এই বঙ্গে বহু এমন ক্রিকেটার আছেন বা ছিলেন, শত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যাঁদের কখনও দেশের হয়ে খেলা হয়নি। কখনও তা আটকে দিয়েছে রাজনীতির জাঁতাকল। কখনও বা অনভিপ্রেত চোট-আঘাত। বাংলা ক্রিকেটের সেই হারানো সুরদের নিয়ে খেলাইডোস্কোপ-এ শুরু হচ্ছে নতুন সিরিজ– উপেক্ষিত একাদশ। আজ তার প্রথম পর্ব। সে টিমের ওপেনিং বোলার দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়-কে নিয়ে।
২৫.
উত্তর কলকাতার নির্জীব গলি। স্বল্প-পরিসর ঘর। দেওয়ালে ধুলোমাখা কতিপয় ছবির ‘ঝুলন’। এবং ঘরজোড়া এক মৃত আলো।
দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এরাই আমার প্রথম ও শেষ স্মৃতি।
২০১১ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারির সকালে ঠিক কী করছিলাম, আজ আর মনে পড়ে না। এটুকু মনে আছে, আমার তৎকালীন ক্রীড়া সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্য-র একখানা ফোন এসেছিল। উনি বললেন যে, বাংলার এক বিখ্যাত ক্রিকেটার প্রয়াত হয়েছেন। দ্রুত তাঁর উত্তর কলকাতার বাড়ি চলে যেতে। এরপর ক্রিকেটারের নাম বললেন। শুধোলেন, চিনি কি না? নির্দ্বিধায় ‘না’ বলেছিলাম। আসলে দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে চেনার বয়স তখনও হয়নি। বোধ হয়নি। চেতনা হয়নি। আজও হয়েছে কি? দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে চিনে উঠতে পেরেছি কি? মাঠে-ময়দানে ১৭ বছর কাটানোর পরেও কি সম্পূর্ণ জেনে উঠতে পেরেছি তাঁকে? অনুধাবন করতে পেরেছি দুর্গাশঙ্করবাবুর ক্রিকেট কৌলিন্যকে?
সন্দেহ হয়, ঘোর সন্দেহ। দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে বোঝার বোধশক্তি বোধহয় আমার এখনও হয়নি। ১৩ বছর আগে দুর্গাবাবুর প্রয়াণ কভার করতে গিয়ে জেনেছিলাম, ভারতের হয়ে খেলতে পারতেন তিনি। স্বচ্ছন্দে পারতেন। স্কিল ছিল। যোগ্যতা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। খেলা হয়নি দেশের জার্সিতে। আসলে ক্রিকেট মাঠ তিনি জানতেন। ক্রিকেট রাজনীতি কাকে বলে জানতেন না। জানলে, ২৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অমর্যাদাকর পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ থাকত না তাঁর ক্রিকেট রত্নকোষ। নিদেনপক্ষে ভারতের হয়ে গোটা কয়েক টেস্ট খেলতেন। ’৫৯-এর ইংল্যান্ড সফরে বিলেতের ফ্লাইটও ধরতেন নিঃসন্দেহে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ময়দান দুঃখ করে বলে, দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় এ সমস্ত কালীঘাটের বদলে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে করলে, দেশের হয়ে দু’দশটা টেস্ট খেলতেন চোখ বন্ধ করে। বেচু দত্ত রায়ের ‘আশীর্বাদে’। কিন্তু তিনি তা করেননি। কখনও স্পোর্টিং ইউনিয়ন খেলেননি। ’৫৯-এর সফরে ডাক না পেয়ে সন্তপ্ত হৃদয়ে ভেঙে পড়েছেন (তখনকার দিনে আজকের মতো গণ্ডায় গণ্ডায় খেলা থাকত না)। বাংলা ছেড়ে রেলওয়েজ গিয়েছেন। কিন্তু স্পোর্টিং ইউনিয়ন কখনও খেলেননি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দু’শো বছরের পরাধীনতার গ্লানিতেই হোক কিংবা ক্ষরণে, ইংরেজদের নিয়ে বঙ্গ সমাজে পরোক্ষ উপহাসের চল আছে। ফিটফাট, কেতাদুরস্ত কাউকে দেখলে আমরা ঠাট্টা করে বলি ‘লাটসাহেব’। ইংরেজিতে কাউকে ফটরফটর করতে শুনলে গায়ে জ্বালা ধরে, বিদ্রুপ করে ডাকি ‘ট্যাঁশ’। তা, দুর্গাশঙ্করবাবুও কিন্তু একপ্রকার ইংরেজ-ই ছিলেন। চলন-বলন বা আদব-কায়দায় নয়। ক্রিকেটে!
বাংলা ক্রিকেটের লোকপ্রবাদ বলে, ফাস্ট মিডিয়াম পেসার দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় বল দু’দিকেই অনায়াসে ‘মুভ’ করাতে পারতেন। তাঁর লাইন-লেন্থ অনিন্দ্যসুন্দর ছিল। পাঁচ বা ছয়ের দশকে তাঁর সমসাময়িক ক্রিকেট সতীর্থরা আজও বলাবলি করেন, উপমহাদেশের পিচ নয়। দুর্গাশঙ্করের বোলিং আদতে বিলিতি পরিবেশের উপযোগী। বল যেথা সুইং করে। অত্যাশ্চর্য হল, ’৫৯-এ ইংল্যান্ড সফরের জন্য ভারতীয় দল যখন নির্বাচন হয়, সেই দুর্গাশঙ্করকেই কি না ভাবা হয়নি! অক্লেশে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল! রাজু মুখোপাধ্যায়ের মতো ক্রিকেট ঐতিহাসিকরা যাকে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘সর্বকালীন কলঙ্ক’ হিসেবে অভিহিত করেন।
পুরনো পুঁথি-নথি খুঁজলে দেখা যাবে, ’৫৯-এ মাত্র দু’জন পেসার নিয়ে ইংল্যান্ডে পাঁচ টেস্টের সফরে গিয়েছিল ভারত! রমাকান্ত দেশাই আর সুরেন্দ্র নাথকে নিয়ে। বাকি সব স্পিনার! সে আমলে পাঁচ টেস্টের সিরিজ মানে, স্রেফ পাঁচটা টেস্ট খেলে ফিরে আসত না দল। যে সমস্ত জায়গায় খেলা পড়ত, সেখানকার কাউন্টি টিমের সঙ্গেও খেলতে হত। গড়ে সপ্তাহে ছ’দিন খেলা থাকত তখন। মাসের পর মাস ধরে একটা সফর চলত। বিশ্বের যে কোনও টিম ইংল্যান্ড সফরে গেলে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচজন পেসার রাখত স্কোয়াডে। সেখানে ’৫৯-এর সফরে ভারত নিয়ে যায় মাত্র দু’জন পেসার! শেষে সিরিজে ০-৫ হেরে ফেরে।
দেশের ক্রিকেট ঐতিহাসিকরা এ হেন কুৎসিত বিপর্যয়ের নেপথ্যে দুটো কারণ খুঁজে পান। এক, দত্তাজিরাও গায়কোয়াড়কে অধিনায়ক নির্বাচন। বলা হয়, ‘সেনাপতি’ হওয়ার যাঁর কোনও যোগ্যতা ছিল না। না হলে নিখাদ ব্যাটার হিসেবে সুযোগ পাওয়া এম এল জয়সীমাকে চার পা দৌড়ে সেই সিরিজে বল করতে হত না। দুই, বেচু দত্ত রায় নামের এক বাঙালি কর্তা! যাঁর অঙ্গুলিহেলনে দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের দলে জায়গা হয়নি! সেই সময় দেশের সেরা পেসার হওয়া সত্ত্বেও।
শোনা যায়, তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেটে প্রবল প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল বেচু দত্ত রায়ের। ভারতীয় দল নির্বাচনেও মুখ্য ভূমিকা নিতেন এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্পোর্টিং ইউনিয়ন কর্তা। সে সময় ময়দানে অলিখিত নিয়ম ছিল, দেশের জার্সিতে খেলতে হলে তোমায় স্পোর্টিং ইউনিয়ন ঘুরে আসতে হবে! না হলে কপালে লবডঙ্কা ছাড়া কিছু আর জুটবে না। দুর্গাশঙ্কর বাবু ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন কালীঘাটের হয়ে। ক্লাবকে এতই ভালোবাসতেন যে, কেরিয়ারের শেষের দিকে ক্লাবে চলে আসতেন উদীয়মান প্রতিভাবানদের নেটে বোলিং করতে! কালীঘাট খেলার সময় রাজু মুখোপাধ্যায়রা তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন। প্রখ্যাত কোচ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, প্রকৃত কোচ সে, যে শুধু মুখে বলে না, হাতেগরম করে দেখাতে পারে। দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন অবিকল সেই ঘরানার। ক্রিকেট-শিক্ষার্থীকে আউটসুইং বা ইনসুইং গ্রিপ দেখানোয় তাঁর কাজ শেষ হত না। নিজে নেটে বল করে দেখিয়ে দিতেন, বলটা পড়বে কোথায়? ‘দুর্গাদা’ ক্লাবে আসছেন খবর ছড়িয়ে গেলে সে আমলে তরুণ ক্রিকেটারদের ‘প্লাবন’ নামত কালীঘাট ক্লাবে। স্বাভাবিক। হাতে-কলমে খেলার-পাঠ আর দিতে পারে ক’জন?
ময়দান দুঃখ করে বলে, দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় এ সমস্ত কালীঘাটের বদলে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে করলে, দেশের হয়ে দু’দশটা টেস্ট খেলতেন চোখ বন্ধ করে। বেচু দত্ত রায়ের ‘আশীর্বাদে’। কিন্তু তিনি তা করেননি। কখনও স্পোর্টিং ইউনিয়ন খেলেননি। ’৫৯-এর সফরে ডাক না পেয়ে সন্তপ্ত হৃদয়ে ভেঙে পড়েছেন (তখনকার দিনে আজকের মতো গণ্ডায় গণ্ডায় খেলা থাকত না)। বাংলা ছেড়ে রেলওয়েজ গিয়েছেন। কিন্তু স্পোর্টিং ইউনিয়ন কখনও খেলেননি।
হয় কিছু কিছু মানুষ এমন। মোহ-মায়া যাঁদের বাঁধতে পারে না। তৃতীয় রিপু যাঁদের বশ করতে পারে না। যাঁরা নিজের আখের গোছানোর তাড়নায় ভাসিয়ে দিতে পারেন না ভালোবাসাকে। ভারতের হয়ে খেলাও তাঁদের হয় না। কিন্তু তবু, দিনশেষে ভারত তাঁদের মনে রেখে দেয়। সময়-অসময়ে স্মরণ করে তাঁদের একটি দুর্লভ সম্পদের জন্য। যা আদতে এক অস্থি, মনুষ্য শরীরের দু’শো ছয় অস্থি-র মধ্যে একটা। পিঠ থেকে কটিদেশ পর্যন্ত যার বিস্তৃতি।
শিরদাঁড়া!
(চলবে)
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৪: আম্পায়ার সেই নিঃস্ব প্রজাতি যারা ক্রিকেটকে শুধু দিল, পেল না কিছুই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৩: বিশ্বাসে মিলায় ক্রিকেট, ‘কু’সংস্কারে বহুদূর!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২২: ‘ফিক্সার’-রা ছিল, আছে, থাকবে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের আরশোলা-র মতো
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২১: বল পিছু স্কোরবোর্ডে যারা সংখ্যা বদলায়, কিন্তু তাদের জীবন বদলায় না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২০: প্রতি গুরু-পূর্ণিমায় প্রথম ফুল দেব সব্যসাচী সরকারকেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৯: ময়দানের ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি, রাখে না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’