রেণুকার মনের কথা কিন্তু পিতা রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন না। তাঁর স্বাধীন মনের দাম দেননি তিনি। বরং একেবারেই প্রচলিত সমাজের বিধি অনুসরণ করেছেন সাধারণ আর পাঁচজন সামাজিক বিধি মেনে চলা বাবার মতো। স্ত্রী মৃণালিনীকে চিঠিতে লিখছেন, ‘রাণীর যেমন প্রকৃতি– বাপের বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই ও শুধরে যাবে…।’ এ কোন রবীন্দ্রনাথ? সংবেদী লেখক রবীন্দ্রনাথ নন।
মেয়ের বাবা হিসেবে কেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ? যে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, সেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পিতা রবীন্দ্রনাথকে মেলানো যায় না অনেক সময়। দু’জনে যেন দুই ভিন্নমুখের পথিক। দু’জন যেন একেবারেই বিপরীত মানুষ। লেখার ভাবের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের কাজের মিল নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিমন সংবেদী, নিভৃতচারী– নর-নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে লেখায় খুবই গুরুত্ব দেন। এই মনই তো লিখেছিল ‘বন-ফুল’ নামের কাব্যোপন্যাস। তখন তাঁর কত আর বয়স নিতান্ত তরুণ কবি। সে বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘গুপ্তপ্রেশ’ থেকে ১২৮৬ বঙ্গাব্দে। প্রকাশক মতিলাল মণ্ডল। বইয়ের ভেতরে লেখা ‘লেজ ষ্ট্রীট ক্যানিং লাইব্রেরী ও চিনাবাজার পদ্মচন্দ্র নাথের দোকানে প্রাপ্তব্য’। তরুণ কবির সেই বইতে যৌন-সামাজিক বিবাহের বিরুদ্ধে মনের বিবাহকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই কাব্যোপন্যাসে ছিল, ‘বিবাহ কাহারে বলে জানিতে চাহি না–/ তাহারে বাসিব ভাল, ভালবাসি যারে!’ লক্ষণীয় ‘কাব্যোপন্যাস’ এই বর্গীকরণ। কাব্যেও উপন্যাস লেখা সম্ভব এ তো তখনকার পক্ষে বেশ বিপ্লবী ভাবনা। আর বিবাহ, নর-নারীর সামাজিক যৌন-সম্পর্ক বিধায়ক চুক্তি, এখানে মনের কাছে তুচ্ছ– তাও কি কম বিপ্লব! এসব পড়ে মনে হতেই পারে পিতা রবীন্দ্রনাথ হবেন উদার। তাঁর দাদা সত্যেন্দ্রনাথ পিতা হিসেবে সত্যই উদার ছিলেন– সন্তানদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথা পড়লে জানা যায় পিতা হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ মেয়েকে কতটা মুক্ত রাখেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ।
আরও ছাতিমতলা: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
তাঁর কন্যা রেণুকার জীবন কি তাঁরই জন্য একেবারেই আক্ষরিক অর্থে শেষ হয়ে গেল না! রেণুকার অকাল মৃত্যু ১২ বছর ৮ মাস বয়সে। শরীরের ওপর তো না হয় মানুষের হাত থাকে না। অসুস্থ রেণুকার আরোগ্যের জন্য পিতা রবীন্দ্রনাথ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, স্বাস্থ্যবিষয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। রোগশয্যার দিনগুলিতে মেয়ের পাশে থেকেছেন– যাতে শরীর ভালো হয় তার জন্য হাওয়া-বদলের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু তার আগে সহসা বিবাহ দিতে গেলেন কেন? বিশেষ করে যে মেয়ে একেবারেই অন্যরকম! আর বিয়েও দিলেন নিতান্তই বাল্যবেলায় হঠাৎ করে। এ কি ‘বন-ফুল’ রচয়িতার উপযুক্ত কাজ?
কেমন মেয়ে ছিলেন রেণুকা? চিত্তরঞ্জন দাশের বোন ঊর্মিলার লেখা থেকে জানা যাচ্ছে ‘এক সন্ন্যাসিনীর মন নিয়ে এসে জন্মেছিল’। রবীন্দ্রনাথের অপর কন্যা মীরা দেবী (ভালো নাম অতসীলতা) ‘রোগশয্যার দীর্ঘ অবসর কাটাবার জন্য’ যে ‘স্মৃতিকথা’ লিখেছিলেন তা দিদি রেণুকার কথায় ভরা। রেণুকার ডাক নাম রানী। মীরা লিখেছেন, ‘সব মেয়ে ঘরসংসার করবার মন নিয়ে জন্মায় না। রানীদি ছিলেন সেই ধরনের মেয়ে। বাবা যদি রানীদিকে অল্প বয়সে বিয়ে না দিয়ে লেখাপড়া করাতেন তা হলে বোধ হয় ভালো করতেন।’ রেণুকার জন্য বাড়িতে কোনও শিক্ষক আসতেন না। মীরার রানীদিদি গল্পগুজব কম করতেন, বই পড়তে ভালোবাসতেন খুব, সাজগোজে একেবারেই মতি ছিল না। দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে নীতু খুবই ভালোবাসতেন বোন রানীকে। একবার মাঘোৎসবে নীতীন্দ্রনাথ রেণুকার জন্য বাহারে শাড়ি কিনেছিলেন। মীরা দেবী লিখেছিলেন, ‘ওঁর জন্য এত বাহারে শাড়ি এনেছেন বলে বোধ হয় নীতুদার উপর রাগ করে শাড়ি ছিঁড়ে ফেললেন।’
আরও ছাতিমতলা: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
এমন মেয়েটির মনের কথা কিন্তু পিতা রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন না। তাঁর স্বাধীন মনের দাম দেননি তিনি। বরং একেবারেই প্রচলিত সমাজের বিধি অনুসরণ করেছেন সাধারণ আর পাঁচজন সামাজিক বিধি মেনে চলা বাবার মতো। স্ত্রী মৃণালিনীকে চিঠিতে লিখছেন, ‘রাণীর যেমন প্রকৃতি– বাপের বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই ও শুধরে যাবে…।’ এ কোন রবীন্দ্রনাথ? সংবেদী লেখক রবীন্দ্রনাথ নন। মেয়ের ‘মুদ্রাদোষ’ শুধরে দেওয়ার জন্য বাপের বাড়ি থেকে দূরে পাঠাতে চাইছেন। মুদ্রাদোষ মানে সাজতে না চাওয়া, বই পড়া, গল্প-গুজব না করতে চাওয়া! ওই চিঠিতেই লিখছেন বিবাহের জন্য দূরে না গেলে, ঠাকুর বাড়ির উদার অভ্যাসের হাওয়া মনে থাকলে ‘স্বামীর প্রতি একান্ত শ্রদ্ধা ও নির্ভরকে শিথিল করে দিতে’ পারে। বিস্ময়ে চুপ করে বসে থাকবেন রবীন্দ্রপাঠক। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প লিখেছিলেন এই রবীন্দ্রনাথ! মৃণালকে কলকাতার স্বামীগৃহের গলি থেকে মুক্ত করে শ্রীক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন এই লেখক? সে গল্প অবশ্য পরে লেখা। সে গল্প যে ‘সবুজ পত্র’ সাময়িকীতে প্রকাশিত তার সম্পাদক প্রমথ, বিবাহ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা ইন্দিরাকে। ইন্দিরা-প্রমথর পত্রালাপ আবেগে-প্রেমে ভরা। নিজের কন্যার আকস্মিক বিবাহ সত্যেন্দ্রনাথ দেননি। রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন। রেণুকার মনের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব না দিয়ে চেয়েছিলেন রেণুকা মানিয়ে নিক সমাজনীতির সঙ্গে।
আরও ছাতিমতলা: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
রেণুকার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, তিন দিনের কথায় বিয়ে হল। তারপর! সত্যেন্দ্রনাথ শ্বশুরের টাকায় আমেরিকায় পড়তে গেলেন। এভাবে বিয়ে করে শ্বশুরের টাকায় বিদেশ যাওয়ার সুবিধেবাদী প্রক্রিয়াকে কবি সমর সেন সাধারণভাবে ‘পুরুষাঙ্গ বন্ধক’ রাখা বলে মনে করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ টাকা নিয়ে গেলেন কিন্তু পড়া শেষ না করেই ফিরলেন। মীরা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন সত্যবাবু (সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) অকৃতকার্য হয়ে ফিরে আসায় ‘রানীদির মনটা খুব ভেঙে গিয়েছিল।’ সেই মন আর ভালো হয়নি। সত্যেন্দ্রনাথ ফিরে এসে অবশ্য শারীরিক প্রাপ্য পেলেন। বাল্যবিবাহের পর মেয়েদের শরীরে ঋতুকাল এলে দ্বিতীয় বিবাহ বা ফুলশয্যা হয়– এটাই ঠাকুরবাড়ির রীতি। সত্যবাবু পড়া শেষ না করে ফিরে এলেও পুরুষ তো। কাজেই ফুলশয্যার অধিকার আছে। রেণুকা অবশ্য ফুলশয্যার কয়েকদিন পরেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই অসুস্থতা রবীন্দ্রনাথের চিঠি অনুযায়ী sore throat। খুশখুশে কাশি, যক্ষার লক্ষণ, দুর্বলতা এসবই শরীরের অন্যতর রোগ– তার সঙ্গে ফুলশয্যার শারীরিকতার হয়তো সম্পর্ক নেই কিন্তু মর্যাদাসম্পন্ন নিভৃতচারী বালিকার মন যে স্বামী ও বিবাহে অনিচ্ছুক ছিল, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।
রেণুকা অকাল প্রয়াত হলেন। রোগশয্যায় সেবাময় পিতা রবীন্দ্রনাথ। কবি রবীন্দ্রনাথ সেই শয্যায় লিখছেন ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা। এ সবই মহিমময় ছবি। তবু পিতা রবীন্দ্রনাথকে কি ক্ষমা করা যায়! না কি বলতে হবে ব্যক্তিজীবনের এই মর্মান্তিক ত্রুটি সংশোধন করে লেখক রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করছেন পরেশবাবুর (‘গোরা’) মতো পিতা, বিপ্রদাসের (‘যোগাযোগ’) মতো দাদা? পরেশবাবু, বিপ্রদাস– দু’জনেই কথায় কাজে সংবেদী অভিভাবক। কন্যা আর সহোদরাকে সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে আশ্রয় দেন। মীরা দেবীর ‘স্মৃতিকথা’ বুঝিয়ে দেয় রাণীদিদির প্রতি বাবার আচরণের জন্য তাঁর অভিমান থেকেই গিয়েছিল।