌমিক। নদীর ধারে পা ডুবিয়ে থাকার গল্প। জ্যোৎস্না রাতে জঙ্গলে হাঁটার গল্প। প্রেমিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখে চুমু খেয়ে নোনতা আদরের গল্প। সব সুখের কথা সবুজ পাতার গল্প বলে গিয়েছে ঝরাপাতা কবিতায়। সব কল্পনা, অসীম, রামধনু, রুমা-রা (আমার মা) ভাল থাকুক। আমরা শুধু প্রতি পিরিয়ডে ক্লাস পাল্টাই, জীবনের গল্প শুনব বলে। কিন্তু এই গল্প থ্রিলার নয়, রূপকথার।