এই বঙ্গে বহু এমন ক্রিকেটার আছেন বা ছিলেন, শত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যাঁদের কখনও দেশের হয়ে খেলা হয়নি। কখনও তা আটকে দিয়েছে রাজনীতির জাঁতাকল। কখনও বা অনভিপ্রেত চোট-আঘাত। বাংলা ক্রিকেটের সেই হারানো সুরদের নিয়ে খেলাইডোস্কোপ-এ শুরু হয়েছে নতুন সিরিজ– উপেক্ষিত একাদশ। আজ তার তৃতীয় পর্ব। সে টিমের শ্রীযুক্ত ‘সংকল্প’ প্রকাশ পোদ্দার-কে নিয়ে।
২৭.
প্রকাশ পোদ্দারকে বোধহয় দেখে-দেখে বৃহস্পতিবারই ফোন করতাম। ঠিক যে দিন তিনি কথা বলতেন না!
ক্রিকেট সাংবাদিকতায় দৌড়োদৌড়ি শুরু করার পর পুরাতনী ক্রিকেটারদের আমুদে আড্ডায় বহু শুনেছি যে, প্রকাশ পোদ্দারকে যোগাযোগ করা নাকি ঝঞ্ঝাট বিশেষ! দিন-ক্ষণ-পুঁথি-পঞ্জিকা ঘেঁটে তারপর তাঁকে ফোনটোন করতে হয়! প্রকাশবাবু জীবনের শেষ ইনিংসটা খেলেছিলেন বেঙ্গালুরুতে। কলকাতার পাট চুকিয়ে পাকাপাকি চলে গিয়েছিলেন। পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকতেন। খেলা, খেলাধুলোর আইন-পাগল ভদ্রলোক পুরোপুরি ঈশ্বর নিবেদিত প্রাণ হয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। সময়-অসময়ে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, ফোনেও পেতাম না। কখনও কখনও তাঁর স্বজন ফোন ধরে বলতেন, ‘আজ তো কথা বলতে পারবেন না উনি।’
‘কেন?’
‘আজ বৃহস্পতিবার!’
পরে শুনেছি, তাঁরই এক সতীর্থ ছেলের বিয়ের নেমতন্ন করতে গিয়ে প্রবল চটে প্রকাশ পোদ্দারের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলেন! কী না, প্রকাশবাবু পুরনো ক্রিকেট-মিত্রের সঙ্গে আধখানা শব্দও বলেননি! শেষে কাগজে লিখে দেন, ‘আজ বৃহস্পতিবার। আর বৃহস্পতিবার আমি কথা বলি না!’ ভেবে বিস্ময়ই লাগে যে, যিনি এতটা সাত্ত্বিক। এতটা ঈশ্বরনিষ্ঠ। এতটা নির্বিবাদী চরিত্র। সেই তিনিই কি না ক্রিকেটের নেশায় পিতার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন! সুনীল গাভাসকর-সহ সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল টিমকে কর্কশ ‘স্লেজিং’ করে নাকের জলে, চোখের জলে করে ছেড়েছিলেন!
ভারতের হয়ে দ্বাদশ ব্যক্তির বেশি এগোয়নি প্রকাশ পোদ্দারের কেরিয়ার। তবে পারতেন টেস্ট খেলতে। সে ক্ষমতা ছিল। সে যোগ্যতা ছিল। ৭৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৩৮৬৮ রান (বাংলা ও রাজস্থান, দুই রাজ্যের হয়ে), প্রায় ৪০ গড় যার প্রামাণ্য নথি। চোয়ালচাপা ক্রিকেটার ছিলেন প্রকাশবাবু। লড়তে জানতেন। মাঠ ছেড়ে পালানোর লোক তিনি ছিলেন না। যতীন দাস রোডে বেড়ে ওঠা। ছোট থেকে নেশাভাঙের একটাই বস্তু ছিল– ক্রিকেট! শোনা যায়, বই-খাতার বদলে দুর্গা ঠাকুরের পায়ে ক্রিকেট ব্যাট ছোঁয়াতেন! কিন্তু ছেলের ক্রিকেটের প্রতি পাগলপারা প্রেম পছন্দ ছিল না বাবার। দ্রুতই তিনি নিদান দেন যে, বাড়িতে থাকতে গেলে ক্রিকেট নিয়ে ‘পণ্ডশ্রম’ বন্ধ করতে হবে! দ্বিরুক্তি করেননি প্রকাশ। সোজা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান! শুনেছি, অবসরের পর বোর্ড থেকে পেনশনের চেক পেয়ে সেটা স্বর্গত পিতার ছবির সামনে রেখে এসেছিলেন! জনান্তিকে বলেছিলেন, বাবা বলতেন ক্রিকেট খেলে কিছু জুটবে না। কিছু হবে না। জুটল তো! হল তো!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভারতের হয়ে দ্বাদশ ব্যক্তির বেশি এগোয়নি প্রকাশ পোদ্দারের কেরিয়ার। তবে পারতেন টেস্ট খেলতে। সে ক্ষমতা ছিল। সে যোগ্যতা ছিল। ৭৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৩৮৬৮ রান (বাংলা ও রাজস্থান, দুই রাজ্যের হয়ে), প্রায় ৪০ গড় যার প্রামাণ্য নথি। চোয়ালচাপা ক্রিকেটার ছিলেন প্রকাশবাবু। লড়তে জানতেন। মাঠ ছেড়ে পালানোর লোক তিনি ছিলেন না। যতীন দাস রোডে বেড়ে ওঠা। ছোট থেকে নেশাভাঙের একটাই বস্তু ছিল–ক্রিকেট!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পূর্বে প্রকাশের স্লেজিংয়ের কথা লিখেছি। ক্রিকেট আইন সম্পর্কে পাণ্ডিত্যের কথা বলেছি। শোনা যায়, একবার হাফ প্যান্ট পরে ইডেনে খেলতে নেমে গিয়েছিলেন প্রকাশ! আম্পায়ার কৈফিয়ত চাওয়ায়, তাঁকে পাল্টা দাঁত খিঁচুনি দিয়ে তিনি বলেন যে, ক্রিকেটের কোন আইনে লেখা রয়েছে যে, হাফপ্যান্ট পরে ক্রিকেট খেলা যাবে না? আম্পায়ার থতমত খেয়ে আর কথা বাড়াননি। বিপক্ষ অধিনায়কও মাঠে বিপ্লবের সাহস পাননি! স্লেজিংয়ের গল্পখানা আরও মিঠে, আরও সরেস।
সাতের দশকের শুরু। পূর্বাঞ্চল বনাম পশ্চিমাঞ্চল দলীপ ট্রফির ম্যাচ। গাভাসকর, সোলকার, অংশুমান গায়কোয়াড়, কে নেই পশ্চিমাঞ্চল টিমে? তা, পোদ্দার সাহেবকে প্রতিটা বল করার পর পশ্চিমাঞ্চল বোলাররা মুখ দিয়ে অনর্গল ‘উউ’…‘আআআ’ শব্দ করছিলেন। কিছুক্ষণ সহ্য করার পর নাকি খেলা থামিয়ে দেন প্রকাশ পোদ্দার। আম্পায়ারকে গিয়ে বলেন, ‘মাঠে কুকুর ঢুকেছে নাকি? জানেন তো, আমি কুকুরে খুব ভয় পাই!’ বলে কালবিলম্ব না করে কখনও সোলকার, কখনও গায়কোয়াড়দের পাশে গিয়ে সারমেয়-সন্ধান শুরু করে দেন! পশ্চিমাঞ্চলের পক্ষে পরিস্থিতি এতই অপ্রীতিকর হয়ে ওঠে যে, শেষে তাদের অধিনায়ক অশোক মানকড় রীতিমতো করজোড়ে প্রকাশ পোদ্দারকে নাকি বলেন, ‘স্যর, আপ প্লিজ ব্যাটিং কিজিয়ে!’ শোনা যায়, খেলা শেষে অংশুমান গায়কোয়াড় পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় ক্রিকেট-বন্ধুদের বলে এসেছিলেন, ‘স্লেজিং’ কাকে বলে অস্থি-মজ্জায় টের পেয়ে গিয়েছেন তাঁরা! চিরকাল দেখে এসেছেন বোলার ‘স্লেজ’ করে ব্যাটারকে। আর পোদ্দারের পাল্লায় পড়ে ঘটল কি না উল্টো!
এ হেন বর্ণময়, রামধনু চরিত্র হয়তো বা উপেক্ষা-সরণিতেই ইহকাল থেকে যেত, এক জ্যোতির্ময় প্রতিভার স্বাক্ষরের ‘হাতেখড়ি’ তাঁর হাত দিয়ে না হলে! ভারতীয় বোর্ডে জগমোহন ডালমিয়ার শাসনকাল তখন। দেশজুড়ে প্রতিভা অন্বেষণে ‘টিআরডিও’ প্রোজেক্ট আমদানি করেছেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট ডালমিয়া। কমিটির মাথায় বসিয়েছেন প্রবাদপ্রতিম দিলীপ বেঙ্গসরকরকে। সে কমিটির অধীনস্থ ছিলেন প্রকাশ। ২০০৪ সালে জামশেদপুরে রনজি ওয়াড ডে টুর্নামেন্টের (বিজয় হাজারে) আঞ্চলিক পর্ব অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সেখানেই স্ফীত পেশি, লম্বা চুলের এক ক্রিকেটারের সন্ধান পান প্রকাশ পোদ্দার। সঙ্গী ছিলেন রাজু মুখোপাধ্যায়। দু’জনে খুঁজতে গিয়েছিলেন কিপার। পেয়ে যান হিরে। না, লম্বা চুলের যুবকের কিপিং দু’জনের একজনেরও পছন্দ হয়নি। রিপোর্টে অ্যাভারেজ লিখে ছেড়ে দেন। গুরুত্ব সহকারে লেখেন শুধু যুবকের পাশবিক শক্তি। প্রকাশরা লিখে দেন, এ ছেলে যে দিন খেলবে, বিপক্ষকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে! এ তিরিশ করলেও তাতে চারটে ছয় থাকে!
তারপর?
তারপর দিলীপ বেঙ্গসরকরের ফোন। ‘কর্নেল’-এর গাঁইগুঁই। তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বেঙ্গসরকরকে নিমরাজি করানো। তারপর লম্বা চুলের তেজিয়ান ছোকরাকে বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পাঠানো।
তারপর চারটে বল, চারটে ছয়। যার তিনটে রাস্তায়! তারপর বাকরুদ্ধ ঠোঁট। ছানাবড়া চোখ। তারপর নাম। ধাম। ডাক। খোঁজ।
মহেন্দ্র সিং ধোনি রিপোর্টিং স্যর!
(চলবে)
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………….
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৬: যে আক্ষেপ বয়ে বেড়ালেন বাংলা ক্রিকেটের ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৫: শিরদাঁড়াটা বিক্রি নেই যাঁদের, তাঁদের দেশ মনে রাখে চিরকাল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৪: আম্পায়ার সেই নিঃস্ব প্রজাতি যারা ক্রিকেটকে শুধু দিল, পেল না কিছুই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৩: বিশ্বাসে মিলায় ক্রিকেট, ‘কু’সংস্কারে বহুদূর!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২২: ‘ফিক্সার’-রা ছিল, আছে, থাকবে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের আরশোলা-র মতো
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২১: বল পিছু স্কোরবোর্ডে যারা সংখ্যা বদলায়, কিন্তু তাদের জীবন বদলায় না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২০: প্রতি গুরু-পূর্ণিমায় প্রথম ফুল দেব সব্যসাচী সরকারকেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৯: ময়দানের ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি, রাখে না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে